গত কয়েকদিন বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনে সবচেয়ে বেশি আলোচিত নামটা মোহাম্মদ নাইম শেখ। ভারতের বিপক্ষে সিরিজেই নিজের জাত চিনিয়েছেন এই তরুণ ক্রিকেটার। ধারণা করা হচ্ছে, একজন নির্ভরযোগ্য উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই নাইমের পেশাদার ক্রিকেটে আসাটা বেশ দেরী করে।আর্থিক সংকটের মধ্যে দিয়েও যেতে হয়ে তাকে। শুরুটা দেরিতে করলেও থেমে থাকেননি তিনি, এগিয়েছেন তরতর করেই। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট, ঘরোয়া ক্রিকেট, হাইপারফরম্যান্স ইউনিট থেকে দ্রুতই জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়ে চমক দেখিয়েছেন আইসিসি র্যাঙ্কিং পর্যন্ত।
১৯৯৯ সালের ২২ আগস্ট পৃথিবীর আলো দেখা নাইমের ক্রিকেটের সাথে তাই সখ্য ছোটোবেলা থেকেই। বরিশালে নানাবাড়িতে কেটেছে তার শৈশব। সেখানেই এক ক্রিকেট একাডেমির মাধ্যমে ক্রিকেটে হাতেখড়ি। অবশ্য পরিবার থেকেই নাইমকে একাডেমিতে ভর্তি করিয়েছিল কিন্তু তিনি ছিলেন ফাঁকিবাজ। লেখাপড়ার মতো ক্রিকেট অনুশীলনেও তখন ফাঁকিবাজি করেছেন। কে জানতো অনুশীলনে ফাঁকি দেওয়া এই ছেলেই একদিন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে!
পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বরিশালে সময় কেটেছে নাইমের। এরপর পৈতৃক ভূমি ফরিদপুরে চলে। নিজের বাড়িতে ফেরার পরেই ক্রিকেটটা ভালোভাবে অনুশীলন শুরু হয় তার। টেপ টেনিস দিয়ে ক্রিকেটে তার যাত্রা শুরু। ছোট থেকেই ব্যাটসম্যান ছিলেন। মাঝে মাঝে উইকেটরক্ষকও হতেন তবে বোলিংটা করেননি কখনো। টেপ টেনিস খেলার মাধ্যমেই নিজ এলাকা ছাড়িয়ে আশেপাশের এলাকাতেও জনপ্রিয় হন নাইম। টেপ টেনিস, শর্ট পিচে খেলার জন্য ডাক আসতো বিভিন্ন এলাকার দল থেকে। শর্ট পিচ ও ছোটো মাঠে নিয়মিত খেলা চালিয়ে যান নাইম। এরমাঝে ফরিদপুর জুনিয়র ক্রিকেট কোচিং ক্লাবে ভর্তি হয়ে পুরোদমে অনুশীলন শুরু করেন।
টেপ টেনিস মাতিয়ে আসা ছেলেটা ক্রিকেট বলে খেলা শুরু করলেও বেশ অবহেলিত থাকত। জেলার অন্যান্য ক্রিকেটারদের সাথে পাল্লা দিয়ে সবসময় শীর্ষে আসা হতো না তার। তখন হঠাৎ করে অনুশীলনও বন্ধ করে দেন। সফলতা না পাওয়া এবং আর্থিক সংকটে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাই বলে দমে যাননি। আবারো ফিরেছেন ক্রিকেটে, পরিশ্রম চালিয়ে গেছেন। সতীর্থদের মাঝে সেই অবহেলিত ছেলেটিই কিন্তু শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রেখেছেন।
স্থানীয় এক কোচের পরামর্শে ফরিদপুর বিভাগীয় অনূর্ধ্ব ১৮ দলে খেলা শুরু করেন তিনি। দলটিতে তখন ভালো কোনো ব্যাটসম্যান না থাকায় নাইম হয়ে উঠেছিলেন দলের প্রাণভোমরা। কিন্তু এখানে বাঁধ সাধে লেখাপড়া। ২০১৫ সালে যখন অনূর্ধ্ব ১৮ দলের হয়ে খেলা শুরু করেন তখনই ছিল তার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। ক্রিকেট অনুশীলন ও পড়ালেখা- দুইটিই একসাথে চালাতে থাকেন। কিন্তু পরীক্ষা খারাপ হয়। ইংরেজিতে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হন। তারপরেই ক্রিকেটে আরও মনোযোগ দেন। লেখাপড়াটা চালানো হয়নি সাথে সাথে। তবে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় আবারো অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা আছে তার।
অনূর্ধ্ব ১৮ টুর্নামেন্ট খেলার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেন। টুর্নামেন্টে ভালোও খেলেন। কিন্তু ভাগ্য সাথে ছিল না। সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হওয়া সত্ত্বেও বিভাগীয় দল থেকে চারজন অনূর্ধ্ব ১৯ দলে ডাক পেলেও সেই তালিকায় ছিলেন না নাইম। মানসিকভাবে বেশ ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যান নিজের সেরাটা দিয়ে। এরপরের অনূর্ধ্ব ১৮ টুর্নামেন্টে ছোটান রানবন্যা। ৫ ম্যাচে করেন ৪০০ রান। বিভাগীয় টুর্নামেন্টেও সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন নাইম। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি, অনূর্ধ্ব ১৯ দলে ডাক পেয়ে যান। তার আগেই জাতীয় দলে অভিষেক হওয়া আফিফ হোসেন ধ্রুব, আমিনুল ইসলাম বিপ্লব, অভিষেকের অপেক্ষায় থাকা সাইফ হাসানদের পেয়েছিলেন সতীর্থ হিসাবে। ২০১৮ সালের অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে খেলেন নাইম।
বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব ১৯ জাতীয় পর্যায়ে ভালো খেলে নির্বাচকদের নজরে চলে আসেন নাইম। ডাক পান- হাইপারফরম্যান্স ইউনিট, বাংলাদেশ এ দল, ইমার্জিং দলে। লিস্ট এ ক্রিকেটে অভিষেক হয় ২০১৮ সালে, ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে। লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের হয়ে ৮০৭ রান করে হয়েছিলেন শীর্ষ রানসংগ্রাহক। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে ঢাকা ডায়নাইমাটসের দলেও ডাক পান। তবে সেবার খেলা না হলেও ২০১৯ সালে বিপিএলের ষষ্ঠ আসর দিয়ে স্বীকৃত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অভিষেক হয় নাইমের। খুব বেশি টি-টোয়েন্টি না খেললেও প্রিমিয়ার লিগ ও বিভিন্ন পর্যায়ের দলের হয়ে দ্রুত গতিতে রান তোলার অভ্যাস আছে তার। প্রায়ই ৩০-৩৫ বলে অর্ধশতক হাঁকাতেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।
জাতীয় দলে আসার আগে ৫টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ, ৩৫টি লিস্ট এ ম্যাচ ও ৭টি স্বীকৃত টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলছেন তিনি। যেখানে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার সংগ্রহ ২০.৩৩ গড়ে ১৮৩ রান, লিস্ট এ ক্রিকেটে ৪৯.৩২ গড়ে ১৬৭৭ রান এবং টি-টোয়েন্টিতে ২২.৫০ গড়ে ৯০ রান। তবে জাতীয় দলে এসেই কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে ৩ ম্যাচে করেছেন মোট ১৪৩ রান। গড়টা ৪৭.৬৬!
ভারতের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ জয়ে ব্যাট হাতে ভালো শুরু এনে দেন নাইম। করেন ২৮ বলে ২৬ রান, কিছুটা ধীরগতির ছিল। দ্বিতীয় ম্যাচে তার ব্যাট থেকে আসে ৩১ বলে ৩৬ রান। প্রথম দুই ম্যাচেই ধারাবাহিকভাবে রান পেলেও ইনিংস বড় করতে পারছিলেন না। তবে তৃতীয় ম্যাচে ঠিকই নিজের সহজাত ব্যাটিং প্রদর্শনী দেখিয়ে কুড়িয়ে নিয়েছেন দেশি-বিদেশী ক্রিকেটার ও ক্রিকেট বিশ্লেষকদের প্রশংসা। ৪৮ বলে ৮১ রানের এক ঝলমলে ইনিংস খেলেন যদিও দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়তে পারেননি।
অভিষেক সিরিজে ভালো খেলে ইঙ্গিত দিয়েছেন জাতীয় দলে নিয়মিত হওয়ার। নাইমের মতো তরুণদের হাত ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এগিয়ে যাক বাংলাদেশও।