হলের দেয়ালে ধুপধাপ করার চিরায়ত রুটিনে বিরক্তি ধরে গেছিল। কেমন যেন একটা দম আটকানো অনুভুতি। একটু হাফ ছাড়ার জন্য কোলাহল ছেড়ে দূরে কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন। ১০–১২ জন থেকে কমতে কমতে শেষ পর্যন্ত ৬জনে এসে দাঁড়াল দক্ষিণ বাংলা অভিযাত্রী দলের সদস্য সংখ্যা। গন্তব্য– সাগরকন্যা কুয়াকাটা।
পরিকল্পনার শুরুতেই দেখা দিল গণ্ডগোল। বাস মালিক সমিতি অবরোধ ডেকেছে, তাও আবার অনির্দিষ্টকাল। এদিকে আমরা আবার সপ্তাহান্তের বাইরে একদিনের বেশী খরচ করতে পারবনা। কোয়ি বাত নেহি– হোক বাস বন্ধ, পানিতে তো আর অবরোধ নেই। কুয়াকাটাই যেতে হবে এমন তো কোন কথা নেই। নিয়াতগুনে বরকত, আমরা চাই ঝঞ্ঝাট থেকে সাময়িক মুক্তি।
বিকল্প হিসেবে কাছাকাছি জায়গা খোঁজখবর করতে জানা গেল সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জের কথা। গুগল বলছে, এটা নাকি সুন্দরবনের একমাত্র প্রবেশপথ যেখানে পুরোটাই সড়কপথে যাওয়া সম্ভব। সেখানেই আমরা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম লঞ্চে। লঞ্চ ছাড়বে খুলনা বিআইডব্লিউটিএ লঞ্চঘাট থেকে রাত দশটায়।
এক কেবিনে দুজন থাকার ব্যবস্থা, তাই ছ’জন তিনখানা কেবিন নেয়া হলো। কেবিনে ঢুকে দেখি দুজন ঘুমানোর মত যথেষ্ট বড় একখানা খাট আছে। তারপর– কেবিন শেষ। আমাদের কোন সমস্যা নেই, কারন লঞ্চের কেবিনে ঘুমিয়ে রাত পার করার বান্দা আমরা নই। ব্যাগ ব্যাগেজ রেখে, জুতো মোজা খুলে শর্টস আর স্লিপার পরে টপ ডেকে বসে তারা গুনতে লেগে পড়লাম। এক হাজার আটশ উননব্বইটা তারা গোনার পর সিদ্ধান্ত হল, যথেষ্ট হয়েছে। এবার একটু চা বিস্কুট খাওয়া দরকার। নাজমুল চা খেতে যাওয়ার জন্য শর্ত দিল– তাইলে ভাই চা খেয়ে এসে জাহাজ চালানোর জন্য কিভাবে তারা দেখে পথ ঠিক করা হয় সে রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে। সে বিদ্যা শেখানোর ভার নিজের কাধে নিয়ে দোতলার দোকানে এসে চা খাওয়া হল।
যত কুয়াশাই থাক, আকাশে চাঁদ–তারা থাকুক চাই না থাকুক, নদীতে বোধ করি কখনই ঘোর অন্ধকার নামেনা। তারাভরা আকাশের নিচে আবছা অন্ধকারে লঞ্চের ডেকে অনায়াসে রাতের পর রাত পার করে দেয়া যায়। সেই সাথে যদি সংগ হয় উপভোগ্য, সময় কাটে আলোর গতিতে।
আমাদের সঙ্গী হিসেবে ছিল শাওমি এমআই ব্লুটুথ স্পীকার।
পরের দুদিন ধকল যাবে, তাই কেবিনে গিয়ে একদফা ঘুমিয়ে নিলাম। পরদিন সকালে লঞ্চ ভিড়ল ডাবুরা ঘাটে। সেখান থেকে ভাড়ার মোটরসাইকেলে নীলডুমুর খেয়াঘাট। ট্রলারে নদী পার হয়ে অন্যপারে বুড়িগোয়ালিনী ঘাট।
ট্যুরিস্টদের জন্য থাকার জায়গা মূলত দুটো। একটা বরসা রিসোর্ট অন্যটা সুশীলন টাইগার পয়েন্ট রেস্ট হাউজ। আমরা উঠলাম বরসা রিসোর্টে। পরিপাটি ঝকঝকে রুম, স্টাফদের বিনীত ব্যবহার আর সুস্বাদু খাবার– সব মিলিয়ে দারুন অভিজ্ঞতা। বরসার উঠোনে দোলনা আছে, বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্য স্লীপার আছে। দারুণ সুন্দর একটা বাঁধানো ঘাঁটওয়ালা পুকুর আছে যেখানে সাদা মাছের চাষ করা হয়। আর হ্যা, সাতক্ষীরা যদি যান কেউ– গলদা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি, নদীর মাছ আর কাঁকরা চেখে দেখতে ভুলবেন না।
রুমে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে বেরলাম উদরপূর্তির লক্ষ্যে। বর্ষা রিসোর্ট থেকে দশ মিনিটের হাটা দূরত্বে মুন্সিগঞ্জ বাজার। সেখানে ঝুপড়ি টাইপ হোটেলগুলোতে মিলবে মুরগী ,গরু, বিভিন্ন ধরনের চিংড়ি আর কাঁকড়া।
আমাদের সবকজনের মধ্যে একটা জিনিস কমন, আমরা মানুষ দেখতে ভালবাসি। এখানকার মানুষের সংগ উপভোগ্য। শহুরে জটিলতা আর কুটিলতা গ্রাস করতে পারেনি সহজ সরল মানুষগুলোকে। নিষ্পাপ সরলতা আর অতিথিপরায়ণতায় মুগ্ধ করবে তারা আপনাকে। আমি চায়ের দোকানে বসে হেডফোনে গান শুনছিলাম। এক মুরব্বি এসে প্রশ্ন করলেন, ‘বাবা, আপনি কি ডাক্তার?’ অনেক কষ্টে তাকে বোঝাতে সক্ষম হলম এটা হল মানুষ যাতে মানুষের সাথে মিশতে না পারে, সেজন্য তাকে একঘরে রাখার একটা ষড়যন্ত্র আধুনিক বিজ্ঞানের। আমার কথাবার্তায় তিনি বুঝলেন– ‘এবেটা শহর থেকে আসছে, মাথায় হালকা ডিষ্টার্ব আছে।‘
দুপুরের খাওয়ার পর গোটা বিকেলটাই কাটালাম মুন্সিগঞ্জ বাজারে লোকের সাথে গল্প করে। আমাদের অনর্গল কথা আর বোকা বোকা কৌতূহলগুলো তারা খুশিমনেই মেটাচ্ছিলেন।
সন্ধ্যার আগে আগে ফিরে এলাম বরসা রিসোর্টে। একটু ঝিমিয়ে, গান শুনে কিছুক্ষন কাটল। রাতের খাবারের অর্ডার দেয়া ছিল, ঝটপট খেয়ে নিলাম। খাওয়ার পর উঠোনে ছটা দোলনা দখল করে দুলতে শুরু করলাম ছজন। সঙ্গী শাওমি ব্লুটুথ স্পীকার ক্লান্তিহীন গেয়ে চলেছে জলের গান।
বিপত্তিটা বাধল আমি জলের গানের সাথে সুর মেলাতেই। শিল্পী হিসেবে এমনিতেই আমার যথেষ্ট কুখ্যাতি রয়েছে, এই সুন্দর পরিবেশে সেটা জঘন্য রকমের বড় একটা খুত হিসেবে দেখা দিল। ক্ষেপে গিয়ে নাজমুল একটা কবিতা লিখে ফেলল।
যখন রিসোর্ট শুন্য
নেই কোন গেস্ট অন্য,
আমি রাজা বলে গন্য,
সবাই বলে ধন্য ধন্য।।
সাগর আমার সেনাপতি,
বুদ্ধিমান ছেলে অতি,
সোহেল মারছে ফাপর,
শালা একটা মীর জাফর।
রাজ্যের একমাত্র অদম্য পাজী,
সে আবার মহামান্য কাজী।
সহিদ ব্যাটার ক্যাবলা হাসি
যেন আস্ত একটা চাপরাশি।
মাহফুজ ভাই এর কথা ছাড়,
অসহ্য এক গোপাল ভাঁড়।।
কিছুক্ষন উঠোনে কিছুক্ষন ছাদে কিছুক্ষন পুকুরপাড়ে, এভাবেই কাটল অলস সময়টুকু। ঝঞ্ঝাট থেকে পালিয়ে আসা লোকের কাছে এই মুহূর্তগুলোই সেরা, এই সময়টুকুর জন্যই পালিয়ে আসা।
সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে আমাদের প্রথম লক্ষ্য সুন্দরবন দেখতে কলাগাছি যাওয়া। আবার মুন্সিগঞ্জ বাজারে গিয়ে নাশতা করে নিলাম, সেখান থেকে ভাড়ার মোটরসাইকেলে আবার বুড়িগোয়ালিনী ঘাঁট। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যেতে হবে কলাগাছি। ঠকার কোন সম্ভাবনা নেই, নৌকার ভাড়া নির্ধারিত। কলাগাছি ৪০—৫ মিনিটের পথ। বনবিভাগের অনুমতি নেয়ার আনুষ্ঠানিকতা সেরে সাড়ে দশটার দিকে আমরা রওনা হলাম।
ঘাটে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালো একদল আমুদে বানর। সত্যি বলতে কি, বানরগুলো ভয়ানক বাঁদর। আমাদের কাছে ক্যামেরা দেখে তারা একেকজন বিভিন্ন রকম পোজ দিয়ে ক্যামেরার সামনে দাড়াতে লাগল ছবি তোলার জন্য। বানর অনুকরণপ্রিয় প্রাণী, বোধ হয় এখানে আসা পর্যটকদের দেখেই এইসব অঙ্গভঙ্গি শিখেছে তারা। তবে আপনার কাছে চিপ্স বা কলা থাকলে সাবধান থাকবেন। মানুষের দেখা নিয়মিত পায় বলে দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে ওরা। দলবেঁধে যদি আপনাকে আক্রমন করে, নাজেহাল করে ছাড়বে একেবারে। আমাদের সামনেই এক ভদ্রলোককে দেখলাম চিপসের প্যাকেট নিয়ে বিপত্তিতে পড়তে।
জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাটার জন্য কাঠের সেতু তৈরি করা হয়েছে। সেতুর শেষ মাথায় একটি ওয়াচ টাওয়ার। পাঁচতলা সমান টাওয়ারের উপর থেকে এক নিমেষে দেখতে পারবেন বহুদূর পর্যন্ত। কলাগাছি পয়েন্টের বিশেষত্ব হল, বানর চোখে পড়বে যত্রতত্র। মানুষ দেখে ভয়ে একেবারেই পালাবেনা ওরা।
সুন্দরবন দেখার কৌতূহল মিটে গেল ঘন্টাখানেকের ঘোরাঘুরিতেই। ট্রলারে করে প্রত্যাবর্তন বুড়ি গোয়ালিনী ঘাটে, মধ্যাহ্নভোজন এবং আশ্রয়ে ফিরে আসা। ফ্রেশ হয়ে একটু জিরিয়ে নিয়ে দেখতে গেলাম আকাশলীনা ইকো ট্যুরিজম পার্ক।
রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে মুন্সীগঞ্জ বাজারের আগে হাতের বামে পড়বে আকাশলীনা। অনেকটা সুন্দরবনের আদলে তৈরি করা হয়েছে এই পার্কটি। যদিও সুন্দরবন দর্শনের তৃষ্ণা মেটাতে চাইলে এখানে না যাওয়াই ভাল। মূলত বিভিন্ন স্কুল-কলেজের পিকনিকের জন্য বরাদ্দ থাকে জায়গাটি। সুন্দর সাজানো গোছানো জায়গা, সারাক্ষন লোকে গমগম করছে। আকাশলীনার মূল আকর্ষণ এর ভিতরকার ফিশ মিউজিয়াম। এখানকার ফিশ মিউজিয়ামে সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলোতে পাওয়া যায় এমন পঞ্চাশটিরও বেশী প্রজাতির মাছের নমুনা। কপালমন্দ, ছুটির দিন হওয়াতে ফিশ মিউজিয়াম দেখার কৌতূহল জানালা দিয়ে উকি দিয়েই মেটাতে হল।
সাতক্ষীরা ভ্রমনের ষোলকলা আমাদের পূর্ণ হয়েছে বলা যায়। ঝঞ্ঝাট থেকে দূরে দুটি দিন কাটল, এক ঝলক সুন্দরবন দেখা হল সেই সাথে মিলল নতুন লোকের সান্নিধ্য। উপরি পাওয়া হিসেবে স্থানীয় খাবার চেখে দেখার সুযোগ মিলেছে। সফল অভিযান শেষে এবার ফেরার পালা।
গিয়েছিলাম পানিপথে, ফিরলাম সড়কপথে। সড়কপথে ফেরার গল্পে কোন মজা নেই। মুন্সীগঞ্জ থেকে বাসে কালীগঞ্জ, সেখান থেকে বাস বদলে সাতক্ষীরা অতঃপর খুলনার বাস ধরে খুলনা প্রত্যাবর্তন। দুদিনের ছোটখাটো ভ্রমন শেষে ফুরফুরে মেজাজে আবার ফিরে এলাম দেয়ালে সিগন্যাল দেয়ার খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কিভাবে যাবেন
খুলনা থেকে মুন্সীগঞ্জ যেতে পারেন দুভাবে-সড়কপথে অথবা পানিপথে। সড়কপথে গেলে সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে উঠবেন সাতক্ষীরার বাসে। খুলনা থেকে সাতক্ষীরার ভাড়া ৯৫ টাকা, সময় লাগবে আনুমানিক ২ ঘণ্টা। সেখান থেকে কালীগঞ্জের বাসে সময় লাগবে এক ঘণ্টার মত, ভাড়া ৪৫ টাকা। শেষ একবার বাস বদলে ৫০ মিনিটে পৌঁছে যাবেন মুন্সীগঞ্জ, এদফা ভাড়া লাগবে আরও ৬০ টাকা। মুন্সিগঞ্জ বাজার থেকে বরসা রিসোর্টে ইজিবাইকে মাথাপিছু ভাড়া ৫ টাকা। বুড়িগোয়ালিনী ঘাটে বাজার থেকে যাবেন ভাড়ার মোটরসাইকেলে, দুজন ৫০ টাকা।
পানিপথে যেতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে খুলনা বিআইডব্লিউটিএ লঞ্চঘাটে। সেখান থেকে ডাবুরাগামী লঞ্চে উঠবেন। ডাবুরার লঞ্চে কেবিন ভাড়া ৬০০ টাকা, দুজন থাকতে পারবেন। এছাড়া ডেকের ভাড়া ১৪০ এবং চেয়ারের ভাড়া ১৮০ টাকা। রাত দশটার লঞ্চে উঠলে সকাল ৯টার দিকে পৌছাবেন ডাবুরা ঘাটে। সেখান থেকে প্রতি মোটরসাইকেল ১০০ টাকা হিসেবে ভাড়া করে যাবেন নীলুডুমুর খেয়াঘাটে। ট্রলারে পার হয়ে অপরপাড়ে বুড়িগোয়ালিনী ঘাট। সেখান থেকে বাকী পথের নির্দেশনা আগেই দেয়া হয়েছে।
কোথায় থাকবেনঃ বেড়াতে আসা মানুষের জন্য মুন্সীগঞ্জে থাকার জায়গা মূলত দুটি। বরসা রিসোর্ট আর সুশীলন টাইগার পয়েন্ট রেস্ট হাউস। বরসা রিসোর্টে দুজন থাকার উপযোগী নন এসি রুমের ভাড়া ১০০০ টাকা প্রতি রাত, সাথে ভ্যাট যোগ হবে। এসি রুমের ভাড়া ১৫০০ টাকা। আর সুশীলন টাইগার পয়েন্টে নন এসি রুম ভাড়া ১৪০০ এবং এসি রুম ভাড়া ২১০০ টাকা। এখানে রয়েছে আট বেডের দুইটি ডরমিটরি। প্রতি সিটের ভাড়া ভ্যাটসহ ৩১৭ টাকা। দুই জায়গাতেই খাবার মিলবে প্রি অর্ডারের ভিত্তিতে।
সুন্দরবন দেখার জন্য এখানে আপনাকে ঢুকতে হবে কলাগাছি পয়েন্ট থেকে। বুড়িগোয়ালীনি ঘাঁট থেকে ১৫—২০জন যাওয়ার উপযোগী একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকার কলাগাছি যাওয়া আসার ভাড়া ১০০০ টাকা, মাথা পিছু বনবিভাগের অনুমতি ফি ২৩ টাকা। এছাড়া প্রতি নৌকার ভ্রমনপাস ২৩০ টাকা, যা যাত্রীকেই বহন করতে হবে। আপনার সাথে ক্যামেরা থাকলে ক্যামেরা পাসের জন্য গুনতে হবে অতিরিক্ত ২০০ টাকা।
এই ছিল আমাদের সংক্ষিপ্ত মুন্সীগঞ্জ ভ্রমনের কাহিনী। কেমন লাগল পাঠকের?
লেখকঃ মাহফুজুর রহমান। ভার্সিটির হলে থাকি আর পাশের রুমের সাথে দেয়ালে বাড়ি দিয়ে সিগ্ন্যাল বিনিময় করি। কোন দু:খে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়তে এসেছিলাম জানিনা। ভালবাসি ক্লাসের বই বাদে যেকোনো লেখা পড়তে আর আবোলতাবোল লিখতে। খোঁড়া কৌতুকের আজীবন রাজা হিসেবে আত্মস্বীকৃত।