হাতের উপর হাতের পরশ, রবে না….

u81854_311666_757797২০০০ সালের কোন এক শুক্রবারের কথা।

রাত আটটার বাংলা সংবাদ শেষ। “ইত্যাদি” শুরু হবে। প্রবল আগ্রহ নিয়ে বাসার সবাই টিভির সামনে গিয়ে বসলাম। সে সময় “ইত্যাদি” ছিল বিনোদনের এক অপার উৎস। তো অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর হানিফ সংকেত বললেন, এবার গান গাইতে আসছে ব্যান্ড “দলছুট।“ সে সময় আমি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। ব্যান্ডের গান ছাড়া অন্য কোন গান সেভাবে শুনতাম না। কিন্তু এই ব্যান্ডের নাম তো আমার অচেনা! এটা আবার কোন ব্যান্ড? ভাবতে ভাবতেই দেখি গান শুরু হয়ে গেছে।

দুইজন লোক গান গাইছেন। দুইজনেও আবার ব্যান্ড হয়? এদের মধ্যে একজন একেবারেই লিকলিকে। আরেকজনের ডাকাতের মতো ইয়া বড় গোঁফ। কৌতুহল হল। গান শুনতে লাগলাম। গানের কথাগুলো ছিল এরকমঃ “চড়িয়া মানবগাড়ি, যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি/ মধ্যপথে ঠেকলো গাড়ি, উপায় বুদ্ধি মেলে না/ গাড়ি চলে না…।“ গানটা শুনতে আমার বেশ ভালো লাগলো। একেবারেই অন্যরকম কথা, অন্যরকম সুর। গানের ধরণ সচরাচর ব্যান্ডের গানগুলোর মত না। কিন্তু বয়স তখন খুবই কম আমার। তাই মনের ভিতর গানটা সেভাবে দাগ কাটলো না।

এর মধ্যে চলে গেল ২ বছর। ২০০২ সালে, আমি যখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র, এরকমই এক শুক্রবারের রাতে টিভিতে “ইত্যাদি” শুরু হয়েছে। হঠাৎ দেখি, “দলছুট” এর গান শুরু হবে। মনে পরে গেল সেই দুইজনের কথা। দুইজনের সেই ব্যান্ডের কথা। এর ভিতরে তাদের আর কোন গান আমি শুনিও নি। তো শুরু হলো গান। “ তোমার বাড়ির রঙের মেলায়, দেখেছিলাম বায়োস্কোপ/ বায়োস্কোপের নেশা আমায় ছাড়েনা…।“

আমি খেয়াল করতে শুরু করলাম, আমি ধীরে ধীরে গানটার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে, এ গান তো আমারই মনের কথা! তখন আমার কৈশোরের শুরু। মনের ভেতর সবসময়ই এক কল্পিত প্রেমিকা বাস করতো। আমার মনে হতে লাগলো, আমি যেন তাকে নিয়েই এই গান গাচ্ছি। অদ্ভুত এক ভালোলাগায় আমি আচ্ছন্ন হলাম।

ঠিক সেদিন থেকে আমি “দলছুট” নামের এই দুইজনের ব্যান্ডটার ভক্ত হয়ে গেলাম।

পরের দিনই ক্যাসেটের দোকান থেকে ৩৫ টাকা দিয়ে “হৃদয়পুর” অ্যালবামটা কিনে আনলাম। একে একে শুনতে লাগলাম বাজী, গাড়ি চলে না, চাঁদের জন্য গান। লিকলিকে সেই গায়ক, যার নাম বাপ্পা মজুমদার তার অসাধারণ মেলোডিয়াস গানগুলো ভালো লাগলো। তবে একেবারেই অন্যরকম লাগলো ডাকাতের মতো গোঁফওয়ালা সেই লোকের কিছু গান। আর ভরাট কন্ঠস্বর।

তাঁর নাম সঞ্জীব চৌধুরী।

ছোটবেলা থেকেই আমি কবিতা ভালোবাসি। ভালোবাসি কবিতা লিখতে, কবিতা পড়তে। সঞ্জীবের গানগুলো অন্যরকম লাগার সেটাই ছিল প্রথম কারণ। তাঁর গানগুলো ছিল তাঁর নিজের লেখা। শুনতে গীতিকবিতার মত লাগতো। ধীরে ধীরে যত বড় হতে লাগলাম, “দলছুট” ও জনপ্রিয় হতে লাগলো। তাঁদের দুইজনের সলো অ্যালবামও বাজারে এসে গেছে ততদিনে।

তখন উঠতি বয়স। বাপ্পার গানগুলো গোগ্রাসে গিলি। আর রঙিন স্বপ্ন দেখি। কিন্তু সঞ্জীবের গানগুলো কেন যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। গানগুলো ঠিক প্রেমের না। গানের বিষয়বস্তুও বৈচিত্রময়। কিন্তু একইসাথে আবার খুব কাছের। ঠিক যেন আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া প্রতিদিনের ঘটনাগুলোই তিনি গানে গানে বলে বেড়ান। ২০০৪ সালে বের হওয়া তাঁর “স্বপ্নবাজি” অ্যালবামের “রিকশা কেন আস্তে চলে না” গানটিই শুধু শোনামাত্রই আমার ভালো লেগেছিল। কিন্তু বাকি গানগুলো তখন তেমন ভালো লাগেনি। কারণ তখন বয়স ছিল খুবই কম। দশম শ্রেণীর একজন ছাত্রের পক্ষে সেই গানগুলোর তাৎপর্য বোঝাটা একটু কঠিন ছিল। 

বাকি গানগুলো ভালো লাগার শুরু ধীরে ধীরে। একজন “মানুষ” সঞ্জীব চৌধুরীকে বোঝাটাও।

আমি সঞ্জীবের জীবনী লিখতে বসিনি। আমার মতো ক্ষুদ্র এক লেখকের জন্য সঞ্জীব চৌধুরীর মত একজনকে  নিয়ে জীবনী লেখাটা মানায়ও না। মাত্র ৪৩/৪৪ বছর আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে আসা মানুষটির বিশালত্ব আসলে বলে বোঝানো খুব কঠিন। তিনি চলে গেছেন আজ ৯ বছর। ২০০৭ সাল থেকে ১৯ নভেম্বর দিনটা আমার জন্য ভয়াবহ শোকের। হয়তো আমার মতো আরো অনেকের জন্যই। সঞ্জীব চৌধুরীকে যারা হৃদয়ে ধারণ করেন। তাঁর মৃত্যুর খবর যখন শুনি, বিশ্বাস করতে আসলে কষ্ট হচ্ছিল। এমন প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা, সদা হাস্যময় একজন মানুষ কিভাবে এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে পারেন? একেবারেই অচেনা একজন মানুষের জন্যও যে চোখে পানি আসতে পারে, সেটা সেদিন বুঝেছিলাম।

তাঁর গানগুলো শুনি। কৈশোরে তাৎক্ষণিক ভালো না লাগা গানগুলো ধীরে ধীরে কিভাবে সবচেয়ে ভালো লাগার গানে পরিণত হয়েছে, তা ভাবি। এখানেই তাঁর সৃষ্টির সার্থকতা লুকিয়ে আছে। ধূমকেতুর মতো এসেই হারিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর গানগুলোর জন্ম হয়নি। সেগুলো আসলে ধ্রুবতারা হয়েই জ্বলজ্বল করছে আমাদের ভাবনার আকাশে। দলছুটের “জোছনাবিহার” অ্যালবামটি তাঁর মৃত্যুর পর রিলিজ হয়। সেই অ্যালবামে তিনি যেন বৈচিত্রের এক সুনিপুণ পসরা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। আগের অ্যালবামের গানগুলোর চেয়ে এই অ্যালবামের গানগুলো সবদিক দিয়েই অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী ছিল। যেমন তাঁর লেখনীতে, তেমন তাঁর এবং বাপ্পার গায়কীতে। শেষ অ্যালবাম বলেই হয়তো তাঁর সৃষ্টিশীলতার চূড়ায় তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন।

ব্যান্ডের নাম তিনি দিয়েছিলেন “দলছুট।“ কে জানতো, নামকরণের সার্থকতা তিনি এভাবে করে দিয়ে যাবেন? তিনি দলছুট হয়েছেন ব্যান্ড থেকে। ছেড়ে গেছেন তাঁর স্ত্রী আলেমা নাসরিন শিল্পীকে। একমাত্র মেয়ে কিংবদন্তীকে। তারা এখন কেমন আছেন, কীভাবে আছেন, তিনি জানেন না। অন্যলোকে বসে যে এ দুনিয়ার খবর জানা যায় না! তিনি ছেড়ে গেছেন আমাদের মতো অসংখ্য ভক্ত-শুভাকাঙ্খীদের।

কিছু মৃত্যু আসলে মেনে নেওয়া যায় না। ঠিক যেমন আমি মেনে নিতে পারি না তাঁর এই অকাল মৃত্যু। বারেবারেই মনে হয়, আবার যদি তিনি ফিরে আসতেন! কোন এক রোদ্দুরের বিকেলে। টিএসসির সামনে তাঁর সাথে আমার দেখা হয়ে যেত। হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে এসে তিনি বলতেন, “চল আড্ডা দেই।“ যদিও তাঁর সাথে কোনদিন আমার দেখা হয়নি। কিন্তু যখন থেকে তাঁর গানগুলো বুঝতে শিখেছি, তাঁকে যে কখনোই অচেনা মনে হয়নি! মনে হয়েছে খুব চেনা। ঠিক পাশের বাড়ির বড় ভাইটির মত।

মৃত মানুষের গান শুনতে বড় অদ্ভূত লাগে।

মানুষটা পৃথিবীতে নেই। মাঝখানে চলে গেছে নয়টি বছর। নয় বছরে গ্রীষ্ম এসেছে। চলে গেছে বর্ষা। বিদায় নিয়েছে শীতও। মানুষটি আর ফিরে আসেন নি। ফেরা যায় না। এই বাস্তবের পৃথিবীতে আজ তার শরীরের কণামাত্র অবশিষ্ট নেই।

“সঞ্জীব চৌধুরী” নামে কোন মানুষ আজ এই পৃথিবীতে নেই।

কিন্তু তাঁর গান আছে। তাঁর দরাজ গলা আজো আমি শুনি। ইচ্ছে হলেই শুনতে পারি। মনে হয়, কতইনা কাছে! আমার মত আরো অসংখ্য মানুষ হয়তো তার ভরাট কন্ঠস্বরের সাথে বাস করে আজও। তিনি আমাদের গান শুনিয়ে যান। শোনাতে থাকেন। শোনাতেই থাকেন। ক্লান্তিহীন।

“শিশির ঝরবে সকাল বেলা
আমাকে তুমি করবে হেলা
আমাকে ভালোবাসবে ঠিকই
কিন্তু আমার হবে না…

হাতের উপর হাতের পরশ, রবে না…..”

লেখক সম্পর্কেঃ ইশফাক জামান। পেশায় প্রকৌশলী, নেশায় কবি ও লেখক। শখ কবিতা লেখা, ফিচার লেখা, অনুবাদ করা। বিভিন্ন অনলাইন (অফলাইন ও) ম্যাগাজিনে লেখালেখি করছি বেশ কয়েক বছর। পেশাগত জীবনে Linde Bangladesh Ltd. এ Territory Manager হিসেবে কর্মরত আছি।