বিশ্বজুড়ে এমন কিছু জায়গা রয়েছে যেগুলোর উপর দিয়ে বিমান উড়ে যেতে পারে না। কারণ এসব জায়গাগুলোতে হয় এমন সিভিলিয়ানরা থাকেন, যারা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পড়লে নিজেদের বাঁচানোর উপায় নেই। অথবা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে এরকম স্থানগুলোর উপর দিয়েও বিমান ওড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়। এর বাইরেও কোনো অনুষ্ঠান চলাকালীন, ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ এবং নিখুঁত ভূ-গঠন এর কোনো স্থান এর উপর দিয়ে বিমান চালনাও বন্ধ রাখা হয়। ‘নো ফ্লাই জোন’ এর ধারণাটা বলতে গেলে একেবারেই সাম্প্রতিক। পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধের পরপরই এই সর্বপ্রথম এই নিয়ম চালু হয় দেশে-দেশে। নিজ দেশের নিয়মের বাইরে গিয়ে কেউ বিমান চালালে সেই বিমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সার্বভৌমত্বের উপর হুমকি দেখা দিলে গানফায়ার ব্যবহার করে বিমানকে দিক পাল্টাতে বাধ্য করারও অধিকার রয়েছে সে দেশের। আজ জেনে নিই এমনই কিছু নো ফ্লাই জোন সম্পর্কে।
কাবা শরীফ
সম্প্রতি ইন্টারনেটে কাবার উপর দিয়ে কোনো বিমান কিংবা পাখি উড়তে না পারার একটি খবর ছড়িয়েছে! যুক্তি হিসেবে এটাকে পৃথিবীর মহাকর্ষ কেন্দ্র হওয়াকে তুলে ধরা হয়েছে। যার কারণে সৌদি বিমান উড়তে দিতে চায় না। কিন্তু এটা কেবলই একটা কল্পনা, কারণ হজ্জ মৌসুমে আকাশে হেলিকপ্টার ওড়ানো হয় হাজিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। তাহলে কেন মক্কা একটি নো ফ্লাই জোন?
মক্কা পাহাড়ি অঞ্চল হলেও এর আশপাশ সমভূমি দ্বারা বেষ্টিত। তাই বিমান চলাচলে এখানকার টোপোগ্রাফি কোনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। মূলত এখানে কোনো বিমানবন্দর না থাকাটাই এখান দিয়ে বিমান উড়তে না দেওয়ার বড় কারণ।
![](https://banglahub.com.bd/wp-content/uploads/2019/11/1_78591_02.jpg)
সবচেয়ে কাছের জেদ্দা বিমান বন্দরটি ১০০ কিলোমিটার দূরে। জেদ্দা থেকে মক্কাতে যাত্রীদের আসতে হলে প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হয়। তাছাড়া প্রতি বছর বন্যার কারণে এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা কিছুটা ব্যাহত হয়। তাই একটি বিমানবন্দর তৈরির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও তা এখনো অনুমোদন পায়নি। কতৃপক্ষ হয়তো মক্কার সার্বিক নিরাপত্তা এবং ঐতিহাসিক ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখার জন্যও এমনটা করতে পারেন।
তিব্বত
তিব্বত এশিয়ায় অবস্থিত এমন একটি এলাকা, যেটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু এলাকা হিসেবে ধরা হয়। হিসাব করলে এখানকার গড় উচ্চতা প্রায় ১৬০০০ ফুট। তিব্বতের সীমানা উঁচু সব পাহাড়-পর্বতে ঘেরা, যার কারণে বাণিজ্যিক বিমানগুলো যাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে আরো উপর দিয়ে উড়ে যায়। বিশেষ করে তারা পাহাড়ের উঁচু টিলাগুলো এড়িয়ে চলে। একটা কথা পাইলটদের মাথায় এলার্মের মতো ঘুরপাক খায়, ‘এখানে কখনো ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং নেই’। তাই পাইলটদের বিমান ওড়ানোর সময় যথেষ্ট দক্ষ আর চালাক হতে হয়। তিব্বত থেকে ছেড়ে যাওয়া বিমানগুলোর জন্য এমন রুট নির্ধারণ করা হয়, যাতে যাত্রাপথে আরও একটি এয়ারপোর্ট থাকে। এটা করার একমাত্র কারণ হলো, যেকোনো ইমার্জেন্সীতে বিমান যাতে তিব্বতের দিকে ফেরত না এসে মাঝপথে একটা অবলম্বন পায়।
ডিজনি থিম পার্ক
ফ্লোরিডা’র ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ড এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত ডিজনিল্যান্ডের উপর দিয়ে বিমান ওড়ানো নিষেধ করা হয়েছে। শুধুমাত্র ৩০০০ ফিট এর বেশি উচ্চতা দিয়ে উড়ে যাওয়ার শর্তেই কোনো বিমান এই রুট ব্যবহার করতে পারবে। থিম পার্ককে ঘিরে প্রায় ৩ মাইল পর্যন্ত জায়গাজুড়ে এই নো ফ্লাই জোন গড়ে তোলা হয়েছে। এর ফলে থিম পার্কটি বিশেষ এক মর্যাদার জায়গা হিসেবে স্বীকৃতি পেল, যা বহু ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
![blank](https://banglahub.com.bd/wp-content/plugins/wp-fastest-cache-premium/pro/images/blank.gif)
প্রতি বছর দেশ-বিদেশ থেকে হাজার-হাজার দর্শনার্থী এখানে এসে ভিড় করেন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে জঙ্গি হামলা হওয়ার পরপরই থিম পার্কটিকে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে এতোগুলো মানুষের জীবন সংকটাপন্ন না হয়ে পড়ে। যদিও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতে, এটা থিম পার্কেরই কারসাজি যাতে এখানকার আকাশ অন্য কেউ বিজ্ঞাপণের জন্য ব্যবহার না করতে পারে। কারণ প্রায় সমান জনপ্রিয় হওয়া স্বত্ত্বেও নটসের বেরি ফার্মকে সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। সেই যাই হোক, ডিজনি কিন্তু নিজেরাও নিজেদের এলাকায় এক দিক দিয়ে ফাঁদে পড়ে গেছে। নো ফ্লাই জোন হওয়ার কারণে তারা তাদের আকাশে ড্রোনও ওড়াতে পারেনা!
তাজ মহল
তাজমহল কেবল ইন্ডিয়ান কোনো অনন্য স্থাপত্য নিদর্শন নয়, বরং এটা বিশ্ববাসীরই এক সম্পদে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীতে মানব সভ্যতার উৎকর্ষতার উদাহরণ হিসেবে যত নিদর্শন আছে তার মাঝে তাজমহলও একটি। তাই এই স্থাপনাটি এবং এর আশপাশের এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি একটি কাজ। হোয়াইট হাউজ কিংবা বাকিংহাম প্যালেসের উপর দিয়ে যেমন কোনো কিছু উড়িয়ে নেওয়া নিষেধ, তেমনি তাজমহল এর উপর দিয়েও কোনো কিছু উড়িয়ে নেওয়া নিষিদ্ধ।
![blank](https://banglahub.com.bd/wp-content/plugins/wp-fastest-cache-premium/pro/images/blank.gif)
ইতিহাস থেকে জানা যায়, স্ত্রী মমতাজের প্রতি মুঘল সম্রাট শাহজাহানের ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে এই বিশাল দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা তৈরি করা হয়। যদিও এটা তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে বিতর্কের ফলে এটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এতোটুকুও কমে যায়নি। ইন্ডিয়ান সরকার ২০০৬ সালে এই স্থাপনাটির উপর দিয়ে যেকোনো ধরণের বিমান উড়ে যাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষিত করে। উল্লেখ্য, প্রতি বছর বিভিন্ন দেশের হাজার-হাজার দর্শনার্থী এখানে এসে ভিড় জমান তাজমহলকে একপলক দেখার জন্য। সারাবছর কর্মচঞ্চল থাকা তাজমহল তাই ইন্ডিয়ার বৈদেশিক আয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।
মাচু পিচু
তাজমহল যে বছর ‘নো ফ্লাই জোন’ হলো, সেই ২০০৬ সালেই আরেকটি ঐতিহাসিক নিদর্শন এর উপর দিয়ে যেকোনো ধরণের বিমান চালানো নিষিদ্ধ করা হয়। ইতিহাস সম্পর্কে জানেন আর ‘মাচু পিচু’ এর নাম শোনেননি এমন মানুষ হয় না! এখানকার ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে পেরু সরকার তাই এটাকে নো ফ্লাই জোন হিসেবে ঘোষণা দেয়। এই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য এবং ইনকা সভ্যতার পরিচয় বহন করা এই স্থানটি ইউনেস্কোর ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের’ তালিকাভুক্ত, তাছাড়া পেরু সরকারও মাচু পিচুকে ঐতিহাসিক গবেষণার অভয়ারণ্য হিসেবে সম্মানিত করেছে। ইতিহাস ভালোবাসেন এমন ভ্রমণপিপাসুরা প্রতি বছর নিজেদের কৌতূহল মেটাতে এখানে ঘুরতে আসেন। ভ্রমণ থেকে পেরু নিজেদের বৈদেশিক আয়ের বড় একটা অংশ উপার্জন করে, এটাও স্থানটির গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার একটি কারণ। এটার ঐতিহাসিক গুরুত্বের পাশাপাশি বন্যপ্রাণীদের অভয়ারণ্য হিসেবেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বন্যপ্রাণীগুলোর ভেতর কিছু প্রজাতি পৃথিবীতে আজ প্রায় বিপন্ন।
Featured Image: mentalfloss.com