আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিনোদনের একটি অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সিনেমা। সিনেমা যে শুধু আমাদের বিনোদনেরই মাধ্যম তাই নয় সিনেমা থেকে আমরা অবচেতনভাবেই অনেক কিছু শিখে থাকি, অনেক কিছু বুঝে থাকি।
প্রতিটা দেশের সিনেমা তাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট, আবেগ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, রুপকথা ইত্যাদিকে গল্পের আকারে সিনেমার মাধ্যমে তুলে ধরে। যখনই আমরা কোন সিনেমার সাথে আমরা আমাদের জীবনের কোন ঘটনা বা আবেগীয় মুহুর্তের মিল খুঁজে পাই তখন সেই সিনেমা দেশ, কাল , সংস্কৃতি ছাপিয়ে হয়ে ওঠে আমাদের আকাংক্ষিত এবং হৃদয়গ্রাহী সিনেমা ।
যাইহোক, আজ আমি তেমনই হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া, ভাবনার জগতে নাড়া দেয়া কিছু কোরিয়ান মুভির গল্প নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। তো চলুন আর কথা না বাড়িয়ে কোরিয়ান সিনেমার জগতে পা বাড়াই।
১ । I Saw The Devil (2010):
IMB Rating: 7.8
পরিচালকঃ জি ওন কিম
অভিনয়েঃ বি ইয়ুং লি , মিন সিক চই, জন হাইয়ক লি এবং আরো অনেকে।
সিনেমাটি এশিয়ান চলচিত্র পুরস্কার, অস্টিন ফিল্ম ক্রিটিক্স এ্যাসোসিয়েশন এ্যাওয়ার্ড , ব্যাক সাং আর্ট এ্যাওয়ার্ড, ব্লু ড্রাগন এ্যাওয়ার্ড , ব্রাসেলস ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল অফ ফিল্ম এ্যাওয়ার্ডসহ মোট ১৬ টি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে এবং আরও ১৯টি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছে।
জ্যাং কিয়ুং চুল একজন ভয়ংকর খুনী । যে কিনা মানসিক ব্যাধিগ্রস্থ। সে খুব ভয়ংকর পদ্ধতিতে এবং নারকীয় কায়দায় একের পর এক খুন করে যেতে থাকে। সে তার শিকারকে এমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে যে তা দেখলে ভয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠতে হয়। সে অনেকটা নাটকীয় কায়দায় তার শিকার হিসেবে নারী ও শিশু মেয়েদেরকে অপহরন করে এরপর পিশাচীয় কায়দায় তাদের খুন করে একধরনের সুখ অনুভব করে। পুলিশ অনেক চেস্টা করেও এটা কোনভাবেই বের করতে পারছিল না যে কে এই খুনী বা কিভাবে কোথায় সে এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাচ্ছে।
একদিন জো ইয়ন, জ্যাং কিয়ুং চুলের শিকারে পরিণত হয় এবং তার বীভৎস মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায় । জো ইয়ন ছিলেন সেই এলাকার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ চিফের মেয়ে । জো ইয়ন এর স্বামী সো হিয়ুন ছিলেন একজন নামকরা গোয়েন্দা কর্মকর্তা । জো ইয়ন এর মৃত্যুর পর সো হিয়ুন প্রতিজ্ঞা করে যেভাবেই হোক সে জো ইয়ুন এর খুনীকে খুঁজে বের করবে তার সর্ব ক্ষমতা দিয়ে । আর এর জন্য যদি তাকে দানব হয়ে অমানবীয় এবং দানবীয় কাজও করতে হয় তবে তাই সে করবে।
এরপর ঘটতে থাকে সব চাঞ্চল্যকর এবং লোমহর্ষক ঘটনা । ঘটনার বীভৎসতা এবং ভয়াবহতা কিছুক্ষনের জন্য হলেও আপনার মনে এক অজানা আতংক তৈরী করবে । সিনেমাটির প্রতিটা দৃশ্যে রয়েছে টান টান উত্তেজনা যা আপনাকে পরে কি হয় কি হয় এটা জানার জন্য উৎসাহী করে তুলবে । তো ঘুরে আসুন এই টান টান উত্তেজনায় ভরপুর সিনেমার জগত থেকে।
২ । Silenced (2011):
IMB Rating: 8.00
পরিচালকঃ ডং হিয়ুক হুয়াং।
অভিনয়েঃ ইয়ো গং, ইয়ু মি জাং, হিয়ন স কিম এবং আরো অনেকে ।
সিনেমাটি ব্লু ড্রাগন এ্যাওয়ার্ড, বাএক সাং আর্ট এ্যাওয়ার্ড, গ্র্যান্ড বেল এ্যাওয়ার্ডসহ মোট ৫টি জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার অর্জন করেছে এবং আরো ৭টি জাতীয় চলচিত্র পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে ।
সিনেমাটি সাউথ কোরিয়ার গুয়াংজু প্রদেশের বাক ও বধিরদের স্কুলে ঘটে যাওয়া একটি সত্য ঘটনার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে ।
কাং ইন হো কোরিয়ার মুজিন শহরের একটি বাক ও বধির স্কুলে শিক্ষক পদে নিযুক্ত হোন। এখানে তাকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর পাঠান। এই স্কুলে যোগদান করার পর কাং ইন হো একটি বিষয় লক্ষ্য করে যে, এখানকার ছাত্র ছাত্রীরা খুব মন মরা হয়ে থাকে এবং তারা ঠিক স্বাভাবিক আচরন করছে না ।
একদিন স্কুল ছুটির পর ইন কাং ইন হো বাড়ি যাবার জন্য গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় সে স্কুল বিল্ডিঙয়ের উপরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় যে, তার ছাত্রী ইয়োরি বিপদজনকভাবে জানালার কার্নিশে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ইয়োরি যে কিনা মানসিক প্রতিবন্ধী।
কাং হো ভয় পেয়ে তাকে তাড়াতাড়ি জানালার কার্নিশ থেকে নামাবার জন্য ইয়োরি এর কক্ষে যায়। এরপর ইয়োরি তাকে এক নিষ্ঠুর জগতের দরজা দেখিয়ে দেয়। যেখান থেকে কাং হো একের পর এক নিষ্ঠুর বেদনাদায়ক ঘটনা উদঘাটন করতে থাকে।
কাং হো জানতে পায় যে, ঐ স্কুলের প্রধান আর সহকারী শিক্ষকরা মিলে এখানকার বাক ও বধির শিশুদের নানাভাবে যৌন নির্যাতন করে। তাদের এই যৌন নির্যাতন থেকে এখানকার ছেলে শিশুরাও বাদ যায়নি। এতসব নিষ্ঠুর এবং বীভৎস নির্যাতনের কথা জানার পর কাং হো মুজিন শহরের একজন মানবতা কর্মীর সো ইয়ো জিন এর সাথে যোগাযোগ করে এই শিশুদের রক্ষা করার জন্য। আদালতে মামলা হয় । এই বাক এবং বধির শিশুরা তাদের সমস্ত বুদ্ধিমত্তা আর ইচ্ছাশক্তি দিয়ে এই মামলায় লড়াই করে। কিন্তু যৌন অপরাধীরা টাকা এবং ক্ষমতা বলে আদালতের এটর্নিকে কিনে নেয় এবং মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের খালাস করে দেয়।
অপরদিকে অপরাধী পক্ষ টাকা দিয়ে এইসব বাক ও বধির শিশুদের অভিভাবকদের কাছে থেকে ক্ষমা পত্র আদায় করে নেয় যার ফলে কাং হো এবং সো ইয়ো জিন এর আর কিছু করার থাকে না। কারণ এই শিশুদের অভিভাবকরা ক্ষমা পত্রে সাক্ষর করার ফলে আদালত আর কোনভাবেই অপরাধীদের সাজা দিতে পারবে না।
কিন্তু নির্যাতিত শিশু জিয়ন মিং সো এটা মেনে নিতে পারে না। সে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পথে নামে। তারপর? তারপর কি হয় তা জানতে হলে ছবিটি দেখতে হবে আপনাদের। আমাদের পৃথিবীতে যেখানে সুস্থ শিশুরাই মারাত্মক যৌন নির্যাতনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকে সেখানে প্রতিবন্ধী শিশুরা কতটা অসহায় এবং দ্বিগুণ ঝুঁকিতে থাকে তা এই সিনেমাটি দেখলে কিছুটা অনুমান করা যায়।
৩ । Love, Lies ( 2016):
IMB Rating: 7.2
পরিচালকঃ হিউং সিক পার্ক।
অভিনয়েঃ জি ওন চই, ও হি চুন, হিয় জু হান এবং আরও অনেকে ।
সো ইয়ুল এবং ইয়ন হি দুজন খুব ভাল বন্ধু। তাদের পরিচয় হয় কোরিয়ার একটি গান শেখার প্রতিষ্ঠানে । সেখানে গান শেখার পাশাপাশি এই দুজনের বন্ধুত্বও গভীর হতে থাকে। তাদের দুজনেরই স্বপ্ন থাকে তারা বড় হয়ে অনেক বড় এবং বিখ্যাত গায়িকা হবে। সো ইয়ুল ইয়ং ও একে অপরকে ভালবাসে । ইয়ং ও একজন বিখ্যাত গীতিকার যার লেখা অনেক গান তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
ইয়ং ও সো ইয়ুলকে খুব ভালবাসতো এবং সো ইয়ুল ও ইয়ং ও কে ভালবাসত। তারা একে অপরের প্রথম ভালবাসা ছিল। কিন্তু তাদের ভালবাসা কিছুদিন পরেই ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যেতে থাকে কারন ইয়ং ও সো ইয়ুলের বান্ধবী ইয়ন হি এর গান শুনে তাকে ভালবেসে ফেলে। ইয়ং ও ইয়ন হি কে তার লেখা গান গাইবার জন্য প্রস্তাব করে। গানের এলবাম বের করার পরিকল্পনা করে। ইয়ন হি গান গেয়ে আস্তে আস্তে অনেক প্রশংসা কুড়োতে লাগল। এভাবে ধীরে ধীরে ইয়ং ও এর সাথে সো ইয়ুল এর দূরত্ব বাড়তে থাকে। একদিন সো ইয়ুল ইয়ং ও এবং ইয়ন হি কে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পায়। তখন সো ইয়ুল উপলব্ধি করে যে , তার প্রথম ভালবাসা ইয়ং ও আর তার নেই।
এরপর সো ইয়ুল প্রতারিত হয়ে বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ নিতে থাকে যা শেষ পর্যন্ত ইয়ং ও এবং ইয়ন হি কে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেয়। এরপর? থাক, এরপর কি হয় তা নাহয় আপনারাই দেখে নিন।
আরো পড়তে পারেন
তিনটি সুপারহিট কোরিয়ান মুভি
দেখতে পারেন বিশ্বনন্দিত কিছু অসাধারণ কোরিয়ান ড্রামা (পর্ব-৩)
দেখতে পারেন বিশ্ববিখ্যাত কিছু অসাধারণ কোরিয়ান ড্রামা (পর্ব- ২)
দেখতে পারেন বিশ্ববিখ্যাত কিছু অসাধারণ কোরিয়ান ড্রামা (পর্ব – ১)