গল্প- আয়না বাজির বাপ

নরেন কুমার পোদ্দার, আমার রুমমেট । প্রায় তিনমাস হলো সে – আমার সঙ্গে পোষাক কারখানায় সুপারভাইজার পদে চাকরি করছে । এতদিন বাহিরের হোটেলে মেস করে খাবার খেত । এখন আর তার বাহিরের খাবার ভাল লাগেনা । তাই রুমেই রান্না শুরু করেছে ইদানিং । সে আলাদা রান্না করে, আমিও আলাদা রান্না করি । আমি এঁশার নামাজ পড়ে ভাত খেতে বসলাম । নরেন পোদ্দার, সবজির প্লেট নিয়ে আমার সামনে এসে বসলো । আমার প্লেট ভর্তি গরুর মাংস আমি নিজেও লজ্জায় কিছু বলতে পারছি না । দাদা এক পিস ! নরেন পোদ্দার , মুচকি হেঁসে ওঠে গেল ।বড্ড মায়া হয় বেচারা কে দেখলে। খুব সহজ সরল ধাঁচের মানুষ । ভিতরে তার চোরাবালির নিপুণ কারুকাজ ।

কামারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া আমার । তার পর বাবার চাকরির সুবাদে চলে আসি টাঙ্গাইলের আকুর টাকুর পাড়ায় । আমার কাছে এখানকার সব কিছু অপরিচিত । সুমন, নামের একজনের সঙ্গে পরিচয় । অল্পদিনে আমার সঙ্গে তার ভাল বন্ধুত্ব হয়ে উঠলো । আমি কলেজের প্রথম বর্ষে। রিমি, আমার পছন্দের একজন ।সুমনের সঙ্গে রিমির বেশ খাতির। প্রণয়ের শেষ বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে ওরা দু’জন । হিন্দু পাড়ায় বেশ আড্ডা সুমনের । আমি অনেক কিছু যোগ-বিয়োগ করি ।রিমি আমার সঙ্গে সম্পর্ক করতে নারাজ তৃতীয় পক্ষ আমাকে বলেছিল এমনটি । পরাজয় মেনে নেওয়া আমার সহ্য হচ্ছিলো না । তাই সুকৌশলে সুমনকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলাম । শেষ রক্ষা আর হলো না আমার । নাটকীয় ভাবে সেই খুনের সাক্ষী রিমি ও তার বাবা । আমার চৌদ্দ বছরের জেল ।

একদিন পরিচয় পর্বে নরেন কুমার পোদ্দার, বলেছিল, তার বাড়ি টাঙ্গাইলে । সেদিন থেকে তার প্রতি আমার জানার আগ্রহটা বেড়ে যায় । সুখে-দুখে আমার সব কথা তাকে বলি, সেও আমাকে বলে । তার অপ্রকাশ যোগ্য কিছু কথা আমাকে বলেছিল । তাকে বুকে টেনে নিয়ে ছিলাম অল্প সময়ে ।নরেন কুমার পোদ্দার, স্বল্প শিক্ষিত মানুষ; আমিও ঠিক তার মত-ই । নরেন কুমার রিমিকে কে চিনতো ! তবে তা আপেক্ষিক । মানুষকে ভুলতে কত কিছু লাগে ।এক রিমিকে ভুলতে গিয়ে ম্যানি ব্যাগের চিপায় এখনও পাঁচ টাকার কয়েন খুঁজে বেড়াই একটা স্টার সিগারেট কেনার নেশায় ।আমার হৃদয় পুড়ে ধোয়াটে গন্ধ বের হয় । রিমি এখন সংসারের সুখের জন্য শনিবারের পূজায় মগ্ন ! ধুপ-শিখা জ্বলাতে ।

নরেন কুমার পোদ্দার রুমে প্রচুর বই পড়ে গভীর রাত জেগে বই পড়বার মজা তার আছে অন্য রকম। বৃষ্টির দিনে অফিসে ভিজে যেতে তার ভাল লাগে হয়তো ।সন্ধ্যায় বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় ফিরবে।সকালে উঠে গুন-গুন করে গান ধরবে। সত্যিকার অর্থে খুব মজার একজন মানুষ। কেউ কিছু চাইলে তাকে আমি কখনো না করতে শুনি নেই । ঠোঁটের কিনারে এক চিলতে হাসি লেগে থাকে সব সময় । নরেন কুমার পোদ্দার আমার হাতের ভিতর পাঁচশত টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বললো, “রুমমেট আজ গুরুর মাংস খাবো !” আমি অবাক বাক রুদ্ধ! বলে কী ? থমকে যাই-আমি ।

“নরেন কুমার পোদ্দার হয়ে আর থাকতে পারছি না ? আনোয়ার ভাই ! আমি মোঃ সাইফুল ইসলাম । একটা চাকরির জন্য কত জায়গায় হণ্য হয়ে খুঁজেছি । কেউ দেয়নি একটি চাকরি।অনাশ্রিত হয়ে রাস্তায় রাস্তায় চলেছি দিনের পর দিন ।নিউ মার্কেট থেকে সতেরশো’ টাকা দিয়ে নরেন কুমার পোদ্দার এর এই নকল সার্টিফিকেট কিনেছিলাম । আর তা-দিয়েই চলছে আমার কর্ম , চলছে সংসার ।ইট পাথরের এই শহরে আমি সাইফুল হয়ে গেলাম নরেন বাবু । আমার কথা শুনে চোখের জল অপসারিত করছে আনোয়ার ভাই । তুমি কাঁদছো কেন? কাঁদতে বারণ করিস না ।এ অশ্রু আনন্দের রে নরেন কুমার । সেদিন থেকে আমার জীবনে যোগ-বিয়োগ হলো অনেক কিছু । এ যেন হারিয়ে যাওয়া ভাইকে ফিরে পেলাম । আনন্দে চিৎকার করে কাঁদলাম দু’ভাই । জীবনের তাগিদে বদলে যায় মানুষ । পরিচিত মুখগুলো কেন যেন স্বার্থ পরের মত বার বার আমাকে পিছনে ফেলে রাখতে চায় ।

আলো অন্ধকারের খেলায় কেউ-কেউ স্বেচ্ছায় হেরে যায় অবলীলায় ,তবুও জীবন । ছুটির দিন দেখে আসা আয়না বাজি সিনেমা , তোমার গল্পের কাছে হেরে যায় নরেন কুমার পোদ্দার । হেরে যায় আমার চৌদ্দটি অন্ধকার বছর ।তবুও তুমি জয়ী হতে পেরেছো । তুমি সত্য বলতে শিখে গেছো । শুধু এই আমি সত্য বলতে শিখতে পারলাম না । সত্যের মৃত্যু নেই ।