যেভাবে মায়ানমার সেনা-সদস্যরা জ্বালাওপোড়াও, লুটপাট এবং হত্যাযজ্ঞ চালায় একটি প্রত্যন্ত গ্রামেঃ
সেপ্টেম্বর ২ তারিখে, বৌদ্ধ গ্রামবাসী এবং মায়ানমার সৈন্যরা মিলে ১০ জন রোহিঙ্গা পুরুষকে হত্যা করে মায়ানমারের অশান্ত রাজ্যে। রয়টার্স এই হত্যাকান্ডটি উন্মোচিত করে দেয় এবং এ হত্যাগুলো কিভাবে হয়েছে এর প্রত্যেকটি ঘটনাকে একসাথে নিয়ে আসে। এই প্রতিবেদন তৈরীর সময় দুইজন রয়টার্স সাংবাদিককে মায়ানমার পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।
ইন ডিন, মায়ানমার – একসাথে বাঁধা অবস্থায়, সেই দশজন রোহিঙ্গা বন্দিরা তাদের প্রতিবেশি বৌদ্ধদের একটি অগভীর কবর খুঁড়তে দেখে। এর খানিক পরে, ২ সেপ্টেম্বর সকালেই দশজনকেই মেরে শোয়ানো হয়। অন্তত দুইজনকে বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা হত্যা করে। এবং বাকিদের মায়ানমার সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করে, কবরখনকদের দুইজন বলেন।
“দশজনের জন্য একটি কবর,” বলেছিলেন সো চ্যায় (Soe Chay), বয়স ৫৫, রাখাইন বুদ্ধিস্ট কমিউনিটির একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক; যিনি বলেন, তিনি গর্তটি খোঁড়ায় সহযোগিতা করেছিলেন এবং দেখেছিলেন হত্যাকান্ডগুলো। সৈনিকরা প্রতিজন পুরুষকে দুই অথবা তিনবার গুলি করে, তিনি বলেন, “যখন তাদেরকে দাপন করা হচ্ছিলো, তাদের মধ্যে কেউ কেউ তখনও শব্দ করছিলো এবং অন্যরা ততক্ষণে মৃত।”
ইন ডিন -এর উপকূলবর্তী এ গ্রামে চলা হত্যাকান্ডগুলো আরেকটি রক্তাক্ত উপাখ্যান চিহ্নিত করে মায়ানমারের পশ্চিম তীরে অবস্থিত উত্তরবর্তী রাখাইন রাজ্যের জাতিগত সহিংসতার। আগস্ট মাস হতে প্রায় ৬৯০,০০০ রোহিঙ্গা মুসলিম তাদের গ্রাম হতে পালিয়ে সীমানা পার করে বাংলাদেশে চলে যায়। অক্টোবরে ইন ডিন গ্রামের ৬,০০০ রোহিঙ্গা বাসিন্দাদের মধ্যে আর কেউই অবশিষ্ট রইলো না।
রোহিঙ্গারা সেনাবাহিনীকে দায়ী করে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ এবং হত্যাকান্ডগুলোর জন্য এবং হত্যাকান্ডগুলো মূলত তাদের অস্তিত্ব মুছে দেওয়া বিশেষ করে, ৫৩ মিলিয়ন বৌদ্ধদের দেশ হতে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে মনে হচ্ছে সেনাবাহিনী গনহত্যা চালিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র এটাকে আখ্যায়িত করছে জাতিগত নিধন। অন্যদিকে মায়ানমার বলছে তাদের “অপারেশন ক্লিয়ারেন্স” একটি বৈধ প্রতিক্রিয়া রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের করা হামলার।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব কয়েক শতক ধরে। কিন্তু অধিকাংশ বার্মা মনে করে তারা বাংলাদেশ হতে অবৈধ প্রবাসী। সেনাবাহিনীরা সাম্প্রতিক কয়েকবছর ধরে রোহিঙ্গাদের বাঙ্গালি হিসেবে নির্দেশ করেছে। সাম্প্রতিক কয়েকবছর ধরে, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বেড়েছে এবং সরকার ১০০,০০০ রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন ক্যাম্পে আবদ্ধ করেছে যেখানে তারা সীমিত খাদ্য, ওষুধ এবং শিক্ষার অনুমতি পাচ্ছে।
রয়টার্স একত্র করেছে, ইন ডিন-এ যা যা ঘটেছে এ দিনগুলোতে যা ধাবিত করে ১০জন রোহিঙ্গা – আটজন পুরুষ এবং কৈশোরের শেষ দিকে থাকা দুই হাই স্কুল ছাত্রের হত্যার দিকে।
এখন পর্যন্ত রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হওয়া অত্যাচারের হিসেবটা কেবল আক্রান্তরাই দিয়ে আসছিলো। দ্য রয়টার্স রিকন্সট্রাকশন প্রথমবারের মত বৌদ্ধ গ্রামবাসীদের সাক্ষাতকারের জন্য নিয়ে আসে, যারা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন লাগানো, লাশ দাপন এবং মুসলিম হত্যার দায় স্বীকার করে নিয়েছিলো।
এই বিবরণে প্রথমবারের মত উঠে আসে সৈনিক এবং আধা-সামরিক পুলিশদেরকে তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মীবৃ্ন্দরদের সাক্ষ্। আধা-সামরিক পুলিশের সদস্যারা রয়টার্সকে ইন ডিন থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করার অভিযানের একদম ভেতরকার বিস্তারিত তথ্য জানায়, এটাও নিশ্চিত করেছে যে সেনাবাহিনীই এই অভিযানের মূল চরিত্র হিসেবে কাজ করেছে।
নিহত পুরুষদের পরিবাররা বর্তমানে বাংলাদেশে শরনার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছে, রয়টার্সদের দেখানো ছবি দেখে তারা নিহতদের চিহ্নিত করেছে। মৃতরা ছিলেন জেলে, দোকানদার, দুইজন কিশোর ছাত্র এবং একজন ইসলামী শিক্ষক।
রয়টার্সকে গ্রামের এক বৌদ্ধ প্রবীণের দেয়া তিনটি ছবি ইন ডিনে ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ডের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে ধরে রেখেছে, এক সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যার খানিক আগে রোহিঙ্গা পুরুষদের বন্দি বানানো থেকে শুরু করে দুই সেপ্টেম্বর সকাল দশটার কিছু পরে তাদের প্রাণ নেয়ার আগ পর্যন্ত। দুটো ছবি – একটি নেয়া হয়েছিলো প্রথম দিনে, এবং অন্যটা যেদিন হত্যাগুলো হয় সেদিন – দেখাচ্ছে বন্দিদের একটি সারিতে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছ। এবং সর্বশেষ ছবি দেখাচ্ছে তাদের রক্তাক্ত লাশ স্তুপ করে ফেলে রাখা হয়েছে সংকীর্ণ কবরে।
রয়টার্সের ইন ডিনে ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ডের তদন্তের বিষয় ছিলো ঠিক কোন কারণ মায়ানমার পুলিশ কর্তৃপক্ষকে নিউজ এজেন্সি সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করতে বাধ্য করে। সাংবাদিক দুজন, বার্মিজ নাগরিক ওয়া লোন (Wa Lone) এবং কিও সো ওঁ (Kyaw Soe Oo), ডিসেম্বরের ১২ তারিখে আটক হন রাখাইন সম্পর্কিত গোপনীয় কাগজপত্র হস্তগত করার অভিযোগে।
এরপর, ১০ জানুয়ারিতে, সেনাবাহিনী একটি বিবৃতি জারি করে যা নিশ্চিত করে ওয়া লোন (Wa Lone), কিও সো ওও (Kyaw Soe Oo) এবং তাদের সহকর্মীরা ঠিক কি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরী করতে যাচ্ছিলো, স্বীকার করে নিয়ে ঐ গ্রামে দশজনকে হত্যা করা হয়েছে। এটা নিশ্চিত করে যে বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা কিছু মানুষকে তলোয়ার দিয়ে আক্রমণ করে এবং সৈন্যরা বাকিদের গুলি করে হত্যা করে।
দশটা জীবনঃ যাদের হত্যা করা হয়
নিহতদের মধ্যে জেলে, একজন ইসলামী শিক্ষক, এবং দুইজন হাই স্কুল ছাত্র অর্ন্তভুক্ত ছিলো।নিচে প্রত্যেকের সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরা হলো। ব্যবহৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছবিগুলো ১ সেপ্টেম্বরে তাদের ধরে নিয়ে বেঁধে রাখার পর তোলা ছবি থেকে নেয়া।
বিবৃতিটির সাথে একটি আবেদনপত্র আদালতের কাছে প্রসিকিউটররা পেশ করেন যাতে ওয়া লোন (Wa Lone) এবং ক্যায়াও সো ওঁ (Kyaw Soe Oo) কে মায়ানমারের ‘অফিসিয়াল সিক্রেট এক্ট’ মোতাবেক শাস্তি প্রদান করা হয়, যা বিট্রিশ উপনৈবেশিক সময়কার নিয়মকানুনের মধ্যে পড়ে। এই শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদন্ড হতে পারে।
কিন্তু রাখাইন বৌদ্ধ এবং রোহিঙ্গা মুসলিম সাক্ষীদের দেয়া বিবরণ অনুযায়ী ঘটনাগুলোর মিলিটারি সংস্করণ অসংঙ্গতিপূর্ণ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক দিয়ে। সেনাবাহিনী বলেছিল ঐ দশজন মানুষ ছিলো দুইশজন সদস্যবিশিষ্ট ‘সন্ত্রাসী’ দলের সদস্য যারা নিরাপত্তা বাহিনীদের হামলা করেছিল। সৈনিকরা সিদ্ধান্ত নেয় তাদের মেরে ফেলার, সেনাবাহিনী বলে, কারণ তখন সে এলাকায় তীব্র সংঘর্ষর ফলে তাদেরকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। সেনাবাহিনী বলছে, জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছিলো।
বুদ্ধিস্ট গ্রামবাসী যারা এই আর্টিকেলের জন্য সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন তারা বলেছেন, ইন ডিনের নিরাপত্তা বাহিনীর উপর কোন বড় সংখ্যাক বিদ্রোহী আক্রমন করেনি। এবং রোহিঙ্গা প্রত্যক্ষদর্শীরা রয়টার্সকে বলেছিল যে এই দশজন পুরুষকে একশোর মত পুরুষ, নারী, এবং বাচ্চাদের মধ্য থেকে তুলে নেয়া হয়েছিল যারা পার্শ্ববর্তী সমুদ্রসৈকতে নিরাপত্তা খুঁজছিলো।
রাখাইন বৌদ্ধ গ্রামবাসী, সৈনিক, আধা-সামরিক পুলিশ, রোহিঙ্গা মুসলিম এবং স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সাক্ষাতকার আরো যা ফাঁস করেঃ
- মিলিটারি এবং প্যারামিলিটারি পুলিশ ইন ডিনের স্থানীয় বাসিন্দাদের সংঘবদ্ধ করে এবং অন্তত পক্ষে আরো দুই গ্রামবাসীকে সংগঠিত করে রোহিঙ্গা বাড়িঘরে আগুন লাগানোর জন্য, এক ডজনেরও বেশি বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা বলেন। এগারোজন বৌদ্ধ গ্রামবাসী হত্যা সহ, সহিংসতামূলক অপরাধ করেছিল। সরকার এবং সেনাবাহিনী বারবার রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদেরই দোষারোপ করছে গ্রাম ও ঘরবাড়ি জ্বালানোর জন্য।
- ইন ডিনের রোহিঙ্গা পাড়া ‘খালি’ করার একটি আদেশ কমান্ড চেইনের মাধ্যমে সেনাবাহিনী হতে নিচে নামতে থাকে, বলেন পরিচয় গোপনে কথা বলতে রাজি হওয়া তিনজন প্যারামিলিটারি পুলিশ এবং চতুর্থজন প্রাদেশিক রাজধানী ‘সিটওয়ে’ এর ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের একজন পুলিশ অফিসার। নিরাপত্তা বাহিনী রেইড চালানোর সময় সাধারণ নাগরিকের কাপড়চোপড় পরিধান করত ধরা পড়া এড়ানোর জন্য, প্যারামিলিটারি অফিসারদের একজন বলেন।
- কিছু প্যারামিলিটারি পুলিশ সদস্য রোহিঙ্গাদের সম্পত্তি লুটপাট করে, যার মধ্যে ছিল গরু এবং মোটরসাইকেল, উদ্দেশ্য ছিল বিক্রি করা, গ্রাম প্রশাসক মঙ থেইন চ্যায় (Maung Thein Chay) এবং প্যারামিলিটারি পুলিশ অফিসারদের একজনের মতে।
- ইন ডিন –এ চলা অভিযান আর্মি’র ৩৩তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছিল, প্যারামিলিটারির ৮ম সিকিউরিটি ব্যাটালিয়ন সহায়তা করছিল – চারজন পুলিশ অফিসার অনুযায়ী, যারা প্রত্যেকে উক্ত ব্যাটালিয়ন এর সদস্য ছিল।
ইন ডিনে হওয়া হত্যাকান্ডগুলোর ভিডিও প্রতিবেদনঃ The killings in Inn Din
মাইকেল জ. কার্নাভাস, দ্য হেগ – এ প্রতিষ্ঠিত একজন মার্কিন আইনজীবী যিনি আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল ট্রাইবুনালে বিভিন্ন কেসে কাজ করেছেন, বলেন সেনাবাহিনী বৌদ্ধ নাগরিকদের সংগঠিত করেছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সৃষ্টির জন্য – এটি একটি অকাট্য প্রমাণ যে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, আরো স্পষ্টভাবে উদ্দেশ্যটা ছিলো গণহত্যা, কেননা আক্রমণ গুলো দেখা যায় যে রোহিঙ্গাদের কিংবা তাদের একটা নির্দিষ্ট অংশকে নির্মূল করতে সাজানো হয়েছিলো।
মানুষগুলোর হত্যাকান্ডের যে প্রমাণ সরকারের হেফাজতে আছে তা ব্যবহার করে মিলিটারি কমান্ডারের বিরুদ্ধে মামলা করা যেত মানবতাবিরোধী অপরাধ করার জন্য, কার্নাভাস বলেছিলেন, যদি এটাকে দেখানো যেত যে এটা ছিলো একটি “সুদূরপ্রসারী অথবা সিস্টেমেটিক” সামরিক অভিযান রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে। কেভিন জন হেলার, একজন ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের আইনের প্রফেসর যিনি আইন সহযোগী হিসেবে কাজ করেন যুদ্ধাপরাধী এবং সাবেক বসনিয়ান সার্ব নেতা রাদোভান কারাডিযকের, বলেন, গ্রামকে খালি করার জন্য মিলিটারি আদেশ ছিল, “পরিষ্কারভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ অথবা জোরপূর্বক স্থানান্তর।”
ডিসেম্বরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর্মি অফিসার মেজর জেনারেল মঙ মঙ সো (Maung Maung Soe) এর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন, যিনি রাখাইনে ওয়েস্টার্ন কমান্ড ট্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন। যাইহোক, মায়ানমান সহিংসতার কারণে আন্তর্জাতিক কোন নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়নি। মায়ানমারের নেত্রী, অং সান সু চি, রাখাইনে সেনাবাহিনীর কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কথা না বলায় পশ্চিমা বিশ্বের বেশ কিছু সাবেক সমর্থকদের আশাহত করেন। তারা আশা করেছিলেন যে ২০১৫ সালের তার ন্যাশনাল লীগের নির্বাচন ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য, দেশে গণতন্ত্রের সংস্কার করবে এবং দেশটির সম্ভাবনা উন্মুক্ত করবে। পরিবর্তে সমালোচকরা বলেন, ২০১০ সালে যাদের সাহায্যে সুচি গৃহবন্দি হতে মুক্তি লাভ করেছিলেন আজ তাদেরই দাসে পরিণত হয়েছেন।
হত্যাকান্ডের যে প্রমাণ রয়টার্স বের করেছে তা নিয়ে জিজ্ঞেস করলে, সরকারের মুখপাত্র জো হতেয় (Zaw Htay) বলেন, “আমরা মানবাধিকার ভঙ্গের অভিযোগগুলো অস্বীকার করছিনা। এবং ব্লাংকেট ডিনায়ালও দিচ্ছি না”। যদি সেখানে নির্যাতনের “শক্তিশালী এবং নির্ভরযোগ্য প্রাথমিক প্রমাণ” থাকত, সরকার তদন্ত করত, তিনি বলেন। “এবং তারপর যখন আমরা প্রমাণটার সত্যতা খুঁজে পাই এবং সেখানে সহিংসতা বিরাজমান, আমরা বিদ্যমান আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবো।
যখন বলা হলো যে প্যারামিলিটারি অফিসাররা বলেছে যে তারা ইন ডিনের রোহিঙ্গা পাড়া “খালি” করার আদেশ পেয়েছিল, তিনি বলেন,”আমাদের তা যাচাই করতে হবে। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয় এবং মায়ানমার পুলিশ বাহিনীদেরকেও জিজ্ঞেস করতে হবে।” প্যারামিলিটারি পুলিশ অফিসারদের দ্বারা লুটের অভিযোগের কথা জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেন, পুলিশ তদন্ত করবে।
যখন তাকে বলা হলো যে বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি পোড়ানোর কথা স্বীকার করেছে তিনি বেশ আশ্চার্য বোধ করেন এবং বলেন, “আমরা স্বীকার করছি যে অনেক, অনেক ভিন্নরকম অভিযোগ আছে সেখানে, কিন্তু কারা করেছে তা আমাদের যাচাই করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতে যা খুবই কঠিন।”
জো হতেয় (Zaw Htay) রাখাইনে সেনাবাহিনীর অভিযানের পক্ষ নেন। “আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর বোঝা প্রয়োজন যে কারা প্রথমে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছিলো। যদি এমন সন্ত্রাসী হামলা ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে হত, যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন, নিউ ইয়র্ক বা ওয়াশিংটনে, তখন মিডিয়া কি বলত?”
প্রতিবেশী যখন প্রতিবেশীর শত্রু
রাখাইনের রাজধানী ‘সিটওয়ে’ থেকে ৫০কি.মি (৩০ মাইল) উত্তরে মায়ো পর্বত এবং বঙ্গোপসাগরের মাঝামাঝিতে অবস্থিত ইন ডিন। এই উপনিবেশটি গড়ে উঠে একটি স্কুল, ক্লিনিক এবং বৌদ্ধ মঠের চারপাশে বিক্ষিপ্তভাবে থাকা বিভিন্ন পাড়া নিয়ে। বৌদ্ধদের ঘরগুলো গ্রামটির উত্তরাংশে অবস্থিত। বেশ কয়েকবছর ধরেই বৌদ্ধ এবং তাদের মুসলিম প্রতিবেশীদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিলো, গ্রামের ৭০০০ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যাদের সংখ্যাটা প্রায় ৯০ শতাংশ। তবে দুটো জনগোষ্ঠীই নিজেদের পাশাপাশি টিকিয়ে রেখেছে, মাছধরা, উপকূলীয় পানি এবং জমিতে ধান চাষ সহ প্রায় সবক্ষেত্রে।
অক্টোবর ২০১৬-তে, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা উত্তরবর্তী রাখাইন অঞ্চলের তিনটা পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ করে – যা নতুন এক বিদ্রোহের সূচনা করে। হামলাগুলোর পরে, ইন ডিন-এর রোহিঙ্গারা বলেছে, অনেক বৌদ্ধ তাদের কৃষিকাজ বা ঘরের কাজের জন্য রোহিঙ্গাদের নিয়োগ দেয়া বন্ধ করে দেয়। আবার, বৌদ্ধরা বলেছে রোহিঙ্গারাই কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল।
গতবছরের ২৫শে আগস্ট বিদ্রোহীরা আবার হামলা করে, ৩০টি পুলিশ ফাঁড়ি এবং একটি সেনাবাহিনী ঘাঁটিতে। সবচেয়ে কাছাকাছি হামলাটি ছিলো ৪ কি.মি উত্তরে। ইন ডিনে, কয়েকশত বৌদ্ধ ভয় পেয়ে গ্রামের কেন্দ্রে থাকা মঠে আশ্রয় নেয়, তাদের মধ্য থেকে এক ডজনের ও বেশি মানুষ বলেছিল। ইন ডিনের রাতের প্রহরী সান থেইন (৩৬) বলেন, “তারা তাদের মুসলিম প্রতিবেশিদের দ্বারা “নিগৃহীত” হতে ভয় পাচ্ছিলো । একজন বৌদ্ধ প্রবীণ বলেন, সব রোহিঙ্গা, “শিশুকিশোর সহ”, সবাই বিদ্রোহের অংশ ছিল এবং এইজন্যে তারা “সন্ত্রাসী”।
আগস্ট ২৭ তারিখে, প্রায় ৮০জন সৈন্য ইন ডিন-এ পৌঁছায় মায়ানমারের ৩৩ তম লাইট ইনফ্যানট্রি ডিভিশন থেকে, নয়জন বৌদ্ধ গ্রামবাসী বলেন। দুইজন প্যারামিলিটারি অফিসার এবং অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক সো চ্যায় (Soe Chay) বলেন এই সৈনিকরা একই ডিভিশনের ১১তম ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট এর অন্তর্ভুক্ত। দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তা গ্রামবাসীদের বলেন সৈনিকদের জন্য তাদের অবশ্যই রান্না করতে হবে এবং তাদের পরিচয় গোপনের ঢাল হতে হবে – সো চ্যায় (Soe Chay) উল্লেখ করেন। অফিসারটি কথা দিয়েছিলেন তার সৈন্যরা গ্রামের বৌদ্ধদের তাদের রোহিঙ্গা প্রতিবেশি হতে সুরক্ষা প্রদান করবে। পাঁচজন বৌদ্ধ গ্রামবাসী বলেন, অফিসারটি বলেছিলেন চাইলে তারাও নিরাপত্তা অভিযানগুলোর জন্য স্বেচ্ছাসৈনিক হিসেবে যোগদান করতে পারবে। যদিও, যুবক স্বেচ্ছাসৈনিদের পিতামাতার অনুমতির প্রয়োজন হবে সৈন্যদলে যোগদানের জন্য।
সেনাবাহিনী ইন ডিন-এর বৌদ্ধদের মধ্য থেকে “নিরাপত্তা দল”-এ অংশগ্রহণে ইচ্ছুকদের খুঁজে পেয়েছিল, সংঘটির নয়জন সদস্য এবং অন্য দুজন গ্রামবাসী বলেন। এই অনানুষ্ঠানিক সৈন্যদল গঠন করা হয়, ২০১২ সালে রাখাইন বৌদ্ধ এবং রোহিঙ্গা মুসলিমদের মাঝে যখন সহিংসতা জেগে উঠে এরপর পরই, ৩ জন মুসলিম কর্তৃক একজন বৌদ্ধ নারীর ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাটি থেকেই এই মনোমালিন্য শুরু ধরা যায়। মায়ানমার মিডিয়া যথাসময়ে এটা রিপোর্টটি করেছিল, যার ফলে জেলা আদালতে ঐ তিনজনের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছিল।
গ্রামের বৌদ্ধ অংশের চারদিকে ইন ডিন-এর নিরাপত্তা দল “ওয়াচ হাট (Watch Hut)” নির্মাণ করে, এবং এর সদস্যরা পালা বদল করে এসে দাঁড়াত পাহারা দিতে। এতে রয়েছে বৌদ্ধ দমকলকর্মী, স্কুল শিক্ষক, ছাত্র, এবং বেকার যুবক। তারা মিলিটারির কাছে কাজের ছিল কারণ তাদের স্থানীয় ভৌগলিক জ্ঞান ভালো, বলেছেন ইন ডিন-এর বৌদ্ধ প্রশাসক, মঙ থেইন চ্যায় (Maung Thein Chay)।
অধিকাংশ দলের ৮০ থেকে ১০০জন নিজেদের লাঠি এবং রামদা দিয়ে সশস্ত্র করে তুলত। তাদের কিছু বন্দুকও ছিল, একজন সদস্যের মতে। কেউ কেউ আবার এক ধরনের সবুজ কাপড় পরিধান করেছিল, “সৈন্যদের পোশাক” বলে অভিহিত করত তারা ওটাকে।
৩৩ তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি আসার পরের এই দিনগুলোতে, সৈনিকেরা, পুলিশ এবং বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা অধিকাংশ বাড়িঘর জ্বালায় ইন ডিন-এ বাস করা অধিকাংশ রোহিঙ্গা মুসলিমের, এক ডজন বৌদ্ধ বাসিন্দা বলেন।
প্যারামিলিটারি পুলিশের দুজন যারা উভয়ই ৮ম সিকিউরিটি পুলিশ ব্যাটালিয়ন এর সদস্য, বলেছে তাদের ব্যাটালিয়ন রোহিঙ্গা পাড়ায় পাড়ায় আক্রমণ করেছে ৩৩ তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি থেকে সদ্য আসা নতুন সৈনিকদের সাথে নিয়ে। পুলিশ অফিসারদের একজন বলল, সে তার কমান্ডার থেকে রোহিঙ্গারা যেদিকে বাস করতো ঐ এলাকাগুলো “যাও এবং খালি করো”– এর মৌখিক আদেশ পেয়েছিলো, যা সে পোড়ানোর অর্থই ধরে নিয়েছিল।
দ্বিতীয় পুলিশ অফিসার ইন ডিন-এর উত্তরে বিভিন্ন রেইডে অংশগ্রহনের ব্যাপারে বিস্তারিত বলে। রেইড গুলোতে অন্তত ২০জন সৈনিক এবং পাঁচ সাত জনের মত পুলিশ থাকতো, সে বলেছে। একজন সেনা ক্যাপ্টেন অথবা মেজর তাদেরকে নেতৃত্ব দিত, যদিও পুলিশের ক্যাপ্টেন পুলিশের দলটিই দেখতো। রেইডগুলির উদ্দেশ্য ছিল রোহিঙ্গাদের ফেরত আসা থেকে বিরত রাখা।
“তাদের যদি থাকার মত একটি জায়গা থাকে, খাওয়ার মত খাবার থাকে, তারা আরো আক্রমণ করতে পারে,” সে বলেছিল। “এজন্যই আমরা তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেই, প্রধাণত নিরাপত্তা জনিত কারণে”
“আমি এই কেসে নিজের পরিচয় দিতে চাইনা। আমি চাই এমন ঘটনা ভবিষ্যতে যেন আর না হয়।”
একজন রাখাইন বৌদ্ধ প্রবীণ ব্যাখ্যা করেন কেন তিনি রয়টার্সের সাথে হত্যাকান্ডগুলো নিয়ে কথা বলেছেন।
সৈনিক এবং আধা-সামরিক পুলিশরা সাধারণ নাগরিকদের শার্ট এবং শর্টপ্যান্ট পরেছিল গ্রামের মানুষের সাথে মিশে যেতে, দ্বিতীয় পুলিশ অফিসার এবং ইনডিন এর প্রশাসক মঙ থেইন চ্যায় (Maung Thein Chay) বলেন। যদি গণমাধ্যম নিরপত্তা কর্মীদের সংশ্লিষ্টতা চিহ্নিত করে ফেলত, পুলিশ অফিসারটি বুঝিয়ে বলেন, “আমাদের অনেক বড় বড় সমস্যা হত”।
পুলিশের একজন মুখপাত্র , কর্নেল মায়ো থু সো (Myo Thu Soe) বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর গ্রামে আগুন লাগানো এবং নাগরিকদের পোশাক পরিধানের কোন ঘটনাই তার জানা ছিল না। না সেখানে “যাও এবং খালি করো” এর মত কোন আদেশ ছিল, না ছিল “আগুণ লাগাও” গ্রামে গ্রামে এর মত আদেশ। “এটা তো অনেকটাই অসম্ভব,” তিনি বলেন রয়টার্সকে। “এমন কিছু যদি সেখানে থেকেই থাকে, তাহলে অফিশিয়ালি রিপোর্ট করা উচিৎ, এবং এটাকে অফিসিয়ালিই তদন্ত করতে হবে।”
“আপনি যে আমাকে এখন ব্যাপারটা বলেছেন, আমরা তা সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করবো এবং পুনঃরায় চেক করবো,” তিনি যোগ করেন। “এখনের জন্য আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীর জন্যে আদেশ এবং নির্দেশনা ও ধাপে-ধাপে ব্যবস্থাপনা থাকে, এবং তাদের তা অবশ্যই মেনে চলতে হয়। তাই, আমি মনে করিনা এমনটি হয়ে থাকতে পারে।”
সেনাবাহিনীকে মন্তব্যের জন্য করা অনুরোধের তারা কোন সাড়া দেননি।
ইন ডিন গ্রামের ক্লিনিকের একজন মেডিকেল সহকারী অঙ মিয়াত তুন (২০) বলে, সে কয়েকটা লুটপাটে অংশগ্রহণ করেছিল। “মুসলিম ঘরবাড়ি জ্বালানো সহজ ছিল কারণ খড়ের ছাদের জন্য। আপনাকে শুধু ছাদের প্রান্তে আগুণ লাগালেই হবে”, সে বলেছিল। “গ্রামের বড়রা সন্ন্যাসীদের পরিধেয় কাপড় লাঠির শেষপ্রান্তে বেঁধে নিতেন মশাল বানাতে এবং সেগুলো কেরোসিনে চুবিয়ে নিতেন। আমরা মোবাইল ফোন সঙ্গে নিতে পারিনি। পুলিশ বলেছিলো তারা যদি আমাদের কাউকে ছবি তুলতে দেখে তাহলে তৎক্ষনাৎ গুলি করবে এবং মেরে ফেলবে।”
গ্রাম নিরাপত্তা সংঘের নেতাস্থানীয় সদস্য রাতের প্রহরী সান থেইন (San Thein) বলেন, সৈন্যরা প্রথমে মুসলিম পাড়ায় যায়। তারপর, তারা বৌদ্ধ গ্রামবাসীদের পাঠায় ঘর পোড়ানোর জন্য।
“কালাররা (Kalar) পালিয়ে যাওয়ার পর আমরা গ্রামের বাজার থেকে কেরোসিন ফ্রিতে পেয়েছিলাম,” সে বলেছিল, একটি বার্মিজ গালি ব্যবহার করে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের জন্য।
একজন রাখাইন যুবক বলল যে ভেবেছিল সে শুনতে পেয়েছিল একটা পুড়তে থাকা রোহিঙ্গা ঘর থেকে শিশুর চিৎকার। দ্বিতীয় একজন যুবক বললো, সে একটা রোহিঙ্গা ঘর পোড়ানোয় অংশ নিয়েছিল, যেটা ছিল দখলকৃত।
সো চ্যায় (Soe Chay), অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক যিনি ১০জন রোহিঙ্গা পুরুষদের জন্য কবর খুঁড়েছিলেন, বলছেন তিনিও একটি হত্যাকান্ডে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি রয়টার্সকে বলেন, আগস্টের ২৮ তারিখে সৈন্যরা তিনজন পুরুষ এবং একজন নারীকে খুঁজে পায় যারা খড়ের গাদার পেছনে লুকিয়ে ছিলেন। পুরুষদের একজনের কাছে একটা স্মার্টফোন ছিল যা কিনা তাদের অপরাধের ছবি তুলতে ব্যবহার হতে পারত।
সৈনিকেরা সো চ্যায়কে বলেছিল, “তাদের সাথে যা করতে চাও করো”, সে বলল। তারা মোবাইল ফোন সাথে থাকা লোকটিকে নির্দেশ করল এবং তাকে বলল দাঁড়াতে। “আমি তাকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করা শুরু করি, এবং একজন সৈনিক তাকে গুলি করে যখন সে পড়ে যায়।
একই ধরণের সহিংসতা রাখাইনের উত্তরাঞ্চলের বিশাল অংশ জুড়ে চলছে, অনেক অনেক বৌদ্ধ এবং রোহিঙ্গা বাসিন্দাদের মতে।
যুক্তরাষ্ট্রের অপারেশনাল স্যাটেলাইট অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রাম এর ডেটা দেখাচ্ছে রাখাইন রাজ্যে ১১০ কি.মি অঞ্চল বিস্তৃত রোহিঙ্গা গ্রামগুলোর কতটি জ্বালানো হয়েছে তার সংখ্যাটা। নিউইয়র্ক ভিত্তিক হিউম্যান রাইট ওয়াচ বলছে ২৫ আগস্ট হতে তিন মাস পর্যন্ত ৩৫০টির ও বেশি গ্রামে আগুণ দেয়া হয়েছিল, স্যাটেলাইট হতে প্রাপ্ত ছবিগুলোর একটি বিশ্লেষণ অনুযায়ী।
ইন ডিন হতে ৬৫ কি.মি উত্তরের গ্রাম লাঙ্গডনে, থার নাগ (৩৮) বলেছে তাকে বৌদ্ধ নিরাপত্তা সংঘে যোগদান করতে পুলিশ এবং স্থানীয় কর্মকর্তা বলেছিল। “সেনাবাহিনী আমাদের হপও টি কঙ( Hpaw Ti Kaung) এর কালার (Kalar) -দের গ্রামটি পোড়াতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।” তিনি বলেছিলেন, সাথে এটাও বলেন, চারজন গ্রামবাসী এবং ২০জনের কাছাকাছি সৈন্য এই অভিযানে যুক্ত ছিলো। “পুলিশ গ্রামের ভেতরে গুলি চালায় তাই সব গ্রামবাসী পালিয়ে যায় এবং আমরা তাতে আগুন লাগিয়ে দেই। গ্রামটিকে পোড়ানো হয়েছিল কারণ পুলিশ বিশ্বাস করত গ্রামবাসী রোহিঙ্গা সৈন্যদের সাহায্য করত – তাই তারা একে আগুন লাগিয়ে খালি করে দিলো।
লাঙ্গডন (Laungdon) এর ১৫ কি.মি উত্তরে অবস্থিত “টা মান থা (Ta Man Tha)” গ্রামের একজন বৌদ্ধ ছাত্র, বলেছে সে নিজেও রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি জ্বালাপোড়াও-এ অংশগ্রহণ করেছিল। একজন সেনা কর্মকর্তা ৩০জন স্বেচ্ছাসেবক খুঁজছিল “কালার” অধ্যুসিত গ্রাম পোড়াতে, বলল ছাত্রটি। ৫০ জন আগ্রহী হয় এবং মোটরবাইক আর বাজার থেকে জ্বালানি নিয়ে এসে হামলার জন্য জমা করা হয়।
কালার মায়ানমায়ের একটি ক্ষুদ্র জাতি।
“তারা আমাদের কয়েকটা গ্রুপে ভাগ করেছিল। আমাদের গ্রামে সরাসরি প্রবেশের অনুমতি ছিলো না। আমাদেরকে এর চারপাশ ঘিরে ফেলতে হত এবং এগিয়ে যেত হত সেভাবে। সেনাবাহিনী আমাদের সামনে থেকে গুলি ছুঁড়ত এবং সেনাবাহিনী তখন আমাদের প্রবেশ করার জন্য বলত,” সে বলল।
“মুসলিম ঘরবাড়ি জ্বালানো সহজ ছিল কারণ খড়ের ছাদের জন্য। আপনাকে শুধু ছাদের প্রান্তে আগুণ লাগালেই হবে।”
– বৌদ্ধ গ্রামবাসী, অঙ মিয়াত তুন (Aung Myat Tun)
রোহিঙ্গাদের ইন ডিন হতে পালিয়ে যাওয়ার পরে, বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা তাদের সম্পত্তি দখল করে নেয়, যার মধ্যে ছিল মুরগি এবং ছাগল, বৌদ্ধ বাসিন্দারা রয়টার্সকে বলেছিল। কিন্তু সবচেয়ে দামী জিনিস, অধিকাংশই মোটরসাইকেল এবং গরু, ৮ম সিকিউরিটি পুলিশ ব্যাটালিয়ন নিয়ে নিত এবং বিক্রি করে দিত, বলেছেন প্রথম কোন পুলিশ কর্মকর্তা এবং ইন ডিন প্রশাসক মঙ থিয়ে চ্যায় (Maung Thein Chay)। মঙ থিয়ে চ্যায় বলেন, ৮ম সিকিউরিটি পুলিশ ব্যাটালিয়ন এর কমান্ডার “থান্ট জিন ওঁ (Thant Zin Oo)”, রাখাইনের অন্যপ্রান্তের বৌদ্ধ ব্যবসায়ীদের সাথে চুক্তি করে এবং গবাদি পশু বিক্রি করত। পুলিশ কর্মকর্তাটি বলেন, তিনি রোহিঙ্গা গ্রাম থেকে চারটি গরু চুরি করেছিলেন, শুধু থান্ট জিন ওঁ যাতে নিয়ে নিতে পারে এর জন্য।
ফোনে যোগাযোগ করা হলে, থান্ট জিন ওঁ তিনি কোন মন্তব্য করেননি। পুলিশের মুখপাত্র কর্নেল মায়ো থু সো বলেন, লুটপাটের অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে।
এক সেপ্টেম্বরের মধ্যেই, ইন ডিন হতে কয়েকশত রোহিঙ্গা সৈকতের কাছাকাছি অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। তারা তেরপালিন দিয়ে তাদের আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করে, যাতে ভারী বর্ষন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে।
এই দল থেকেই দশজনকে নিয়ে পরদিন সকালে হত্যা করা হবে। রয়টার্স এই দশনের পরিচয় বের করে, ইন ডিন-এর বৌদ্ধ কমিউনিটির সাক্ষীদের সাক্ষ্য নিয়ে, রোহিঙ্গা আত্মীয়স্বজন এবং বাংলাদেশে শরনার্থী শিবিরে থাকা সাক্ষীদের খুঁজে বের করে।
পুরুষদের মধ্যে ৫ জন, দিল মোহাম্মদ (৩৫), নূর মোহাম্মদ (২৯), শকেত উল্লাহ (৩৫), হাবিজু (৪০), এবং শাকের আহমেদ (৪৫) ছিলেন জেলে বা মাছ বিক্রেতা। এই দলের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ছিলেন, আবুল হাশিম (২৫), মাছ ধরার জাল এবং মেশিনের যন্ত্রাংশ বিক্রির দোকান চালাতেন জেলে এবং কৃষকদের কাছে। আব্দুল মজিদ, ৪৫ বছর বয়সী ৮ সন্তানের জনক, যিনি পান দিয়ে মোড়ানো সুপারি বিক্রি করতেন, যা সাধারণত তামাকের মত চিবানো হয়। আবুলু (১৭) এবং রশিদ আহমেদ (১৮) ছিলো হাই স্কুলের ছাত্র। আব্দুল মালিক (৩০) ছিলেন একজন ইসলামিক শিক্ষক।
ঘটনাক্রম
রাখাইনের রাজধানী ‘সিটওয়ে’ থেকে ৫০কি.মি (৩০ মাইল) উত্তরে মায়ো পর্বত এবং বঙ্গোপসাগরের মাঝামাঝিতে অবস্থিত ইন ডিন। এই উপনিবেশটি গড়ে উঠে একটি স্কুল, ক্লিনিক এবং বৌদ্ধ মঠের চারপাশে বিক্ষিপ্তভাবে থাকা বিভিন্ন পাড়া নিয়ে। বৌদ্ধদের ঘরগুলো গ্রামটির উত্তরাংশে অবস্থিত। বেশ কয়েকবছর ধরেই বৌদ্ধ এবং তাদের মুসলিম প্রতিবেশীদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিলো, গ্রামের ৭০০০ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যাদের সংখ্যাটা প্রায় ৯০ শতাংশ।২৫শে আগস্টে, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা রাখাইনে ৩০টি পুলিশ ফাঁড়ি এবং একটি সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমন করে। ইন ডিনের কয়েকশ বৌদ্ধ মঠে আশ্রয় নিয়েছিল সেদিন।
আগস্ট ২৭-২৮ সেনাবাহিনী আসে, রোহিঙ্গারা পালাতে শুরু করে
প্রায় ৮০জন সৈনিক ইন ডিনে পৌঁছায় ২৭ আগস্টে। সেনাবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত অফিসার বৌদ্ধ গ্রামবাসীদের বলেন তারা সিকিউরিটি অপারেশনে তাদের সাথে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিতে পারে, গ্রামবাসীদের মধ্যে ৫ জন বলল। এর পরের দিনগুলোতে, সৈনিকরা, আধা-সামরিক পুলিশ বাহিনী এবং বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা ইন ডিনের অধিকাংশ মুসলিম রোহিঙ্গাদের ঘর জ্বালিয়ে দেয়, এক ডজন বৌদ্ধ বাসিন্দা বলে। বৌদ্ধদের ঘরবাড়ি একদম অক্ষত পড়ে রইল।
২৮ আগস্টে, পশ্চিম পাড়ার মুসলিমরা, যেখানে সেই দশ জন নিহতের বাস, পূর্বদিকের একটা পর্বতে আশ্রয় নেয়, এক ডজনের অধিক ঐ পাড়ার প্রাক্তন বাসিন্দারা বলেছেন যারা বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে আছেন।
সেপ্টেম্বর ১ গ্রেপ্তারের দিন
পাহাড়ে সরবরাহ ফুরিয়ে আসাতে, কয়েকশ রোহিঙ্গা নিচে সৈকতে নেমে আসে, তাদের মধ্যে ঐ দশজনও ছিল যাদের মেরে ফেলা হয়, তাদের পরিবাদের সদস্য এবং প্রতিবেশিরা জানায়। তারা পরিকল্পনা করছিলো সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের দিকে রওনা হবে। একদল সৈন্য এবং অস্ত্রধারী রাখাইন বৌদ্ধ এসে পড়ে। সৈনিকরা ১০জন পুরুষকে তুলে নেয় এবং বলেছে তারা এদেরকে নিচ্ছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য, রোহিঙ্গা সাক্ষীরা বলে।
স্কুল বিল্ডিং-এর কাছে বিকাল ৫টার পর সেই ১০জন পুরুষের ছবি তোলা হয়। তারা সারিবদ্ধ হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে ছিল, হাত ছিল মাথার উপরে। অধিকাংশকে কোমরে বেঁধে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে তাদের স্কুল ভবনের ভেতর নিয়ে যাওয়া হয়, নতুন জামাকাপড় দেয়া হয় এবং খাওয়ানো হয় – একজন বৌদ্ধ সাক্ষী অনুযায়ী ।
সেপ্টেম্বর ২ হত্যাকাণ্ড
সকালে, মানুষগুলোকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বৌদ্ধদের কবরের পাশের একটি ঝোপঝাড়পূর্ণ জমিতে তাদের ছবি তোলা হয়। তিনজন বৌদ্ধ সাক্ষী বলেন তারা একটি কুঁড়েঘর থেকে দেখছিলেন সৈনিকরা দশজন রোহিঙ্গা বন্দিদের একটি পাহাড়ের উঁচুতে নিয়ে যাচ্ছিলো যেখানে তাদের মারা হয় সে স্থানের দিকেই।
জানুয়ারি ১০ এ দেয়া একটি বিবৃতিতে, মায়ানমার মিলিটারি স্বীকার করে যে ১০জন রোহিঙ্গা পুরুষকে গ্রামটিতে হত্যা করা হয়। তারা নিশ্চিত করে যে বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা কিছু পুরুষকে তলোয়ার দিয়ে আক্রমন করে এবং সৈনিকরা বাকিদের গুলি করে হত্যা করে।
১০ জানুয়ারি সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রকাশ করা এক বিবৃতি অনুযায়ী, নিরাপত্তা বাহিনী উপকূল এলাকায় গিয়েছিল যেখানে তাদেরকে “প্রায় ২০০ বাঙালী লাঠি ও তলোয়ার দিয়ে আক্রমন করে।” বিবৃতিটি বলে যে, “যেই মাত্র নিরাপত্তা কর্মীরা আকাশে গুলি ছুঁড়ল, বাঙালী বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল এবং দৌড়ে পালিয়ে গেল। তাদের মধ্যে ১০জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
তিনজন বৌদ্ধ এবং এক ডজনের উপর রোহিঙ্গা সাক্ষীরা ঘটনার এই সংস্করণকে অস্বীকার করে। তাদের প্রত্যেকের ঘটনার বিবরণ কিছু কিছু ব্যাপারে একে অপরের থেকে পৃথক। বৌদ্ধরা সৈকতের কাছাকাছি রোহিঙ্গাদের একটি ছোট দল এবং কিছু সৈন্যের মধ্যে একটি সংঘর্ষের কথা বলেছিল। তবে এক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে মতের মিল রয়েছে, কেউই বলেনি যে মিলিটারি বড়ধরনের হামলার মুখোমুখি হয়েছিল ইন ডিনে।
সরকারের মুখপাত্র জো হতেয় (Zaw Htay) রয়টার্সকে সেনাবাহিনীর দেয়া ১০ জানুয়ারির বিবৃতির কথা উল্লেখ করে এবং এর বেশি কিছু জানাতে নাকচ করেন। সেনাবাহিনীকে কোন মন্তব্যের জন্য অনুরোধ করা হলে সাড়া দেয়নি।
রোহিঙ্গা সাক্ষিরা, যারা সৈকতে অথবা কাছাকাছি ছিল, বলেছে ইসলামিক শিক্ষক আব্দুল মালিক ছেলেদের সাথে তার পাড়ায় গিয়েছিল খাবার এবং আশ্রয়ের জন্য বাঁশ সংগ্রহ করতে। যখন সে ফিরছিল, কমপক্ষে সাতজন সৈনিকের একটি দল এবং সশস্ত্র বৌদ্ধ গ্রামবাসী তার পিছু নিয়েছিল, সাক্ষীরা বলে। আব্দুল মালিক রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে দেখে তাদের দিকে টলতে টলতে হাঁটছিলো, মাথা থেকে টপ টপ করে রক্ত পড়ছিল তখন। কিছু কিছু সাক্ষী বলে তারা দেখেছে, একজন সশস্ত্র লোক আব্দুল মালিকের মাথায় পেছন থেকে আঘাত করেছিল একটি ছুরি দিয়ে।
তারপর মিলিটারি বন্ধুক দিয়ে ইশারা করলো মোটামুটি ৩০০ জন রোহিঙ্গাদের ভিড়ের দিকে, একসাথে ক্ষেতে জড়ো হওয়ার জন্য, এই সাক্ষীরা বলেন। সৈনিকরা এবং রোহিঙ্গারা, মায়ানমারের বিভিন্ন অংশ থেকে আগত, কথা বলে বিভিন্ন ভাষায়। শিক্ষিত গ্রামবাসীরা তাদের সাথের গ্রামবাসীর জন্য তা অনুবাদ করে দিত।
“আমি বেশি কিছু শুনতে পাইনি, কিন্তু তারা আমার স্বামী এবং আরো কিছু মানুষের দিকে ইশরারা করছিল উঠে সামনে এগিয়ে যেতে।” বলেন রেহানা খাতুন(২২), নূর মোহাম্মদের স্ত্রী, অপহতের দশজনের একজন নূর মোহাম্মদ। “আমরা শুনতে পাই তারা পুরুষদের সাথে সাক্ষাত করতে চায়। মিলিটারি বাকিদের বলে সৈকতে ফিরে যেতে।”
সৈনিকেরা ১০জনকে ইন ডিনের স্কুলের একটি ভবনে একটি রাত আটকে রাখে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে। রশিদ আহমেদ এবং আবুলু এইখানে বৌদ্ধ ছাত্রছাত্রীদের সাথে একসাথে এ স্কুলে পড়ালেখা করেছিল ২০১৬ সালের অক্টোবরে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের আক্রমনগুলোর পূর্ব পর্যন্ত। স্কুল সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়, এই দুইজনের শেষ বর্ষটা ব্যহত করে।
সে কবর
রয়টার্স কবরের জায়গাটার ছবি দেখিয়েছে, কিছু নেয়া হয়েছে প্রতিবেদক Wa Lone কর্তৃক, ফরেনসিক এক্সপার্টদের কাছে পাঠানো হয় পরবর্তীতে। তারা মেরুদন্ডের কলাম এবং পাঁজর সহ মানবশরীরের অবশিষ্টাংশ খুঁজে পায়।
“আমি কেবল এটুকুই মনে করতে পারি সে বসে আছে ওদিকে এবং পড়ছে, এবং এটা সবসময়ই আমার জন্য দারুণ ব্যাপার ছিল কারণ আমি শিক্ষিত ছিলাম না,” বলেন রশিদ আহমেদের বাবা, কৃষক আব্দু শাকুর, ৫০। “আমি তাকে পড়তে দেখতে চাইতাম, আমি চাইতাম আমাদের পরিবারের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে শিক্ষিত হতে।”
একটি ছবি, নেয়া হয় যখন মানুষগুলোকে বন্দী করা হয়, দেখাচ্ছে যে ২জন রোহিঙ্গা ছাত্র, আটজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোক হাঁটুগেড়ে বসে আছে গ্রামের ক্লিনিকটির রাস্তার পাশে, অধিকাংশই শার্টবিহীন। প্রথমবার তাদের আটক করার সময় জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়, এক ডজন রোহিঙ্গা সাক্ষী বলেন। এটা এখনও পরিষ্কার নয় কেন। সেই সন্ধ্যায়, বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা বলেন, লোকগুলোকে একদম মাংসের শেষ টুকরো পর্যন্ত “সমাদর” করা হচ্ছিল। তাদের ফ্রেশ কাপড় পরতে দেয়া হয়।
সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে, পুরুষদেরকে গ্রামের উত্তর দিকে একটি জমিতে নিয়ে গেল, বৌদ্ধ বাসিন্দারের জন্য বরাদ্দ কবরের পাশে, ছয়জন বৌদ্ধ গ্রামবাসী বলে। জায়গটাকে আড়াল করেছে গাছপালাভর্তি একটি পাহাড়। সেখানে, তাদের হাঁটু গেড়ে থাকা অবস্থায়, দশজনের আবার ছবি তোলা হল এবং নিরাপত্তা কর্মীরা আবার প্রশ্ন করলো মঙ নী (Maung Ni) নামের স্থানীয় বৌদ্ধ কৃষকের গায়েব হওয়ার ব্যাপারে – একজন রাখাইন প্রবীনের মতে, যিনি বলেছেন তিনি জিজ্ঞাসাবাদের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন।
মঙ্ নী (Maung Ni) এর কি হয়েছিল রয়টার্স বের করতে পারেনি। বৌদ্ধ প্রতিবেশিদের মতে, কৃষকটি ২৫ আগস্ট নিজের গবাদি পশু পরিচর্চার জন্য ঘর থেকে জলদি বেরিয়ে যান, এবং সেদিনই নিখোঁজ হন। কয়েকজন রাখাইন বৌদ্ধ এবং রোহিঙ্গা গ্রামবাসীরা রয়টার্সকে বলেন তারা বিশ্বাস করেন যে তাকে হয়ত মেরে ফেলা হয়েছে, তবে কৃষকের নিখোঁজের সাথে এই দশজনের সম্পর্ক থাকতে পারে এমন কোন প্রমাণ তাদের জানা নেই। সেনাবাহিনী তাদের জানুয়ারি ১০ তারিখের বিবৃতিতে বলেছে, “বাঙালী সন্ত্রাসীরা” মঙ নী (Maung Ni) কে হত্যা করেছে, কিন্তু অপরাধীদের সনাক্ত করতে পারেনি।
২ সেপ্টেম্বর সকালে তোলা ছবিতে রোহিঙ্গাদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন ৮ম সিকিউরিটি পুলিশ ব্যাটালিয়ন এর অধিভুক্ত। রয়টার্স তাদের পরিচয় নিশ্চিত করেছে তাদের দুজনের ফেইসবুক পেইজ থেকে এবং ব্যক্তিগতভাবে দেখা করার মাধ্যমে।
দুই অফিসারের মধ্যে একজন, অঙ মিন, ইয়াঙ্গুন থেকে পুলিশে নিয়োগপ্রাপ্ত, বন্দিদের পেছনে সরাসরি দাঁড়িয়ে। অস্ত্র হাতে ক্যামেরার দিকে তাকায় সে। অন্য অফিসার, পুলিশ ক্যাপ্টেন মোয়ে ইয়ান নাঙ, ডানদিকে একদম উপরের অবয়বটা। কাঁধে রাইফেল নিয়ে হাঁটছে সে।
ডিসেম্বরে যেদিন রয়টার্স এর দুজন সাংবাদিককে আটক হয় তার দুদিন পরে মায়ানমারের সরকার ঘোষণা করে যে, মোয়ে ইয়ান নাঙ কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ‘১৯২৩ অফিসিয়াল সিক্রেট এক্ট’ এর অধীনে তার তদন্ত হচ্ছে।
অঙ মিন, যাকে কোন আইনি ঝামেলায় পড়তে হয়নি, তিনি রয়টার্সের সাথে কথা বলতে রাজি হননি।
তিন বৌদ্ধ যুবক বলেছে তারা একটি কুঁড়েঘর থেকে দেখেছে, সৈনিকরা ১০জন বন্দিদের নিয়ে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে তাদের হত্যা হয়।
‘কবর খনকদের একজন, সো চ্যায়ে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, বলেছেন- মঙ নী এর ছেলেদেরকে প্রথম হামলা চালানোর জন্য আহ্বান করেন স্কোয়াডের দায়িত্বে থাকা সেনা কর্মকর্তা।
সো চ্যায়ের মতে প্রথম পুত্র ইসলামিক শিক্ষককে শিরশ্ছেদ করে। দ্বিতীয় পুত্র আরেকজনের ঘাড়ে আঘাত করে।
“ভাইয়েরা দুইজনকে তলোয়ার দিয়ে হত্যার পর, স্কোয়াড গুলি করলো। একজন লোকের জন্য দুই থেকে তিনটি গুলি,” বলেন সো চ্যায়। দ্বিতীয় একজন কবরখনক, যে নিজের পরিচয় গোপন রাখতে চায়, নিশ্চিত করে যে সৈনিকরা কয়েকজনকে মাত্র গুলি করেছিল।
জানুয়ারি ১০ তারিখের বিবৃতিতে, সেনাবাহিনী বলে যে দুই ভাই এবং তৃতীয় একজন গ্রামের লোক “বাঙালী সন্ত্রাসীদের কেটেছে” তলোয়ার দিয়ে এবং তারপর, গন্ডগোলের মধ্যেই, নিরাপত্তা বাহিনীর চারজন সদস্য বন্দিদেরকে গুলি করে। “গ্রামের যারা এই কেসে জড়িয়ে পড়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সেসব সদস্যদের বিরুদ্ধে যারা ‘আইনের অধীনে জড়িত থাকা’ নিয়মটি ভঙ্গ করেছে,” বিবৃতিতে এমন বলেছে। কিন্তু এটা সে নিয়মগুলো মুখে উচ্চারণ করেনি।
টুন আয়ে, মঙ নী এর ছেলেদের একজন, তাকে হত্যার অভিযোগে আটক করা হয়, তার আইনজীবী বলেন জানুয়ারি ১৩ তারিখে । ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখে রয়টার্স থেকে যোগাযোগ করলে তিনি এরচেয়ে বেশি বলতে রাজি হননি। রয়টার্স অন্য ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়।
অক্টোবরে, ইন ডিন স্থানীয়রা রয়টার্স রিপোর্টারদের পাহাড়ের পিছে ঝোপাঝাড়পূর্ণ একটি জায়গায় নিয়ে যায় যেখানে তারা বলেছে হত্যা গুলো হয়েছে। রিপোর্টটাররা আবিষ্কার করে সদ্য তৈরী হওয়া একটা রাস্তা চলে গেছে নরম একটা স্থানে এবং বোঝা যাচ্ছে সম্প্রতি খোঁড়াখুড়ি হয়েছে, বিচ্ছিন্নভাবে যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হাড়। কিছু কিছু হাড় কাপড়ের মধ্যে আটকে আছে এবং যে দড়িটা দেখতে পাওয়া যায় সেটাও ছবিতে থাকা সে দড়িটার সাথে মিলে যায় যেটা দিয়ে বন্দিদের কব্জি বেঁধে রাখা হয়েছিল। তৎক্ষণাৎ জায়গাটা জুড়ে মৃত্যুর গন্ধ দিয়ে চিহ্নিত হয়ে যায়।
রয়টার্স জায়গাটির ছবি ফরেনসিক এক্সপার্টদেরকে দেখানঃ হোমার ভেঞ্চার, ফিজিশিয়ান ফর হিউম্যান রাইটস এর প্রোগ্রাম পরিচালক; ডেঋক পাউন্ডার, একজন প্যাথলজিস্ট যিনি অ্যামেস্ট্রি ইন্টারন্যাশনাল এবং জাতিসংঘকে পরিমর্শ দেন; এবং লুইস ফন্ডেব্রিডার, আর্জেন্টাইন ফরেনসিক অ্যানথ্রোপলি টিম এর প্রেসিডেন্ট; যারা কবর তদন্ত করছেন ১৯৭০ এবং ১৯৮০ এর তৎকালীন আর্জেন্টিনার মিলিটারির জুনটা তে মারা যাওয়াদের। পরীক্ষিত মানব অবশিষ্টাংশগুলো হল, মেন্ডদন্ড, পাঁজব, স্ক্যাপুলা, ফিমার এবং টিবিয়া।পাউন্ডার বলেছেন যে পশুর হাড়গোড়ের উপস্থিতিও বাদ দিতে পারছেন না।
রাখাইন বৌদ্ধ প্রবীণ রয়টার্সকে একটি ছবি প্রদান করেন যেটায় হত্যাকান্ডগুলোর পরবর্তী অবস্থা দৃশ্যমান। এটাতে, দশজন রোহিঙ্গা একই কাপড় পরিধান করছে যা পূর্ববর্তী ছবির সাথে মিলে যায় এবং তারা একই ধরনের হলুদ দড়ি দিয়ে পরস্পরের সাথে বাঁধা, পৃথিবীর বুকে ছোট্ট একটি গর্তের ভেতর স্তূপীকৃত, রক্তে তাদের চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। আব্দুল মালিক, ইসলামিক শিক্ষক, দেখা যাচ্ছে তাকে শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। আবুলু, স্কুল ছাত্রটি, তার গলায় একটি গর্তের মত ক্ষত। উভয়ের ক্ষত সো চ্যায়ের বিবরণের সাথে সম্পূর্ণ মিলে যায়।
ফন্ডারব্রাইডার এই ছবিটা পর্যালোচনা করেন। তিনি বলেন দুটো দেহতে দৃশ্যমান ক্ষতগুলো “চাপাতি বা ধারালো কিছু দিয়ে গলায় করা আঘাত”- এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
কিছু পরিবার জানতোই না যে তাদের পরিবারের সদস্যকে মেরে ফেলা হয়েছে, বাংলাদেশে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে রয়টার্সের ফিরে আসার আগ পর্যন্ত। “আমি ব্যাখ্যা করতে পারবো না আমি ভেতরে ভেতরে কি অনুভব করছি। আমার স্বামী আর নেই,” বলেন রেহানা খাতুন, নূর মোহাম্মদ এর স্ত্রী। “আমার স্বামী চিরতরের জন্য হারিয়ে গেছে। আমি আর কোন কিছুই চাইনা, কিন্তু তার হত্যার ন্যায়বিচার চাই।” ইন ডিন-এ বৌদ্ধ প্রবীণ ব্যাখ্যা করেছেন কেন তিনি হত্যাকান্ডগুলোর প্রমাণাদি রয়টার্সের কাছে শেয়ার করেছেন, “আমি এই কেসে নিজের পরিচয় দিতে চাইনা। আমি চাই এমন ঘটনা ভবিষ্যতে যেন আর না হয়।”
মায়ানমারে গনহত্যা
রয়টার্সের মূল প্রতিবেদন, Massacre in Myanmar থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি তৈরীতে যাদের অবদান অনস্বীকার্য : Wa Lone, Kyaw Soe Oo, Simon Lewis এবং Antoni Slodkowski
গ্রাফিক্স : Jessica Wang, Simon Scarr এবং Matthew Weber
ছবি এডিটিং : Thomas White
ভিডিওচিত্র : Matthew Larotonda এবং Ryan Brooks
ডিজাইন : Troy Dunkley
সম্পাদনা করেছেন : Janet McBride, Martin Howell এবং Alex Richardson