রাজধানী ঢাকা এবং ঢাকার প্রতিবেশী চারটি জেলা- নারায়ণগঞ্জ, গাজিপুর, নরসিংদী এবং মানিকগঞ্জের কিছু গল্প বলবো। ঢাকার বেশ কিছু জায়গা এবং ঢাকা থেকে এই চার জেলায় যাওয়ার পথে যে জিনিস অবশ্যম্ভাবী- তা হলো একটা বিশাল এলাকাজুড়ে পড়ে থাকা পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য। ধরুন, আপনি খুব চমৎকার মনোভাব নিয়ে ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাচ্ছেন। হঠাৎ করেই একটা তীব্র কটু গন্ধ আপনার নাকে এসে ধাক্কা মারবে। নাকটা চেপে ধরে আপনি অবাক হয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখবেন, প্রায় কয়েক কাঠা জায়গার উপর একটা ডাস্টবিন। এই চারটি জেলা শিল্প এলাকা হওয়ায়, মোটামুটি বেশ কয়েকটা জায়গাতেই এই জিনিস পাবেন। এটা দেখে আপনার ভাবনায় কী কী আসে?
আপনারটা আপনি বলবেন, আমারটা আমি বলি। এই ব্যাপারটা কয়েক বছর ধরে খেয়াল করছি। গত এক বছর ধরে নারায়ণগঞ্জ থাকার দরুণ নারায়ণগঞ্জের ডাস্টবিনটার নিদারুণ দুর্গন্ধ নিত্যদিন সহ্য করতে হচ্ছে। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাবার পথে জালকুড়ি নামের একটা জায়গায় এই বিশাল ডাস্টবিনটা। নারায়ণগঞ্জ তো বটেই, ঢাকার দিকের বেশ কিছু এলাকার ময়লা এনে ফেলা হয় এইখানে। মজার ব্যাপার হলো, একটা সাইনবোর্ডে এও লেখা আছে, “এখানে ময়লা ফেলা নিষেধ।”
এই ময়লা না পচার প্রধান কারণ হলো, পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য। পচনশীল বর্জ্য হলে পরিবেশ দুষণের ক্ষেত্রে দৈনন্দিন ব্যবহৃত ময়লা কোনো ভূমিকাই পালন করতো না। বরং সেসব বর্জ্যে মাটি আরোও উর্বর হতো। অথচ এখন হচ্ছে উল্টোটা।
একজন ভ্রমণপিয়াসু হিসেবে আমি যে কাজটা খুব নিয়ম মেনে করি, তা হলো, ভ্রমণে গিয়ে যেখানে সেখানে ময়লা ফেলি না। নিজের ব্যবহৃত বর্জ্য নিজেই বয়ে আনি। সুযোগ পেলে লোকের ফেলে রেখে আসা অপচনশীল বর্জ্য পদার্থগুলো বয়ে নিয়ে আসি। এই কাজটা করার প্রধান কারণ হলো, আমাদের ভ্রমণস্থানগুলো পরিষ্কার রাখা। যাতে অন্যেরা জায়গাটায় গিয়ে চিপসের প্যাকেট আর কোকের বোতল দেখে মনে না করে, ‘আমি তো একটা ডাস্টবিনে বেড়াতে এসেছি!’
একই অভ্যাসটা প্রতিফলিত হচ্ছে আমার দৈনন্দিন কাজে। এখন আর রাস্তায় বেরুলে যেখানে সেখানে ময়লা ফেলি না।
কিন্তু সমীকরণটা তো সেই একই জায়গায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমার বাসার ময়লা কিংবা অন্য যেকোনো ডাস্টবিনের ময়লা তো সেই বিশালাকার ডাস্টবিনেই ফেলা হয়। সেখান থেকে তো মাটি দূষিতই হচ্ছে। আবার পুড়িয়ে ফেলতে গেলে হয়, বায়ু দূষণ। শত শত বছরেও পচে না যে জিনিস, সেটা কী করে পরিবেশ থেকে নিবৃত করা যাবে?
সমস্যা কেবল পরিবেশ দূষণ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশে প্লাস্টিক যে হারে ব্যবহৃত হচ্ছে তা জলাভূমিকে গিয়ে পড়ায়, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী খাবার মনে করে খেয়ে নিচ্ছে। তারপর মাছের মাধ্যমে তা মানুষের খাদ্য চক্রে ঢুকে পড়েছে। এতোদিন উদ্বেগ ছিল পরিবেশ এবং জীব বৈচিত্র্যের ওপর প্লাস্টিকের প্রভাব নিয়ে। কিন্তু এখন এটা মানুষের স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের দ্বারা পরিবেশ যেভাবে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার ফল কিন্তু আমরা ভোগ করছি প্রতিনিয়তই। এখন পর্যন্ত চরম আকারে না করলেও ভবিষ্যতে করবো। তাই এখনই সময় সচেষ্ট হবার।
প্রতিকার হিসেবে প্রথমেই আমার কাছে মনে হয়, প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে ফেলা। আমি নিজে দৈনন্দিন কাজে যতো কম প্লাস্টিক ব্যবহার করা যায়, সেই চেষ্টা করি। কিন্তু একজনের চেষ্টায় কতোটুকুই কী হয়?
প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষন কমাতে খালি প্লাস্টিক বোতল জমা দিয়ে দেওয়া যাবে বাস ভাড়া মওকুফ করার মতো উদ্যোগ নিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। দেশটির সুরাবাইয়া শহরে প্লাস্টিক বোতল বা কাপের বিনিময়ে চড়া যাচ্ছে পাবলিক বাসে। অন্যান্য আরোও অনেক দেশেই প্লাস্টিক বর্জ্যের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
ইন্দোনেশিয়া বা অন্যান্য দেশ এটা করতে পারলে আমরা কেন পারবো না? ইন্দোনেশিয়ার বাসগুলো দূর পাল্লার বাসে এই সুবিধা দিচ্ছে। আমাদের দূরপাল্লা লাগবে না, লোকাল বাসে এরকম সুবিধা দিলে ঢাকাতেই প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রকটতা কমে যাবে। দৈনন্দিন প্রয়োজনে পানি, কোমল পানীয় ও চা-কফির ব্যবহার্য বোতল আর কাপগুলো জমিয়ে যদি বাসভাড়া থেকে রেহাই পাওয়া যায়; তাহলে অনেকেই এগিয়ে আসবে। খালি ইন্দোনেশিয়ার উদাহরণ কেন টানছি? শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লাস্টিক বর্জ্যের ব্যাপারে একটা দারুণ ব্যবস্থা নিয়েছে মেজিস্ট্রেট বানসুরি। যেকোনো কোমল পানীয় কিংবা পানির খালি বোতল ফেরত দিলে দোকানদার ৫ টাকা ফেরত দেবে। দোকানদার যদি এই নিয়ম না মেনে চলে, তাহলে তাদের জন্য জরিমানারও ব্যবস্থা করেছে মেজিস্ট্রেট বানসুরি।
একটা সেক্টরে শুরু হয়েছে, বাকি সেক্টরগুলোতে হলেই হয়তো আমরা দূষণের হাত থেকে বাঁচবো।
বাংলাদেশে ২০০২ সালে বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন করা হয়েছিলো। সেই আইনের তোয়াক্কা আর কেউ এখন করছে না। প্রথম দুই তিন বছর সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ খুবই তৎপর ছিল এই আইনের বিরুদ্ধে। প্রায়ই বাজারে বাজারে অভিযান হতো, কিন্তু তারপর তা ধরে রাখা যায়নি। বাংলাদেশে এখন দিনে ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলার সানারপাড়ে একটা কারখানা দেখেছি, যেখানে পলিথিন রিসাইক্লিং করা হয়। হ্যাঁ, পলিথিন। প্লাস্টিকের বোতল নয়। প্লাস্টিক দ্রব্য রিসাইকল করার চেয়ে পলিথিন রিসাইক্লিং করাটা বেশি কঠিন। এটি যে কী কষ্টসাধ্য কাজ, আমি নিজের চোখে দেখেছি। ময়লা আবর্জনা থেকে পলিথিন আলাদা করার কাজটা করেন কিছু মহিলা। এদের প্রতি আমার খুব শ্রদ্ধা জাগে। এরা নিজেরাও জানেন না, কতোটা উপকার করছেন দেশের। তবে এই রিসাইক্লিংয়ের হার দেশের মোট পলিথিন উৎপাদনের তুলনায় খুবই নগণ্য। তাই পলিথিনের বিকল্প রাস্তা বের করা উচিত।
আমার মতে পলিথিনের খুব চমৎকার একটা বিকল্প হতে পারে বাংলার ঐতিহ্যবাহী সোনালি আঁশ দিয়ে বানানো চটের ব্যাগ। একসময় পাট থেকে বানানো এই চটের ব্যাগই ছিলো বহুল প্রচলিত। আবার সেই ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া যেতে পারে। এতে করে অর্থকরী ফসল হিসেবে পাট আবার জেগে উঠবে। পাটকলগুলোর দরজায় দেওয়া জংধরা তালায় হাতুড়ির আঘাত পড়বে। ফলে অনেক বেকারের হবে অন্নসংস্থান।
আসুন আমরা নিজেদের জায়গা থেকে সচেতন হই। দেশটা তো আমার, আপনার, আমাদের সকলেরই। তাই না?
Feature image source : মাদিহা মৌ