উহ! এই মশাদের যন্ত্রণায় আর ঘুমানো গেলোনা। এত সাধের ঘুমটা মাটি করে দিল।মশাগুলো তো মশা না, এক একটা ক্ষুদে ভ্যাম্পায়ারের মত সূঁচ ফুটিয়ে রক্ত চোষার সাথে সাথে আবার চিকন গলায় গুনগুনানি ফ্রি শুনিয়ে যায়।পৃথিবীতে হাজার বছর পরে মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে বিজ্ঞানীরা নানা রকম সন্দেহজনক তত্ত্ব দিলেও মশাদের অস্তিত্ব যে আরো অনেকদিন পর্যন্ত থাকবে এই বিষয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিত।
ঘড়িতে ৯টার ঘন্টা বাজছে, অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।বাইরে অন্ধকারে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে, আকাশটাকে কে যেন প্রচন্ড আক্রোশে বিদ্যুতের ছুরি দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলছে আর সাথে কানফাটানো শব্দ তো আছেই।তিনদিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি চলছে, এমন হলে শহরে বন্যা হতে আর বেশি দেরি নেই।
ঘুমাতে ঘুমাতে ভোর হয়ে গিয়েছিল,তাই কবে যে এত রাত হয়ে গেল টের পাইনি।মন চাচ্ছে আবার কাপড়ে সারা শরীর ঢেকে শুয়ে পরতে, এমন দিনে এর চেয়ে ভালো কিছু আর হয়না।কিন্তু গতকালও কিছু খাওয়া হয়নি,মনের ইচ্ছা না থাকলেও পেটের ইচ্ছার কাছে হার মেনে বিছানা থেকে উঠতেই হল।
খিদের জন্য এত কষ্ট আর ভালো লাগেনা, তাও বেঁচে থাকতে হলে তো খেতেই হবে।মাঝে মাঝে মনে হয় গাছদের মত একজায়গায় দাঁড়িয়ে খানিকটা সূর্যের আলো আর শিকড় দিয়ে টেনে নেওয়া কিছু খনিজ দিয়ে পেট ভরাতে পারলে ভালোই হত।কিন্তু আমার না আছে শিকড়,আর রোদে গেলেই শরীর চিড়বিড় করে উঠে।কি আর করা, গাছ হয়ে যেহেতু পৃথিবীতে আসতে পারলামনা,তাই এইসব না ভেবে নিজের পেটের ব্যাবস্থা নিজেই করতে হবে।
যাহ্!কারেন্টটাও চলে গেলো,আমার অবশ্য অন্ধকারে চলাফেরা করতে কোনো সমস্যা হয়না, অনেক দিনের অভ্যাসতো।উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া এতবড় বাড়িতে আমি অনেকবছর ধরে একাই থাকি।আর আমার বাড়ি শহরের একপ্রান্তে নির্জন এলাকায় হওয়ায় কোনো প্রতিবেশীও নেই।একলা মানুষ হওয়ায় আমার কাজের লোকও লাগেনা।তাছাড়া রান্না-বান্নার পাট আমার বাড়িতে নেই, আমি বাইরেই খাওয়া-দাওয়া করে থাকি সবসময়।
দুই বছর আগে এমনি এক রাতে চোর এসেছিল বাসায়,ব্যাটা মনে হয় ভেবেছিল এই বিশাল বাড়িতে অনেক ধন-রত্ন থাকবে।কিন্তু পরে চোরের এমন অবস্থা হয়েছিল যে ভাবলেই হাসি পায় এখনো। এরপর থেকে আর কোনো চোরও আসেনা এখানে।
ব্রাশ করতে করতে নিজের চেহারাটা আয়নায় দেখতে লাগলাম।চেহারা দেখে বয়স বুঝাই যায়না ,মনে হয় একুশ-বাইশ বছরের তরুণ দাঁড়িয়ে আছে।নিজের শরীর নিয়ে আমি যথেষ্ট সচেতন,কিন্তু সবচেয়ে বেশি যত্ন নিই আমার দাতগুলোর কারণ ওরা না থাকলে খাবার খাব কি দিয়ে।
বৃষ্টির মধ্যে আর কোট গায়ে দিলামনা,জামার উপর রেইনকোটটা চড়িয়ে নিলাম।আজকে মনে হয় বৃষ্টির জোর আরো বেড়ে গিয়েছে,রাস্তায় এক বিঘত পানি।মানুষ-জন তো দুরের কথা,একটা কুকুরও নেই।এমন ঝুম বৃষ্টির দিনে দশটা বাজতে না বাজতেই সবাই মনে হয় ঘরে চলে গিয়েছে।
রাস্তার ছোট-বড় গর্তগুলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে এক ঘন্টা হেঁটে হেঁটে বড় রাস্তার মোড় পর্যন্ত আসলাম,দোকান-পাট সব বন্ধ।মুদি দোকানের সামনে গিয়ে অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কালাম,কিন্তু কেউ সাড়াও দিলনা।এখন কি করব,খাবার পাব কোত্থেকে?
খিদায় শরীর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে,কারো বাড়িতে গিয়ে যে খাবার চাইব সেই উপায়ও নেই।রাস্তার পাশে যাত্রীছাউনিতে বসে রইলাম কিছুক্ষণ,বৃষ্টি কমলে বের হব।
হঠাত দূরে অল্প একটা আলোর রেখা দেখতে পেলাম সাথে রাস্তার পানি মাড়িয়ে চলার ছপ-ছপ শব্দ,কেউ একজন আসছে।আমার গা টা কেমন জানি শিউড়ে উঠল।আস্তে আস্তে লোকটা কাছাকাছি আসল,আমার মতই বয়স হবে প্রায়, এমন ধবধবে ফরসা যে রক্তশুন্যতায় ভোগা মানুষের মত লাগছে।আমাকে দেখে মনে হয় খুশিতে দাঁত বের করে ফেললো।লোকটা যাত্রী ছাউনিতে উঠে পাশে বসতে বসতে হাসিমুখে বলল“এত ঝড় বৃষ্টির রাতে এখানে কি করছেন ভাই?”।খাবার কিনতে এসে বৃষ্টির জন্য ছাউনিতে বসে আছি বলার পর পাল্টা প্রশ্ন করলাম, “আপনিই বা এত রাতে বৃষ্টিতে কি করছেন?” জবাবে লোকটা একগাল হেসে বলল,“আর বলবেননা ভাই, অফিসের কাজে শহরের বাইরে গিয়েছিলাম,ফিরতি পথে শহরের কাছাকাছি এসে গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেল।তাই হেঁটে হেঁটে এতদুর আসতে হল,এতক্ষন একলা একলা ভয় লাগছিল তাই আপনাকে দেখে মনে সাহস আসছে”।
বৃষ্টিটা একটু কমে এসেছে,তাই লোকটাকে বললাম“ভাই,আমি উঠি।বৃষ্টি কমে আসছে,হয়তোবা সামনে দু-একটা দোকান খোলা থাকতে পারে”।লোকটা হেসে আমাকে বলল“আরে ভাই এত রাতে দোকান আর খুলবেনা,আধাঘন্টা হাঁটলেই আমার বাড়ি,সেখানে চলেন।আমারও সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি,কাজের লোক যা রান্না করে রাখবে দুই জন মিলে ভাগ করে খাব”।প্রস্তাবটা মন্দ নাআমার সাথে তো টাকা কিংবা দামি কোনো জিনিস নেই যে লোকটা কেড়ে নিবে।আর আমিও মনে মনে লোকটার সঙ্গ চাইছিলাম,তাই একবাক্যে রাজি হয়ে গেলাম।
ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে দুইজন হাঁটা ধরলাম।কিছুদুর যেতেই একটা গর্তে লোকটা হঠাত আছাড় খেয়ে পড়ল,সাথে হাতের টর্চটাও পানিতে।হাত ধরে টেনে তুলতে যেতেই মনে হল বরফ ধরে টানছি,এত ঠান্ডা কেন লোকটার হাত,ভুত নয়তো?পরক্ষনেই মনে হল বৃষ্টিতে ভিজে হাত ঠাণ্ডা হতেই পারে,এমন ভৌতিক পরিবেশে আমারই মনের ভুলে অবাস্তব চিন্তা করছি।নিজের চিন্তায় নিজেরই হাসি পেল।
লোকটাকে টেনে তুললাম,বেচারার জামাকাপড় সব কাদায় মাখামাখি অবস্থা।হাত দিয়ে কাদা মুছতে মুছতে বলল “দেখেছেন ভাই, রাস্তার কি দুরাবস্থা।আরেকটু হলেই পা’টা মচকে যেত”।
হাত দিয়ে বাড়ি মেরে টর্চটা কোনোমতে জ্বলল,টিমটিমে টর্চটার আলোতে দুজনে হাঁটা শুরু করলাম। সামনে রাস্তার মোড়ে জমাট অন্ধকার,টর্চের নিভুনিভু আলোয় যেন আরো বেশি অন্ধকার লাগছে।আমার কেমন জানি অসস্তি লাগছে,পাশের লোকটা অনেকক্ষণ ধরেই চুপচাপ হাঁটছেন মাথা নিচু করে।মোড়ের ওখানে আসতেই হঠাত টর্চের আলো নিভে গেলো আর সাথেসাথেই লোকটা আমার ঘাড়ে কামড়ে ধরল।
ধস্তাধস্তি করতে লাগলাম লোকটার সাথে,আমার চেয়ে ওজন কম বলেই হয়তো দুই-তিন ধাক্কায় রাস্তায় ফেলতে পারলাম।এরপর হাতরিয়ে হাতরিয়ে টর্চটা জ্বালিয়ে লোকটার মুখের দিকে আলো ফেললাম,মুখের ফাঁক দিয়ে দুইটা শ্বদন্ত বেরিয়ে আছে তার।হাসি চাপতে না পেরে শেষে হো হো করে হেসেই ফেললাম ভ্যাম্পায়ারের দিকে তাকিয়ে।ভয়ে ভীত না হয়ে তাকে দেখে হাসছি, এমন দৃশ্য দেখে বেচারা ভ্যাম্পায়ারও হতভম্ব।কোনোমতে হাসিটা থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আরে ভাই,তুমি আমার রক্ত খাওয়ার জন্য এই অবস্থা করছো, আর আমিও তোমার রক্ত খাওয়ার জন্যই তোমার সাথে আসছিলাম।আমি নিজেও যে একজন ক্ষুধার্ত ভ্যাম্পায়ার”।