ক্লাস সিক্স কি সেভেনে পড়ি তখন। আব্বু সেসময় চুয়াডাঙ্গায় ট্রান্সফার হয়ে গেছেন, বাসায় তাই বলা যায় আমার দুর্বার স্বাধীনতা। আম্মুকে হোমওয়ার্ক করেছি বুঝ দিয়ে টিভি দেখতে বসে পড়তাম প্রতি রাতে। সেদিনের রাতটাও এমন ছিল। ফ্রিজ থেকে চুরি করে নোসিলা এনে খেতে খেতে টিভিরুমে যেয়ে দেখি আম্মুর প্রিয় “কাসউটি জিন্দেগী কি” চলছে। চ্যানেল চেঞ্জ করতে করতে হঠাৎ চোখ থেমে যায় স্টার মুভিজে। ইংলিশ মুভির পোকা ছিলাম না তখন। বরং বলা যায় ইংলিশ মুভি দেখতাম কিন্তু স্টার গোল্ড আর সেট ম্যাক্সে হিন্দি ডাবিং হয়ে আসলে। আমার কাছে তখন একমাত্র ইংলিশ লেজিট মুভি হচ্ছে হ্যারি পটার। তো স্টার মুভিজে আসতেই দেখি লালচুলো এক জাদুকরী মেয়ে আর চোখে অদ্ভুত সানগ্লাস পড়া এক ছেলেকে দৌড়াতে। একটু পরই তার দেখা পাই প্রথম বারের মতো- দুই হাত থেকে বের হয়ে আছে ছয়টি ধাতব ব্লেড, আর ৩০+ ভলিউমে পুরো বাসা কাঁপাচ্ছে তার জান্তব চিৎকার। নোসিলার চকলেট অংশটুকু গলে গলে পড়ছে, আমি হা করে তাকিয়ে আছি সে মানুষটার দিকে। একটু পরেই টেকো মাথা লোকটা ডাকতে গিয়ে তার নাম বলল- “লোগান”।
এক্স ম্যানের সাথে সখ্যতা গল্পের প্যাঁচগোছ বোঝার বয়স হবার পরে কিন্তু এক্স ম্যানের সাথে পরিচয় আমার আদি ও আসল স্পাইডারম্যানের সাথে একই টাইমলাইনে। এক্স ম্যানের মতো আর কোন মুভি সিরিজ বোধহয় টাইমলাইন নিয়ে এতো তালগোল পাকায় নি। তাই নতুন মুভি দেখতে যাওয়ার আগে আগের ২টা>৩টা>৪টা>৫টা মুভি দেখে যাওয়া লাগতো। এতো শত সুপারহিরোর ভিড়ে তবু ঐ একজনকেই আলাদা লাগতো, একটু বেশি ভালো লাগতো, সে হচ্ছে লোগান ওরফে জেমস হাওলেট ওরফে উলভারিন। এটা বলতে বাঁধা নেই যে উলভারিন জনপ্রিয়তা পেয়েছি্ল তার চরিত্রকে সুপার হিরোয়িক ধাঁচে উপস্থাপন করার জন্যই। হিউ জ্যাকমানের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, উলভারিনের স্বভাবসুলভ ওয়াইল্ডনেস আর প্রপার ব্যাক স্টোরি উলভারিনকে প্রতিষ্ঠিত করেছে আর তাই পরিপূর্ণ ইনডিভিজুয়াল সুপার হিরো মুভি করতে উৎসাহ দিয়েছে প্রডিউসারকে। এক্স মেন তার আপন গতিপথে ঘুরপাক খাচ্ছিল, উলভারিনও তাই। তবুও কিছু একটা মিসিং ছিল। যে কিছু একটা এক্স ম্যান সিরিজ এচিভ করতে না পারলে কষ্ট হতো না তেমন কিন্তু উলভারিন এই কিছু একটা ডিজার্ভ করতো, দর্শক ডিজার্ভ করতো আরও কয়েকগুণ বেশি। উলভারিন পাজলের সেই মিসিং পিস খুঁজতেই লোগান দেখতে যাওয়া। পেয়েছি কী সেটা?
লোগান– দ্য মুভি উই ডিজারভড
লোগানের বাস এখন ২০২৯ সালে। প্রায় ১৪৩ বছর বয়সী লোগানের হিলিং ক্ষমতা ধীরে ধীরে প্রায় নিঃশেষের পথে। মনে আর এতটুকু সাধ নেই বেঁচে থাকার। তবুও টেক্সাসের পথে পথে তাকে ঘুরে বেড়াতে হয় গাড়ির শোফার হিসেবে কারণ দীর্ঘদিনের বন্ধু, মেন্টর চার্লস জেভিয়ার তার দায়িত্বে। একসময় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মিউট্যান্টদের গুরু ছিলেন যে চার্লস সে চার্লস আজ মৃতপ্রায়, যার নিজের শক্তিশালী মস্তিষ্কের ওপর নিজেরই কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, যাকে ঘুম পারিয়ে একটা বৃহদাকার পানির টাঙ্কিতে ঢুকিয়ে রাখা লাগে লোগানের। সাদামাটা এই নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ করেই আবার নেমে আসে অতীতের কালো ছায়া। যে ছায়ায় বুড়ো লোগান নিজেকে পুনরাবিষ্কার করে, আবিষ্কার করে বাস্তবতা আর আবিষ্কার করে প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো জং ধরা হৃদয়ে নতুন একটা ভালোবাসার। এই নিয়েই লোগান…স্রেফ এটুকুই!
লোগানের গল্প খুবই সাদামাটা। তবে গল্পবয়নে নির্দেশকের দুর্দান্ত মুনশিয়ানা। প্রতিটি দর্শকের চোখে উলভারিন অভেদ্য, অদম্য কিন্তু নির্দেশক এখানে প্রথম দৃশ্যেই উলভারিনকে লোগান হিসেবে, একজন দুর্বল মানুষ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন দর্শকদের। যুগ যুগ ধরে কমিক বুক রাইটাররা, স্ক্রিপ্ট রাইটাররা সুপার হিরো নিয়ে দর্শকদের চাহিদাকে ভুল বিশ্লেষণ করে আসছেন। দর্শকরা, পাঠকরা অস্ত্রের ঝনঝনানি, শক্তির প্রদর্শনী, জীবন বাঁচানো আর অসম্ভব ভাংচুর দেখতে চান না সুপার হিরোদের কাছ থেকে শুধু। তারা দেখতে চান কীভাবে একজন অমিত শক্তিধারী অতিমানব ঘটনা ও গল্পের বাঁকবদলে দুর্বল হয়ে সাধারণ মানুষের কাতারে নেমে আসেন, আবার সে বাস্তবতার সাথে লড়াই করে পুনরায় অতিমানব হয়ে ওঠেন। ক্রিস নোলান আর ফ্র্যাঙ্ক মিলার যেমন জাস্টিস করেছিল ব্যাটম্যানের সাথে, ঠিক তেমন ট্রিটমেন্টেই লোগানের সাথে জাস্টিসটা করলেন জেমস ম্যানগোল্ড। আমরা অমিত শক্তিধারী উইপন এক্স উলভারিনের চেয়ে সারা শরীরে যুদ্ধ আর কষ্টের দাগ রেখে যাওয়া দুর্বল লোগানকেই বেশি ভালোবাসি। অসাধারণ অভিনয়, অসাধারণ প্রোডাকশন ডিজাইন, অনবদ্য আর রগরগে একশন ( আই শুড সে দ্য বেস্ট ইন দ্যা রিসেন্ট টাইমস) আর অসামান্য চরিত্র চিত্রায়নে লোগান এক মুগ্ধকরের নাম। লোগান চরিত্রে হিউ জ্যাকম্যান তার ক্যারিয়ার সেরা কাজ করেছেন। ১৭ বছরের পথ পরিক্রমার একদম শেষে এসে বিজয়ী লোগান। স্টাইল, বডি আর হিরোয়িক প্রেজেন্টেশনে তো আগেই অনবদ্য ছিলেন, এই মুভির অভিনয় দিয়ে বাকি যা আছে সব পুষিয়েও দিলেন। চার্লস জেভিয়ার ওরফে প্রফেসর এক্স চরিত্রে প্যাট্রিক স্টুয়ারট কাঁদিয়ে ছেড়েছেন। এতো প্রিয় একটা ক্যারেক্টার, এতো প্রিয় একজন অভিনেতা প্রায় সবগুলো মুভিজুড়েই ক্রিটিকালি মোর অর লেস আন্ডারিউটিলাইজড থেকে গেছেন। অথচ এই মুভিতে কখনো মানসিক ভারসাম্যহীন মিউট্যান্ট আবার কখনো লোগানের ফাদারফিগার হিসেবে অনবদ্য অভিনয় করেছেন। মুভির একমাত্র কমিক রিলিফও তিনি। ১২ বছর বয়সী ড্যাফনি কিন জানেও না হয়তো তার জন্মের আগে থেকে শুরু হওয়া সিরিজকে সে কোন উচ্চতায় নিয়ে গেছে তার অভিনয় আর একশন দিয়ে।
নির্দেশক জেমস ম্যানগোল্ডের কথা আলাদা করে বলতেই হবে। ট্রেইলার দেখে আন্দাজ করেছিলাম যে তিনি আলবৎ আগাগোড়া বাস্তবিক মুভি বানানোর চেষ্টা করবেন। মিউট্যান্ট সুপারহিরোদের হিউমানাইজ করতে এর বিকল্প নেই। কিন্তু তার সফলতা নিয়ে সত্যি সত্যি সন্দিহান ছিলাম। কিন্তু সেই সন্দেহ তিনি দূর করেছেন তো বটেই, পাশাপাশি তার কাজের শুভাকাঙ্ক্ষী বানিয়ে ছেড়েছেন। 3:10 to Yuma তে ম্যানগোল্ড দেখিয়েছিলেন ছেলের সামনে এক বাবার নিজেকে প্রমাণের চেষ্টা কতোটা নিদারুণ হতে পারে। কতোটা মানবিক হতে পারে সম্পর্কগুলো। লোগানেও সম্পর্করা মানবিক, মানবিক শক্তি মিউটেটেড শক্তিকে ওভারল্যাপ করেছে এই মুভিতে বহুবার। এই মানবিকতাই লোগানকে অমরত্ব দিয়েছে দর্শকদের হৃদয়ে। কোন এডামেন্টিয়াম বা ভাইব্রেনিয়ামের নখর আঁচড় কাটতে পারবে না সে জায়গায়। লোগান ছিল, আছে, থাকবে সঙ্গোপনে আমাদের মানসপটে।
মৃত্যুকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম বারবার।
পারি নি জীবনকে ভালোবাসি বলে।
আজ জীবনকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে বুঝলাম,
মৃত্যুই আমার আজন্ম ভালোবাসা।
লেখকঃ মেহেদী হাসান মুন। ক্রিয়েটিভ অর্গানাইজার ও কন্টেন্ট ডেভেলপার, রকমারি কম