ছোটবেলায় গল্পের বই কিংবা রুপকথার বই আমাদের টানত বিশেষ করে গ্রামের ছবিগুলো। মনে হতো গ্রামগুলো যদি বাস্তবে থাকত তাহলে কত মজাই না হতো।এই রূপকথার গ্রামের দেখা কি আসলে পাওয়া যাবে? কি মনে হয় আপনাদের। সত্যি বলতে কি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এমন কয়েকটি গ্রাম রয়েছে যা রূপকথাকেও হার মানায়। এই রূপকথার মতো গ্রামের দেখা পাওয়া যাবে যদি আপনি এসব গ্রামগুলো দেখার জন্য উদগ্রীব থাকেন। এসব গ্রামগুলো দেখলে আপনার মনে হবে যেন গল্পের বইয়ের পাতা হতে উঠে আসা কোন রূপকথার গল্পের গ্রামের ছবি। অনেকের ধারনা রূপকথার গল্পের বইয়ে যেমন ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশ, বাড়িঘর আর দুর্গের বর্ণনা করা থাকে, ঠিক তেমনটা পৃথিবীতে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু এই ভাবনাটা সম্পূর্ণ ভুল। পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে এমন কয়েকটি গ্রিাম যেখানে রয়েছে অসাধারণ সব বাড়িঘর যা ঠিক যেন রূপকথার গল্পের মতো। যেন তুলে আনা হয়েছে বইয়ের পাতা থেকে। বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে নজর বুলিয়ে নিন ফোটো গ্যালারিতে। সত্যিই ধারণা পাল্টে যাবে।
১. স্লোভেনিয়ার জুলিয়ান আল্পস্
স্লোভেনিয়ার জুলিয়ান আল্পস্ যেন গল্পের বই থেকে যেন উঠে এসেছে আস্ত একটা গ্রাম। পাথুড়ে রাস্তা। ছিমছাম বাড়ি। যার গায়ে রংবাহারি ফুলগাছ। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে এক অনিন্দ্যসুন্দর লেক। সৌন্দর্যের দিক থেকে লেক দেখতে ক্যামেরা বন্দি অনেক সুন্দর একটা ছবির মতো ।
এই গ্রামে লোকসংখ্যা খুবই কম। গ্রামের মধ্যে সব চেয়ে বড় বিল্ডিংটি একটি গির্জা । যার নাম পিল গ্রিমেজ । গির্জাটি ১৫ তম শতাব্দিতে নির্মাণ করা হয়েছে । পিল গ্রিমেজ গির্জাটি সবাই মূলত ব্যবহার করে বিয়ের জন্য ।
২. গ্রাম রিশপ
সাড়ে আট হাজার ফুট উচ্চতায় লেপচা অধ্যুষিত গ্রাম রিশপ৷ পাহাড়ের ধাপে ধাপে নানা রকমের ফুলে ঢাকা ছোট্ট সাজানো গ্রাম রিশপ৷ নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে রিশপ।পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চাষের জমি দেখতে অপূর্ব লাগে৷ রিশপকে ঘিরে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাব্রু, সিনিয়ালচু, পান্ডিম—সহ নানান শৃঙ্গ৷ সারা রিশপে সবসময় অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করে ৷ জঙ্গলের মধ্যে ট্রেক করে যেতে পারেন দেড় কিলোমিটার দূরের টিফিনদাঁড়া ভিউপয়েন্ট৷ সান্দাকফু-র পর রিশপের টিফিনদাঁড়া হল পশ্চিমবঙ্গের উচ্চতম ভিউ পয়েন্ট ৷ এখান থেকে সূর্যোদয়, সূর্যান্ত দেখার অভিজ্ঞতা ভোলার নয় ৷ পাখি দেখা-পাখির ছবি তোলার জন্য অন্যতম সেরা গন্তব্য হল রিশপ ৷ গোটা গ্রাম ঘুরে বেরালেই চোখে পড়বে জার্ক সাইডেড ফ্ল্যাই ক্যাচার, ভার্ডিটার ফ্ল্যাইক্যাচার, গ্রিন ব্যাকেট টিট, রুফাস সিবিয়া প্রভৃতি নানা চেনা-অচেনা পাখি৷ নেওড়াভ্যালি জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন এই গ্রামের চারিদিকে জঙ্গল ৷ মাঝেমধ্যেই সবুজ উপত্যকায় এসে আটকে পড়ে মেঘ৷ তখন গোটা উপত্যকা জুড়ে চলে মেঘ-রোদ্দুরের খেলা৷ বর্ষা এবং শীতকাল এড়িয়ে যেকোনও সময়ই যাওয়া যেতে পারে রিশপ ৷
৩. ফ্রান্সের কাগনেস-সুর-মে
ফ্রান্সের কাগনেস-সুর-মের প্রদেশে গেলে মনে হবে কোনও এক রূপকথার দেশে চলে এসেছেন। এটি ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত। গ্রামটির যেন শিল্পীর ক্যানভাস হতে উঠে আসা কোন চিত্রকর্ম। আঁকাবাঁকা ছিমছাম রাস্তা। কাঠের তৈরি বাহারি আকৃতি ও রংঙের বাড়িঘর, পার্ক। বাড়িগুলোর মাঝে বিশাল আকৃতির জায়গা নিয়ে আছে সেন্ট জেকবস্ চার্চ। গ্রামের চারদিকে সবুজের ছড়াছড়ি।
৪. জাপানের গোকায়ামা
ছিমছাম, নির্জন এবং জাজানো আরেকটি গ্রাম হল জাপানের গোকায়ামা। শীতকালে সাদা পুরু বরফে ঢেকে যায় গোটা গ্রামটি। গ্রামের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু ছোট ছোট সাজানো কটেজ। আর ইতিউতি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাইনের সারি। গ্রামের পাশে বুক চিঁড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গগনচুম্বী পাহাড়। চোখের সামনে এসবই যেন স্বপ্ন। বাড়র পাশের নানারঙের গাছপালা ও ফুলের বাগান অপরূপ মনোরম পরিবেশের সৃষ্টি করে ।
৫. ছবির মতো গ্রাম লালজল
ঝাড়গ্রামে অবস্থিত পাহাড়ের মাঝে ছবির মতো গ্রাম লালজল। বেলপাহাড়ির এই গ্রামে আছে আদিম মানব গুহা-সহ বহু প্রাচীন নিদর্শন। প্রত্ন গবেষকদের ধারণা, কয়েক হাজার বছর আগে লালজলই ছিল প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ ক্ষেত্র। এখানকার ঝরনার জল সামান্য লালচে। তামা ও লোহা মিশ্রিত জল কিন্তু বেশ সুস্বাদু। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, লাল রঙের এই জলের কারণেই গ্রামটির নাম লালজল। চার দিকে পাহাড়ের মাঝে এই গ্রাম। গ্রামের পশ্চিমে দেওপাহাড়ে রয়েছে আদিম মানবের গুহা। দক্ষিণ পূর্ব অংশ জুড়ে সিংলহর পাহাড়ের শ্রেণি। আর গ্রামের উত্তরে রয়েছে রানিপাহাড়। দেওপাহাড়ে আদিম মানবের গুহাটি দেখতে হলে পাহাড়ের খাজ ধরে সতর্ক ভাবে উঠতে হয়।
৬. সান্তরিনি
গ্রীসের সান্তরিনি দ্বীপ এবং এই দ্বীপকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা গ্রামটি তার চিত্রবৎ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের দ্বারা হাজার হাজার দর্শককে আকৃষ্ট করে। সান্তরিনি, গ্রীসে অবকাশ যাপনের এক চুম্বকীয় অভিজ্ঞতা প্রদান করে এবং হাজার হাজার দর্শক সবচেয়ে এক অন্যতম নাটকীয় ভৌগলিক দৃশ্য দৃষ্টিভরে দেখার জন্য প্রতি বছর এখানে। গ্রামের ঘরগুলির স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন, যা পর্যটেকদের মবমময় আকর্ষণ করে। এছাড়াও রয়েছে একটি মিউজিয়াম যেখানে দ্বীপটির ঐতিহাসিক অতীতকালের খনিজ, হস্তনির্মিত ও ভাস্কর্য্যের সংগ্রহ রয়েছে। গ্রামের চারদিকে গভীর নীলাভ সৈকত, বর্ণময় বালুকা । সারা বছর মাথার উপর থাকে ঝকঝকে সূর্য। আর নীচে গ্রিসের এজিয়ান সমুদ্রের মাঝে রঙিন শহর সান্তরিনি।
৭. জার্মানির রদেনবার্গ
জার্মানির শমবার্ক জেলায় উত্তর-পশ্চিম পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অবস্থিত রদেনবার্গ গ্রামটি। একেবারে পিক্চার পারফেক্ট জার্মানির রদেনবার্গ । নীল জলরাশি। মাঝে সবুজ সমভূমি। তার মধ্যেই কোথাও কোথাও রয়েছে উঁচু পাহাড়। ছোট ছোট চোখ ধাঁধানো ঝর্ণা বেয়ে আসছে সবুজের বুক ছুয়ে । সবকিছু যেন রূপকথার মতো।
৮. ইতালির বাগনোন গ্রাম
ইতালির বাগনোন গ্রাম অনায়াসেই ‘গেম অফ থ্রোনস্’-এর শুটিং স্পট হতে পারে। সকালে ঘুম ভেঙে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেলেন আদিগন্ত নীলরঙা ফেনিল সমুদ্র। যার বুক চিঁড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গগনচুম্বী পাহাড়। সোগর ও পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে ছোট এই গ্রামটি দেখতে এক কথায় অসাধারণ।
৯. মাওলিননং
ওয়ার্ল্ড ক্লিনেস্ট ভিলেজ’ বলা হয় গ্রামটাকে! ছবির মতো সুন্দর এই গ্রামটি ভারতের মেঘালয়ে অবস্থিত । মেঘেদের আলয়ই বটে, প্রায় সময়ই মেঘেরা এসে অভ্যর্থনা জানিয়ে যায় সবাইকে। গ্রামের নামটাও কী মিষ্টি, মাওলিননং, ছবির মতো সুন্দর পথ ঘাট। ঘন নীল আকাশ, সবুজে ভরা গাছগাছালি, রকমারি ফুলবাহারি, কত প্রজাপতির ওড়াউড়ি, মন চাইবে সারাজীবন এখানেই থেকে যেতে! কী সুন্দর করে বাড়িগুলো সাজানো, পিচ কালো রাস্তাটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে তার গন্তব্যে। শান্ত, হাসি মুখের মানুষগুলো আমাদের দেখলেই মিষ্টি করে হাসছে। এ গ্রামের সবাই শিক্ষিত আর সুন্দর রুচির ছাপ সর্বত্র।
১০. অস্ট্রিয়ার হ্যালস্স্ট্যাট।
অস্ট্রিয়ায় অবস্থিত হ্যালস্স্ট্যাট গ্রামটি সারাবছর লবন উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। গ্রিামটির পাওশ বয়ে গেছে একটি লেক। সার দেওয়া দূর্গের মতো অট্টালিকাগেুলো দেখলে আপনার মনে হবে যেন গল্পের বইয়ে পড়াকোন দৈত্যের আবাসভূমি।
১১. ছবির মতো ছোট্ট গ্রাম নামথাং!
ভারতের সিকিমের প্রবেশপথ রংপো থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের কোলে ছোট্ট গ্রাম নামথাং। অপূর্ব সুন্দর এই জায়গাটিতে এখনও সে ভাবে পা পড়েনি পর্যটকদের।
এখানে ভুটিয়া, লেপচা এবং নেপালী— এই তিন ধরনের জনজাতিই মিলেমিশে বসবাস করেন। ফলে সুন্দর এক মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে ছবির মতো সুন্দর এই গ্রামটি ঘিরে। এখানে ট্রেকিং রুট ছাড়াও রিভার রাফটিং, প্যারাগ্লাইডিং করার সুযোগ পাবেন পর্যটকেরা। তবে নামথাং-এর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ‘নাগি পোখারি’ উৎসব। প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি, এই তিন দিন ধরে উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। সিকিমের আঞ্চলিক সংস্কৃতির অপূর্ব নিদর্শন এই নাগি পোখারি উৎসব।
১২. দ্বীপ হামনি
অস্ট্রেলিয়ার সেন্ট্রাল কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের কুম্বারল্যান্ড দ্বীপের উত্তর সীমান্তে পর্যটকদের আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু দ্বীপ হামনি। চারদিকে সমুদ্র। মাঝে ছোট্ট দ্বীপ হামনি। পর্যটকদের থাকার জন্য রয়েছে সকল সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন আধুনিক রিসোর্ট।
লিখেছেন প্রকাশ কুমার নাথ।