আজ তটিনীর বিদ্যালয়ের প্রথম দিন। তার প্রিয় দাদা ভাই এর সাথে আজ বিদ্যালয়ে যাবে। তটিনীদের বাবা মা ভাই ফুফু সবার গ্রামের সাধারণ একান্নবর্তী পরিবার। বাবার হাটে দোকান আছে। তটিনীদের চার কক্ষের বেড়ার ঘর, সামনে বড় ওঠান,পিছনে ধানেরক্ষেত আর ক্ষেত। কুয়াশায় মোরা শীতের সকাল। ছোট ভাইটির জন্মের কারনে,সে দাদির সাথে ঘুমায়। অন্য দিন হলে সে ঘুম থেকে উঠত না,যেহেতু দাদাভাই বলেছে তাই সে অনেক আগেই ঊঠে পড়েছে।ও বুঝতে পারেনা আজ দিনটা কেন অন্যরকম। বাবাকে সে দেখল না ঘরে। সে স্কুলে যাবে অথচ তার বিদ্যালয় এর জামা নেই তারপরও সে অনেক খুশি কারণ বাবা অনেক সুন্দর একটি ব্যাগ এনে দিয়েছে। সেই কবে থেকেই তো দাদাভাই নতুন বই ,খাতা ,পেন্সিল কত কিছু এনে দিয়েছে। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ অদ্ভুত মিষ্টি, ভারী মিষ্টিে। বইগুলো খুলে আর ভাবে কিসের ঘ্রাণ বইগুলোতে? এরা কেন এত আপন? তটিনী মার কাছে গেল, মা পাকের ঘরে উনুনের আঁচে ভাপা পিঠা খেজুরের গুড় দিয়ে বানাচ্ছে । সে এক টুকরো খেজুরের গুড় মুখে দিচ্ছে, মা এটা দেখে একটু হেসে বলল, একটা পিঠা খেয়ে নাও। তটিনী একটি পিঠা নিয়ে আগুনে আঁচে উনুনের ধার ঘেঁষে জুবুথুবু হয়ে বসে পড়ল। উনুনের আঁচ তার ভারি ভালো লাগে। তটিনী তার বাবার গলা শুনতে পেলো। ও দৌঁড়ে বসার ঘরে গেল, ঘরে গিয়ে দেখল বাবা খেজুরের কাঁচা রস নিয়ে এসেছে, একটা গ্লাসে তাকেও দেয়া হল। সবাই খুব মজা করে জিনিসটা খাচ্ছে , তাই তাড়াহুড়ো করে মুখে দিল, দিয়েই ফেলে দিল কিরকম যেন আঁশটে গন্ধ তার ভালো লাগল না। একটু পরেই দাদা ভাইয়ের সাথে রওনা দিল। তটিনীর কেন যেন আজকে খুব ভয় লাগছে। তাই দাদার শক্ত করে হাত ধরে রেখেছে। তাই দাদাভাই ওর দিকে তাকিয়ে হাঁ করে ধোয়া ছাড়তে লাগল। তটিনী ফিক করে হেসে দিল। অবশেষে বিদ্যালয়ে পৌঁছে গেল দাদাভাই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল,সে অনেক ছোট ছোট ঠিক তার মত অনেক জনকে দেখতে পেল। শিক্ষককে দেখলো, তার হাত মস্ত লাঠি। সে ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু শিক্ষক খুব আদর করলো তাকে। তটিনী খুব খুশি হলো। কেমন করে যেন সময়টা ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। দাদা ভাইয়ের হাত ধরে নাচতে নাচতে বাসায় ফিরলো। কিছুক্ষণ পর সে খেলতে যাবে , তখন রুপার চাচাকে দেখতে পেল, রুপা তার বান্ধবী। রুপার খুব মন খারাপ হলো কারণ তার চাচা নেই । রুপার চাচা রুপাকে খুব আদর করে। রুপা দেখতে কালো, তাও সবাই তাকে সবাই অনেক ভালোবাসে। সে রুপার চাচাকে জিজ্ঞাসা করল চাচা রুপা কোথায়। রুপার চাচা কিছু না বলেই চলে গেল। আজও ওনেক খুঁজেও কোথাও পেল না রূপাকে। বিকালে ঘুম থেকে উঠে তটিনী রুপাদের বাড়ি গেল, গিয়ে দেখল তার বাসায় সবাই কাঁদছে ,শুধু রুপা নেই। সে রূপার মাকে জিজ্ঞাসা করল ,”রুপা কই”। ওর মা তটিনীকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল ।সে তো কিছুই বুঝতে পারছে না সবাই এতো কাঁদছে কেন।?রফিককে দেখতে পেল, রফিক তার বন্ধু। তটিনী বলল,” রফিক রুপা কইরে?”। রফিক বললো,” রুপা তো জমিদার বাড়ির ঐ পুকুরে পড়ে মইরা গেছে”। তটিনীর খুব মন খারাপ হইলো আর কি তাহলে সরিষা ক্ষেতের আইল ধরে দুইজন দৌঁড়া-দৌঁড়ি করা হবে না । ঘুড়ি ওড়ানো হবে না, পুতুল খেলা হবে না, জোলাবাতী খেলা হবে না। পাতায় পড়ে থাকা শিশির নিয়ে খাওয়া হবে না।ওকি! আর কখনোই কি রুপাকে দেখবে না।
পরদিন বড় ফুফুরা বেড়াতে আসলো। বড় ফুফুরা আসলে তটিনীর খুব ভাল লাগে। কারণ, বড় ফুফুর ছোট মেয়ে ঋতু আপুও আসে।ঋতু আপুকে তটিনীর খুব ভাল লাগে। ঋতু আপু আসলে অনেক মজা হয়,নতুন নতুন খেলা হয়।ওর মন ভাল হয়ে গেল।ঋতু আপু বলল,তটিনী আমরা কাল সকালে ফুল কুড়াতে যাব। তটিনী বলল খুব মজা হবে। সারদিন অনেক খেলাধূলা হলো, অপু বলল মনে আছে তো?তটিনীর তো কিছুই মনেই ছিল না,তারপরও “হু” বলল। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল। সকলে আপু ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল চল, তটিনী বলল কোথায়? আপু বলল, “ঐ ভাঙা জমিদার বাড়িতে ওইখানে একটা বিশাল শিউলি গাছ আছে সেখানে অনেক ফুল পাওয়া যাবে।”
তটিনীর খুব রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছে। ও বলল, ” চল তাহলে তাড়াতাড়ি”।ওরা জমিদার বাড়িতে গাছের নিচে পৌঁছে গেল, তটিনী দেখে, চিৎকার দিয়ে বলল এত ফুল! ওরা ফুল কুড়াতে শুরু করল।ফুল কুড়াতে কুড়াতে তটিনীর একটা পুকুর চোখে পড়ল,ও দেখল কি বিশাল পুকুর আর পানি এত সুন্দর! শিউলি ফুলে অনেকটাই ছেয়ে আছে।কি অপূর্ব! কিন্তু তটিনীর কেমন জানি লাগছে, এই পুকুরই রূপা পড়ে মরে গেল?ও এখানে আসল কেন? এখানে তো কেউ আসে না!এসবই ভাবছিল আপু বলল,” তটিনী চল আনেক দেরি হয়ে গেল,সবাই বকবে”।ওরা ফিরে আসল।ঐ ফুলগুলো দিয়ে মালা বানালো,ফুলগুলো হলুদ আংশ দিয়ে সাদা কাগজে ক খ লিখল,ফুল আঁকল। ওরা অনেক মজা করল।
পরদিন আপু চলে গেল,তাই তটিনী মনটা খুব খারাপ। আর শিউলি ফুল আনা হবে না,যাওয়া হবে না ঐ ভাঙ্গা জমিদার বাড়ীতে।সারাদিন শুধুই মন খারাপ,আজ ও খেলতেও যাবে না।আনেক ভেবে ঠিক করল,,না সে একাই যাবে।তাই খুব ভোরে তার সোয়েটার, মাফলা্ টুপি পরে পা টিপেটিপে বেরিয়ে পরল।সকালে সমনে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না,সে বুঝতে পারছে না সে কেন কাপছে,কাঁপুনিটা হয়ত ভয়ের,কিন্তু সে নিজেকে বলছে অনেক শীত তাই কাপছি।মনে হয় আজকে রাস্তাটা কেন শেষ হচ্ছে না। অবশেষে পৌঁছে গেল ঐ রেললাইন পাশের জমিদার বাড়িতে। আজ কুয়াশা একটু বেশি মনে হচ্ছে। কিন্তু শিউলি গাছটা আগের মতোই দাঁড়িয়ে এবং পুকুর পাড়ে অনেক বেশি শিউলিফুল পড়ে রয়েছে । তটিনী ভাবছে আজ সে আসতে পেরেছে তাই অনেক ফুল কুড়াবে। একটা একটা শিউলিফুল সাবধানে তুলে জামায় রাখতে লাগলো ,আজ আঁচল ভরে শিউলিফুল কুড়াবে। কিছুক্ষণ পর ঢুস করে কিছু একটা শব্দ হলো ,তটিনী চমকে পিছনে তাকাল কিন্তু কেউ ছিলনা ওখানে।ভয় তো লাগছে তার কিন্তু জেদ চেপে গেল তার। যেহেতু এসেই পড়েছে আজ আঁচল ভরে ফুল কুড়িয়ে যাবে। সে আবার ফুল কুড়াতে মন দিল। চারদিকে শিউলি ফুলের ম ম করা গন্ধ, কিন্তু এই বিশ্রী গন্ধ কোথা থেকে আসছে?সে বুঝতে পারেনা ।কোনো পশু ও মানুষের মল হবে হয়ত। পায়ের নিচে এদিক-সেদিক খুঁজে দেখল, না কিছুই নেই। তটিনীর খুব অস্বস্তি ও অস্থির লাগছে। এত ঠান্ডাও কেন যে ঘেমে যাচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। গন্ধটা তীব্র হয়ে যাচ্ছে,হঠাৎ চমকে পাশে দেখত পেল, ওর ছোট ভাইটা থেকে একটু বড় হবে বয়সে এরকম একটা ছোট বাচ্চা ওর দিকে কেঁদে কেঁদে এগিয়ে আসছে, আসছেতো আসছেই, আস্তে, ধীরেধীরে, ক্রমেই দূরত্ব কমতে লাগলো। এখানে বাচচাটা এলো কি করে , সে কাঁদছে কেন? তার কি সাহায্য করা উচিত? সে বুঝতে পারছে না। কিছুটা দূরে পুকুরের ঐ পাড়টায় ঘন কুয়াশায় রুপার মত একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওটা কি রুপা! তার বান্ধবীটা! তার জামাটাই তো পরা! ওকে ঝাপসা বোঝা যাচ্ছে। সে বারবার বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য ইশারা করছে ।ও আসবে কি করে? তটিনী কিছুই বুঝতে পারছে না, ভাবছে কি করবে ও , বাচ্চাটা তো এগিয়ে আসছে একদম কাছে ,হঠাৎই সে দৌড় দিল , দৌড়ে পৌঁছে গেল একদম বাড়ির কাছে। বুক হাপরের মত উঠানামা করছে। তটিনী দাঁড়ালো দেখল পিছনে কেউ নেই। পা টিপেটিপে ঠিক আগেরই মতো ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়লো ।দাদিকে জড়িয়ে ধরলো,দাদী বলল, তার হাত পা এত ঠান্ডা কেন। তটিনী কিছু বলে না, চুপ করে পরে থাকে, যেন ঘুমিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর ঝকঝকে রোদে সারা উঠোন ভরে গেল। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা তার স্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছে!সত্যিই গিয়েছিল সে?বাচ্চাটিকে কে ,কোথা থেকে আসলো ,সে কারো কাছে বলতেও পারছেনা ভয়ে। যদি ওকে বকা দেয়,তাই ঠিক করল সে বলবে না। যখন সে বড় হবে তখন এর উত্তর খুঁজে নেবে। সত্যিই কি উত্তর খুঁজে পাবে সে!