বিংশ শতাব্দীর শুরুর ভাগে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার মাঝখানে গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে যে ছোট ছোট আন্দোলন গুলো ভারতবর্ষের মানুষগুলোকে একত্রিত হতে সাহায্য করেছে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বইপত্র না ঘাঁটলে এসকল আন্দোলনের অধিকাংশই জানাশোনার আড়ালে রয়ে যায়। মধ্যযুগীয় সামন্তবাদী আমলের একটি অর্থনৈতিক সামাজিক ব্যবস্থাকে ঘিরে তৎকালীন সিলেট ও এর পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহের তেমনই একটি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে মূলত “নানকার বিদ্রোহ” নামে, যা পরবর্তীতে স্বাধীন ভারতবর্ষের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে গরীব কৃষক শ্রেণীর বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণে অগ্রদূতের ন্যায় কাজ করে।
যেহেতু বিদ্রোহের ঘটনাক্ষেত্র সিলেট, তাই সিলেট জেলায় নানকার শব্দটির সাথে পরিচিতি থাকলেও বাকি জেলায় তেমন নয়। নান বা ‘রুটি’ থেকেই নানকার শব্দের উৎপত্তি। রুটি দিয়ে যে লোক রাখা হয় তাকেই নানকার বলে। এর অন্যান্য প্রতিশব্দগুলো হচ্ছে, বেগার প্রথা, চাকরান প্রথা ইত্যাদি। সেকালে জমিদারগণ একখণ্ড জমি বরাদ্দ করে নানকারের খোরাক যোগানোর দায়িত্ব শেষ করে ফেলত। জমিই আসলে রুটির অর্থ বহন করত। নানকারকে ক্ষুদ্র একটি ভিটাসহ দু’চার বিঘা জমি বরাদ্দ করা হত। জমি থাকলেই জীবিকা নির্বাহ করা যায়, এটিই ছিল সামন্তবাদী যুগের বিশ্বাস। কিন্তু খোরাকি উৎপাদনে যে শ্রম শক্তি ব্যয় হত তা ছিল মূল্যহীন এভাবে নানকারকে যে জমি বরাদ্দ করা হত, তা হচ্ছে নান (রুটির জন্য) জমি। তাকে খানে (খাবার জন্য) বাড়িও বলা হত। এই ‘নানজমি’ বা ‘খানেবাড়ি’ ভোগ করার পরিবর্তে নানকারদের জমিদারের প্রয়োজনে অনির্দিষ্ট পরিমাণে তার শ্রমশক্তি ব্যয় করতে হত। জমিদার যখনই তার প্রয়োজনানুসারে ডাকত, সশরীরে উপস্থিত হয়ে নানকার হুকুম তামিল করতে বাধ্য ছিল। বিনা মজুরির এই খাটুনিকে বলা হত ‘হদ’ বা ‘বেগারি ‘। একদিকে নানজমি আরেকদিকে বেগারি, এছাড়া নানকার প্রথার কোন প্রান্তে অন্য আর কিছুর আদান প্রদান ছিল না। নানকাররা জমিদারদের প্রজা হিসেবে পরিগণিত হত, খানেবাড়ির প্রজা, হদুয়া প্রজা, বেগার প্রজা, চাকরান প্রজা নানকারদের এসকল নামেই ভূষিত করা হত।
নানকার জমির ক্রয় বিক্রয়, হস্তান্তর, বন্ধকী কোন কিছুই প্রজাদের অধীনে ছিল না। এমনকি স্থায়ী ফল ফসলের বাগানও তাদের অধিকারে ছিল না। জমিতে কোন বড় আকারে গাছ বা মূল্যবান কাঠ উৎপন্ন হলে তা ছিল জমিদারের অধিকারে। অথচ গাছ রোপণ, রক্ষণাবেক্ষণ এমনকি যথাসময়ে ফল আহরণ করে তা জমিদারবাড়িতে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব ও ছিল নানকার প্রজার। প্রজার অধিকার ছিল কেবল ভিটের মাটিতে। ধান, ডাল, তামাক, তরিতরকারি প্রভৃতি মৌসুমি ফসলের উপর নির্ভর করেই তাকে বেঁচে থাকতে হত। অথচ বিনিময়ে তাকে যে মূল্য দিতে হত, তার সীমানা নির্ধারিত ছিল না। কেউ যদি বিনিময় মূল্য দিতে অস্বীকার করত তার কপালে বরাদ্দ ছিল ভয়াবহ সব শাস্তি। দুটি আস্ত বাঁশের ফাঁকে বা তক্তার তলায় হাত, পা বা আস্ত দেহটা ফেলে দুপাশে চেপে চেপে নাকেমুখে রক্ত বের করা, ছিল অন্যতম। এসব কিছুর মধ্যে কদর্যতম অত্যাচার ছিল জমিদারগণের লাম্পট্য চরিতার্থ করা। স্পষ্টতই নানকার প্রজাদের ঝি বেটিরা সুরক্ষিত ছিল না। কোন জমিদার যেঁ কোন মুহূর্তে তলব করলেই মেয়েদের যেতে হত। নানকার রমণীরা বিনামূল্যে বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণে বাধ্য হয়েছিল। চরিত্রহীনতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তৎকালীন সমাজে একটি সাধারণ ব্যাপার। এ কদর্যতার আবেশ নানকার সমাজকেও প্রভাবিত করেছিল। এ অসহনীয় অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবার পথ খুঁজে পেতেই প্রথম বিদ্রোহের সূচনা হয়। অসম সাহসিকতার বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা এ সময় “ইতরজনের কাহিনী” বলে ভদ্রসমাজে উপেক্ষিত ছিল। তেমনি একটি ঘটনা লোকমুখে অনেক শোনা যায়।
বাহাদুরপুর জমিদার রইছ মিয়া তার নানকার প্রজা মথুরা ধূপীকে তুচ্ছ এক কারণে জুতাপেটা করলে লাঞ্ছিত প্রজা চুপচাপ কাছারি থেকে বের হয়ে যান। কিন্তু অন্তরে তার প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে থাকে। দেখা যায়, জমিদার কাজকর্ম সেরে আহার ও নিদ্রাশেষে বিকেলবেলায় দিঘির পাড়ে কাছারিবাড়ির বারান্দায় আরামকেদারায় শুয়ে হাওয়া খায়। ও সময় তার কাছে চাকরবাকর কেউ থাকে না। যদিও জমিদারের হাকে ডাকে তৎক্ষণাৎ কেউ ছুটে আসার শঙ্কা অজানা নয় তবুও মথুরা সাহস সঞ্চয় করে পরিকল্পনা করে। একদিন সন্ধ্যাবেলা জমিদার উঠি উঠি করছে, এমন সময় আড়াল থেকে ছুটে এসে সে জমিদারেরই জুতাজোড়া হাতে নিয়ে তাকে অকস্মাৎ দু গালে পটাপট আঘাত করে বসল। বিরামহীন ভাবে তারপর সে তার চাষাড়ে হাতের পাদুকাঘাতে জমিদারকে জর্জরিত করে আহত অবস্থায় কাছারি বারান্দায় ফেলে রেখে যায়। পরবর্তীতে জমিদারেরে জ্ঞান ফিরলে আততায়ীকে ধরে আনবার জন্য লোক ছুটলে গিয়ে দেখা যায় মথুরা ধূপী তার পরিবার শুদ্ধ হাওয়া।
নানকার বিদ্রোহের প্রথম রোষাগ্নি প্রজ্বলিত হয় সুখাইড় গ্রামের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সে গ্রামের জমিদার পরিবারের কারণে গোটা গ্রামটা লাম্পট্যের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। গ্রামের এক নানকার রমণীর প্রতি একদিন জমিদারের চোখ পড়ে এবং তাকে সে ডেকে পাঠায়। রমণীটি চিরাচরিত প্রথামত ছুটে না গিয়ে জমিদারের লোককে সেদিন আচ্ছামত দু কথা শুনিয়ে দেয়। প্রতিক্রিয়া স্বরুপ অগ্নিশর্মা হয়ে জমিদার তার লোকবল নিয়ে রমনীটির ঘরে গিয়ে চড়াও হয়। টেনে হিচড়ে তাকে বাড়ি এনে আটক করে রাখে। একে তো এই বর্বর প্রথা নিয়ে গ্রামের মানুষ গুমড়ে মরছিল, তার উপর উক্ত ঘটনায় তাদের চাপা ক্রোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সকলে ক্ষেপে গিয়ে জমিদার বাড়িতে তাদের যাতায়াত ও কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়ে নিজেদের ভিটেমাটি আগলে বসে রইল। জমিদার নিজের গ্রামেই একদম কোণঠাসা হয়ে পড়ল। সুখাইড় গ্রামের নানকার প্রজাদের সূত্র ধরে পরবর্তীতে এ বিদ্রোহ সুনামগঞ্জ মহকুমা, সিলেট সদর মহকুমা এ সকল জায়গাতেও ছড়িয়ে পড়ে। ১৯২২ সালে শুরু হয়ে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত এ বিদ্রোহ চলে, তারপর জমিদারদের সমবেত আঘাতে এটি বিধ্বস্ত হয়ে যায়।
সাম্রাজ্যবাদী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে দরিদ্র কৃষকদের এটি ছিল কেবল সূচনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরো সংগঠিত ভাবে নানকার বিদ্রোহ আঘাত হানে।