রহস্যে ভরা তুতেনখামুনের সমাধি!

আজ থেকে প্রায় ৩৩০০ বছরের আগের কথা। ক্ষমতা, ঐশ্বর্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মিশর। তৎকালীন মিশরের বাদশাহ্‌র উপাধি ছিল ফারাও। যার কথা বলতে চাচ্ছি তিনি ছিলেন মিশরের ১৮তম রাজবংশের সর্বশেষ ফারাও। ফারাও তুতেনখামুন। তার রাজত্বকালও ছিল সংক্ষিপ্ত। তার বাবা ছিলেন ফারাও আখেনআতেন এবং মা ছিলেন কিয়া। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তুতেনখামুনের মৃত্যু হলে তাঁর বংশধর ক্ষমতা লিপ্সু এক জেনারেলের দ্বারা সিংহাসনচ্যুত হয়।

তুতেনখামেনের পিতা ফারাও আখেনআতেন চেষ্টা করেছিলেন মিশরীয়দের বহু উপাস্যের পরিবর্তে এক উপাস্যের পূজা প্রচলন করতে। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। তার প্রধান স্ত্রী ছিলেন নেফারতিতি। তার মৃত্যুর পর ফারাও Smenkhare রাজত্ব পরিচালনা করেন। ব্রিটিশ ইজিপ্টোলজিস্ট (মিশরীয় পুরাতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ) নিকোলাস রিভস বিশ্বাস করেন নেফারতিতি এবং Smenkhare একই ব্যক্তি ছিলেন। রাণী নেফারতিতি ক্ষমতায় আসার পর তার নামটাই শুধু পরিবর্তন করেন।

১৯২২ সালে হাওয়ার্ড কার্টার তুতেনখামুনের সমাধি আবিষ্কারের পর সারাবিশ্বের প্রত্নতত্ত্ববিদদের মধ্যে হইচই পড়ে যায়। রাতারাতি তুতেনখামুনের নাম বিশ্ববাসীর কাছে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত নয়। মজার ব্যাপার হল তুতেনখামুন কিন্তু তার জনগণের কাছে তেমন বিখ্যাত ছিলেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তুতেনখামুন তৎকালীন মিশর বাসীর তুলনায় বর্তমান যুগের মানুষের কাছে বেশি আলোচিত। এর কারণ একটাই তুতেনখামুনের সমাধি প্রায় অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল এবং এই সমাধি থেকে মূল্যবান ধন-সম্পদ উদ্ধার করা হয়। এর ফলে তৎকালীন মিশর সম্পর্কে জানার এক নতুন দরজা খুলে যায়।

তুতেনখামুনের সমাধি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞরা একটু অবাকই হন। এই সমাধি অন্য রাজকীয় সমাধির তুলনায় আকারে ছোট, সাজ-সজ্জাও ভিন্ন। Yale বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন ডারনেল বলেন তুতেনখামেনের সমাধি “কিছুটা প্রাচীণ রীতি বহির্ভূত কারণ এটি আকারে তুলনামূলক ভাবে ছোট। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তুতেনখামেনের সমাধি কি আদতেই ছোট নাকি এটা কোন বিশাল সমাধির অংশবিশেষ?”

blank
                                                            তুতেনখামুনের সমাধির নকশা

এই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন মূলত নিকোলাস রিভস। তিনি তুতেনখামুনের সমাধির স্ক্যান করা ছবি পরীক্ষা করতে যেয়ে সমাধির উত্তর এবং পশ্চিম পাশের দেয়ালের অপর পাশে ফাঁকা জায়গার অস্তিত্ব পান। এছাড়াও একপাশের দেয়ালে তিনি বিশেষ নকশা দেখতে পান। যা দেখে তিনি ধারণা করেন এখানে কোন গোপন দরজা থাকতে পারে। এতে তিনি ধারনা করেন, মাত্র উনিশ বছর বয়সে মৃত্যুর পর তুতেনখামেনকে তড়িঘড়ি করে একটি কক্ষে সমাধিস্থ করা হয় যা মূলত রানী নেফারতিতির সমাধি ছিল।

তার এই থিউরি উপর ভিত্তি করে মিশরীয় কর্তৃপক্ষ তুতেনখামুনের সমাধি নতুনভাবে স্ক্যান করার সিদ্ধান্ত নেয়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফীর তত্ত্বাবধানে এই স্ক্যান সম্পন্ন করা হয়। স্ক্যান করতে যেয়ে অনুসন্ধানী দল এক অদ্ভুত সমস্যার সম্মুখীন হয়। Luxor এলাকার পাথরে পাহাড়ের একটি বৈশিষ্ট্য হল এগুলো নিরেট নয়। সমগ্র এলাকার পাহাড় জুড়ে লম্বা লম্বা ফাটল। এতে স্ক্যান করে ভাল ছবি তোলা যাচ্ছিল না।  হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইজিপ্টোলজির অধ্যাপক P.D. Manuelian বলেন, “তাই আমরা যত বেশি এঙ্গেল থেকে সমাধির ভিতরে এবং বাইরে  যত বেশি স্ক্যান করব তত ভাল ফলাফল পাওয়া যাবে”।

blankতুতেনখামুনের মমি

দ্বিতীয় দফা স্ক্যান করার পর মিশর সরকারের মিশরের প্রাচীন ও প্রাচীন যুগের তথ্য সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। তুতেনখামুনের সমাধির পাশেই আয়োজিত এই সম্মেলনে তিনি তুতেনখামুনের সমাধিতে পাওয়া নতুন সব তথ্য-উপাত্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য  সারাবিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রত্নতত্ত্ববিদ ও বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন  । মন্ত্রী খালেদ এল-আনানি বলেন, “এগিয়ে যাবার জন্য আমার বিজ্ঞানের উপর ভরসা রাখব। আমরা কোন গোপন কুঠুরি খুঁজছি না। গোপন কোন কুঠুরি আছে কিনা সেটাই নিশ্চিত হতে চাইছি।” তিনি আরও বলেন, “আমরা গোপন কক্ষ নয় বরং সত্য এবং বাস্তবতার খোজ করছি।”

নিকোলাস রিভস অবশ্য বেশ আশাবাদী। বরং তিনি বিশ্বাস করেন তুতেনখামুনের সমাধির উত্তর ও পশ্চিম পাশের দেয়ালের অপর পাশে আলাদা কক্ষ আছে এবং সেখানে রানী নেফারতিতি শায়িত আছেন। রিভসের মতে, “আমরা একটি থিউরি দাড় করিয়েছি। আর এখন এই থিউরি পরীক্ষা করার পালা। আমার কথা যদি সত্য হয় তাহলে সেটা অসাধারণ হবে। আর যদি ভুল হয় তবে আমি আমার কাজ-ই করছি। যে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে সে অনুযায়ী সামনে এগোচ্ছি।”

blank

যদি তাই হয়, যদি রানী নেফারতিতির সমাধি পাওয়া যায় তাহলে তা হবে তুতেনখামুনের সমাধি আবিষ্কারের চেয়েও বড় আবিষ্কার। মিশরের পাজর ভাঙা পর্যটন শিল্প আবারও মাথা তুলে দাঁড়াবে। একসময় প্রাচীন ফারাওদের বসবাসস্থল মিশরের প্রধান পর্যটন এলাকা ছিল। কিন্তু বর্তমানে Luxor এলাকা পর্যটক শূন্যই বলা চলে। কারণ কিছুদিন আগে সিনাই উপদ্বীপের উপরে ২২৪ জন যাত্রী নিয়ে একটি রাশিয়ান বিমান বিধ্বস্ত হয়। এরপর রাশিয়া মিশরে সকল ফ্লাইট বাতিল ঘোষণা করে। ব্রিটিশ সরকার মিশরের লোহিত সাগর সংলগ্ন শার্ম এল-শেইখ এ বিমান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে। বিধ্বস্ত হবার আগে রাশিয়ান বিমানটি শার্ম এল-শেইখ থেকেই উড্ডয়ন করেছিল।

[নেফারতিতি সম্পর্কে আরো জানতে এখানে ক্লিক করুন]