প্রিয় লেখকদের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন সাহিত্য নিয়ে তার এক্সপেরিমেন্টাল কাজগুলার জন্য অনেক আগেই। আর যখন তিনি এই বছর আমার প্রিয় “সাই ফাই” ও “থ্রিলার” জনরার সংমিশ্রণে একক বই প্রকাশ করেন, তখন তো সেটা আমার জন্য হয়ে ওঠে সোনায় সোহাগা।
হ্যাঁ কথা বলছি পলাতক-খ্যাত “সজল চৌধুরী”কে নিয়ে।
বই : পলাতক
লেখক : সজল চৌধুরী
কাহিনী সংক্ষেপ :
অবশেষে ধরা পড়ে গেছে একজন, যে আড়াই’শ বছর ধরে পলাতক। এখন ছিনিয়ে নেওয়া হবে যা তার ছিল। কী নিয়ে সে পালিয়েছিল? কেনই বা পালিয়েছিল? কোথায় পালিয়েছিল?
তনিমাই বা কেন মরিয়া হয়ে উঠলো, তার পূর্ব প্রজন্মদের দেওয়া কথা রাখার জন্য! সে কি পারবে সেই স্বপ্নপূরণ করতে?
হাইকিং করতে আসা ছেলেটি কে? কী তার উদ্দেশ্য। কেনই বা সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে লাগলো আজাদকে নিজের অজান্তে।
জাফতিন কি পারবে ভালোবাসার মানুষকে পেতে? নাকি পাওয়ার পরও হেরে যেতে হবে তাকে ভালোবাসার মানুষের জীবন থেকে?
ড. একরাম কিভাবে সফল হয়েছে তার গোপন পরিকল্পনায়! কতটুকুই বা সফল হয়েছে?
বায়োবট কি আসলেই শান্তি নিয়ে আসবে নাকি অশান্তি!
ক্রমে ক্রমে খোলাসা হয় অনেককিছু। জানা যায়, আসলে কে পলাতক। কিসের জন্য পলাতক। কার জন্য পলাতক। বেরিয়ে আসে এমন সব সত্য যা জানা ছিল না কারোই। উঠে আসে এমন কিছু যা করে দেয় স্তব্ধ।
সবকিছুর উত্তর ও ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে সজল চৌধুরী’র “পলাতক” বইটিতে। পাঠককে আমন্ত্রণ অদ্ভুত ও ভয়ঙ্কর সত্যের এক সাই ফাই থ্রিলারের জগতে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া :
শুরু থেকে কাহিনী খুব মসৃণভাবে চলেছে এবং সেটা একদম শেষ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। কোথাও দৌঁড় দেয়নি বা ঝুলে যায়নি। বেশ টানটান উত্তেজনাময় ছিল পুরো উপন্যাসটি। যতটা এক্সপেক্টেশন নিয়ে পড়তে বসছিলাম, হতাশ হইনি বরং এক্সপেক্টেশনের তুলনায় বেশিই পেয়েছি। বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে এমন কন্টেন্টগুলো রেখেছেন যে, ‘এর পরে কী হবে’ এটা জানার জন্যই পরের অধ্যায়ে যেতে হবে। অধ্যায়গুলোকে সংখ্যাভিত্তিক না করে প্রতিটির আলাদা আলাদা নাম দিয়েছেন সেই অধ্যায়ের মূল বিষয়ের ওপর। এই কাজটা খুব ভালো লেগেছে এবং এটি প্রতিটি অধ্যায়কে আগ্রহপূর্ণ করেছে। আরো আগ্রহ তৈরী করেছে লেখকের বৈচিত্র্যময় প্লট ও লেখনী। সাই ফাই হলেও থ্রিলার, সাসপেন্স, মিস্ট্রি, সায়েন্স, হিস্টোরি সবই আছে বইয়ে। রয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, ম্যাথস, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি ও আরো বিভিন্ন বিষয়।
লেখক সাহিত্যের বিভিন্ন দিকগুলো নিয়ে যে এক্সপ্রেরিমেন্ট করতে ভালোবাসেন, সেটা তিনি আগেই দেখিয়েছিলেন তার আগেকার অনলাইন ও অফলাইনের বিভিন্ন সংকলন ও ম্যাগাজিনের কাজগুলোর মাধ্যমে। এই বইতে সেটি আরো পাকাপোক্তভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন। বইটি লিখতে লেখককে যে কী পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়েছে সেটা ভাবার মত! এত এত ইনফোর মিশেলে এত অসাধারণ একটা উপন্যাস, যেই সেই কাজ না। দারুণ কাজ দেখিয়েছেন। অনেক অনেক তথ্য পেয়েছি পড়তে পড়তে, কিন্তু এত তথ্য ধারণ করতে একটুও ক্লান্তি আসেনি। অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলাম। বেশ কয়েকবার পড়ার ফাঁকে ফাঁকে গুগল, উইকি ও বিভিন্ন ব্লগে এবং বইতে লেখকের দেওয়া নির্ঘন্টের লিঙ্কগুলোতে ঢুঁ মেরেছি আরো বিস্তারিত জানার জন্য বিষয়গুলো।
প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায়, আমাদের পাঠকদের মধ্যে যারা সায়েন্স নিয়ে পড়াশুনা করেন তারাই সায়েন্স ফিকশনের টার্মগুলো বুঝতে পারেন, বাকি আর্টস ও কমার্সের স্টুডেন্টদের কাছে এসব টার্মসগুলো ‘ব্রেন্টের ওপুর দিয়ে যায়’। কিন্তু এই বইটির ক্ষেত্রে লেখক সেসব টার্মগুলোকে বিস্তারিতভাবে সবার বোঝার সুবিধার জন্য অনেক সহজভাবে ব্যবহার করেছেন। সেই সাথে আরো ভালো করে বোঝার সুবিধার্থে ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছবি। ছবির সংযুক্তির কারণে বিষয়গুলো আরো ভালোভাবে উপভোগ্য হয়ে ওঠেছে।
একেকবার একেক চরিত্রের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ঘটনাগুলোকে দেখিয়েছেন লেখক। এই বিষয়টি ভালো লেগেছে। বর্ণনাভঙ্গি অনেক বাস্তবিক ছিল, যার কারণে ঘটনাপ্রবাহগুলো নিজেই অনুভব করছিলাম। লেখক শুরু থেকে রহস্যের জাল যেভাবে ছড়িয়েছে, ঠিক সেভাবেই ধীরে ধীরে রহস্যের জাল গুটিয়েছেন। রহস্যের সমাধানের মাধ্যমে, বিষয়গুলো ব্যাখ্যার মাধ্যমে দারুণ তৃপ্তি দিতে পেরেছেন। কাহিনীর মাঝে ঢুকে গেলে শেষ করেই উঠতে হবে। বইয়ের ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট খুব ভালো লেগেছে। লেখক যে এই কাজটিতে খুব পটু, সেটি দেখিয়ে দিয়েছেন এই বইয়ের প্রতিটি চরিত্রের মধ্য দিয়ে। সবগুলো চরিত্রকে ভালো লেগেছে। মজা লেগেছে হেনা, রাশেদা, বাদল ও মজনুর “সবকিছু ব্রেন্টের ওপুর দিয়ে যাওয়া” ঘটনাগুলো। বইতে লেখককের পরবর্তি সিরিজ “সংক্রমণ”র একটি ক্যারেক্টারের ক্যামিও রেখেছেন, সেটিও ভালো লেগেছে।
কাহিনী এগিয়েছে মোট ১২টি টাইমলাইনে। নন-লিনিয়ার স্টোরিটেলিংয়ে চলেছে কাহিনী। লেখকের স্মুদ লেখনী আর ঘটনার বর্ণনায় একটুও খাপছাড়া লাগেনি কোথাও।
বইয়ের ঘটনাগুলোর প্রয়োজনে যেসব কবিতা, গান ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলা একদম যথাযথ ছিল, অনেক ভালো লেগেছে এবং সেগুলোর ভিন্নরকমের ফন্টের জন্য আরো বেশি ভালো লেগেছে।
প্রচ্ছদের ক্ষেত্রেও লেখল দারুণ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। বইয়ের প্রচ্ছদও লেখক নিজেই করেছেন। ভালো লেগেছে প্রচ্ছদটি।
বইয়ে অনেকগুলো চরিত্র-ঘটনা আলো-আঁধারিতে রেখেছেন লেখক সিরিজের পরবর্তি বইয়ের জন্য। লেখকের পরবর্তি বই “পলাতক ০.১”, এবং “সংক্রমণ ট্রিলজি” প্রকাশ হবে খুব শীঘ্রই। শুভকামনা রইলো লেখকের পরবর্তি বইয়ের জন্য।
এক নজরে…
বই : পলাতক
জনরা : সাই ফাই থ্রিলার
ক্যাটাগরি : মৌলিক সিরিজ
লেখক : সজল চৌধুরী
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৮
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১৯২ পৃষ্ঠা।
প্রকাশনী : ভূমিপ্রকাশ।
মুদ্রিত মূল্য : ২৩০৳ মাত্র।
প্রাপ্তিস্থান : ভূমিপ্রকাশ শো-রুম। রকমারি, বিবিধ শপ-সহ যেকোনো অনলাইন বুকশপ।
সাই ফাই ও থ্রিলারপ্রেমিদের জন্য হাইলি রিকমান্ডেড একটি বই। যারা পড়েননি তাদেরকে বইটি পড়ার আমন্ত্রণ রইলো।