পৃথিবীর বহু স্থানে আজও কিছুকিছু প্রাচীন সভ্যতা বা ধর্মীয় প্রথা টিকে আছে। এগুলোর বেশির ভাগেরই উৎপত্তি হচ্ছে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে। পূরনো সেই সভ্যতার রীতিনীতি আজকের সভ্যতার জন্য খুবই বিচিত্র, অদ্ভুদ ও ভয়ংকর মনে হয়। এখন আমি এমন ১১টি ভয়ংকর রীতিনীতি একত্রিত করে বলছি যা আপনাকে চমকিত করবে।
১। মৃত ব্যক্তির হাড় খাওয়া ঐতিহ্য
জেনে অবাক হলেন! বিশ্বাসই হচ্ছে না তাইতো? কিন্তু এটিই সত্য। ব্রাজিল এবং ভেনেজুয়েলার কিছু আদিবাসী সম্প্রদায় তাদের মৃত আত্মীয়ের হাড় খায়! মৃতদেহ পোড়ানোর পর যে হাড়গুলো পোড়া যায় না সেগুলো এবং ছাই খেয়ে থাকে। এসব খাওয়ার সময় তারা কলার স্যুপও খায়। এভাবে তারা মৃত ব্যক্তির প্রতি ভালবাসার অনুভূতি প্রকাশ করে থাকে।
২। নরমাংস ভক্ষণ প্রথা
ভারতের বারাণসীতে অঘোরী বাবা নামের এক ব্যক্তি রয়েছেন, যিনি মৃত ব্যক্তির শরীর টুকরো টুকরো করে মাংস খান। কুখ্যাত এই মৃতদেহ খাদকের বিশ্বাস এমন করলে তার মন থেকে মৃত্যুভয় চিরতরে দূর হবে! এছাড়াও এতে তিনি তার আধ্যাত্বিক জ্ঞান প্রাপ্ত হবেন। হিন্দু ধর্মমতে, পবিত্র ব্যক্তি, বাচ্চা, গর্ভবতী, কুমারী মেয়ে, কুষ্ঠরোগ এবং সর্প দংশনে মৃত ব্যক্তিকে পোড়ানো হবে না। এই মৃতদেহগুলোকে গঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। অঘোরী বাবা এই মৃতদেহগুলো সেখান থেকে তুলে তার প্রথা পালন করে থাকেন।
৩। শরীর সজ্জ্বিতকরণ
পাপুয়া নিউগিনীর কনিংগারা সম্প্রদায় একটি ভয়ংকর প্রথা পালন করেন। তারা ত্বক কেটে নকশা করেন। যাতে এই নকশা সারাজীবন থাকে। এই নকশা পুরষত্বের পরিচয় বহন করে।
৪। শিয়া মুসলিমদের শোক
ইতিহাসের অনেক সভ্যতাতেই রক্তপাতের উদাহরণ পাওয়া যায়। মহানবী হযরত মুহম্মদ (সঃ) এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রাঃ)কে এজিদ বাহিনী শহীদ করে। ৭ম শতকে কারবালায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো এজিদ ছিলেন শিয়া মুসলিম। পুরো মুসলিম বিশ্ব ১০ই মহররম হোসেন (রাঃ)কে স্মরণে নিয়ে শোক প্রকাশ করে। কিন্তু শিয়া মুসলিমরা এই শোক ভিন্নভাবে প্রকাশ করে থাকেন। তারা বিলাপ করতে থাকেন, আমি কেন সেই যুদ্ধে ছিলাম না। থাকলে হোসেনকে বাঁচাতে পারতাম। যেহেতু এজিদ ছিল শিয়া। তাই সব শিয়াই নিজেদের পাপের ভাগীদার মনে করেন। তাই তারা নিজেদের উপর অত্যাচার করেন এবং নিজের শরীর থেকে রক্ত ঝরান!
৫। বাঞ্জি জাম্পিং
একে বাঙ্গি জাম্পিং উচ্চারণ করে অনেকেই। শব্দটি নিউজিল্যান্ডে উৎপত্তি হতে পারে। শব্দটির সাধারণ অর্থ দাঁড়ায় পা বেঁধে উঁচুস্থান থেকে লাফ দেয়া। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপে অবস্থিত বনলেপ গ্রামে এমন অদ্ভুদ প্রথা পালিত হয়। গ্রামের লোকগুলো ঢাকঢোল পিটিয়ে নাচ গান করতে থাকে। অপরদিকে যিনি লাফ দিবেন তিনি উঁচু কাঠের টাওয়ারে নিজের পা রশি দ্বারা বেঁধে নেন। অতঃপর লাফ দেন। অনেক সময় হাড় ভেঙ্গেও যায়। তাদের বিশ্বাস যত উঁচু থেকে লাফ দিবেন স্রষ্টা ততবেশি আশীর্বাদ করবেন।
৬। আত্মার যোগ ব্যায়াম
পশ্চিম আফ্রিকার একটি ধর্ম বিশ্বাস আছে ভোডুন। সেই বিশ্বাস অনুসারে, সেই সম্প্রদায়ের লোকদের টানা তিনদিন খাদ্য ও পানাহার ব্যতীত জঙ্গলে থাকতে হয়। তাদের ধারণা এতে আত্মার যোগ ব্যায়াম হয়। সেইসাথে আত্মা পরিশুদ্ধ হয়। অনেকেই বলেন সে সময় তাদের শরীর বেহুশ হয়ে যায়।
৭। আকাশে দাফন
তিব্বতের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পবিত্র একটি প্রথার নাম ঝাটোর। এটি হাজারো বছর ধরে প্রচলিত আছে। একে ইংরেজিতে স্কাই বারিয়াল বা আকাশে দাফন বলা হয়। এ প্রথা অনুসারে, মৃত ব্যক্তির শরীর টুকরো টুকরো করে শকুন অথবা অন্যকোন মাংশ খাদক পাখিকে খাওয়ানো হয়। তিব্বতের লোকেরা মনে করেন এতে মানুষের পুনর্জন্ম হবে। এজন্য অবশ্য লাশের টুকরোগুলো সবথেকে উঁচুস্থানে রাখতে হয়।
৮। আগুনের উপর চলা
শরীর শিউরে ওঠারই কথা। উঠেছে নিশ্চয়ই! এই ভয়ংকর উৎসবটি প্রচলিত আছে মালয়েশিয়ার পেনাঙ্গ নামক স্থানে। ধার্মিক প্রমাণের জন্য আপনাকে জলন্ত কয়লার উপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। বিশ্বাস করা হয় যে, আগুন থেকে বের হয়ে আসতে পারলে ব্যক্তিটি পবিত্র হয় এবং খারাপ আচরমুক্ত হয়। এই প্রথাটি আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতেরও কিছু কিছু স্থানে দেখা যায়।
৯। মৃত শরীরের সাথে নাচানাচি
শোনার পর হাসবেন নাকি ভয় পাবেন সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু এটিই সত্য। উৎসবটি মাদাগাস্কারের। সেখানে কেউ মারা গেলে তাকে নিয়ে উৎসব করা হয়। ফামাহিদাহ নামক এই প্রথায় সেখানকার লোকেরা মৃতদেহ দাফন করার পর পুনরায় তুলে আনেন। এসময় তারা গান গায় ও নাচ করেন! দাফন করা স্থানের নিকটে গান ও বাদ্যবাজনা করেন। এই অদ্ভুদ কর্মটি তারা দুই বছর থেকে সাত বছর পর্যন্ত করে থাকেন!
১০। মুখছিদ্র করা
থাইল্যান্ডের ফুকেটে প্রতিবছর ভেজিটেরিয়েন বা সবজি খাদকদের উৎসব পালিত হয়। এই উৎসবে একটি প্রথা পালন করতে দেখা যায়। প্রথাটি খুবই ভয়ংকর এবং বেদনাদায়ক। এতে ভক্তকূল চাকু, বর্শা, বন্দুক, সুঁচ, তলোয়ার অথবা হুকের মত বস্তু দিয়ে নিজের শরীর ছিদ্র করে! তাদের বিশ্বাস শ্রষ্টা তাদের রক্ষা করবেন।
১১। গো-হত্যা উৎসব
ম্রো বা মুরং আদিবাসীরা বৌদ্ধ, ক্রামা, খ্রিষ্টান ধর্ম পালন করে থাকেন। অনেকেই আবার সনাতন ধর্ম পালন করেন। তবে জুমচাষকে কেন্দ্র করে প্রকৃতির পুজারীও আছেন। তাদের সবথেকে বড় সামাজিক উৎসব হচ্ছে গো-হত্যা। রোগমুক্তি, ফসলের ভাল ফলন ইত্যাদির আশায় এটি পালন করেন। তারা মনে করেন গরুর আত্মা তাদের জাতির শত্রু। তারা বিশ্বাস করেন গরুর আত্মার নজর যে পরিবারে পড়ে সেই পরিবারে অসুখ লেগেই থাকে। রোগমুক্তির আশায়, গৃহকর্তা বল্লম দিয়ে গরুর ডানপাশের হৃদপিণ্ড বরাবর আঘাত করেন। গরু মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকলে ম্রোদের নাচ ও গানের শব্দ আরো বেড়ে যায়! বর্তমানে ম্রোদের মাঝে ক্রামা ধর্ম পালনকারীরা গো-হত্যা উৎসবটি পালন করেন না।
লিখেছেন ডা. সাইফুল ইসলাম সোহেল। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিমেল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটি।