অর্ণব দে সরকারের গল্প- দুই হাত

ট্রেন লাইনের উপর পা ফেলে মন্থর গতিতে হাটছিলো তিতলি। সরু লাইনের উপর পা ফেলে ভারসাম্য রেখে হেঁটে চলা তিতলির ছোটবেলা থেকেই অভ্যাস, যখনই  মনখারাপ লাগে তিতলি এইভাবে বেরিয়ে পরে, কখনো তো দুতিনটা স্টেশন পেরিয়ে যায়  মনের অজান্তে। আজ মন খারাপ করে  সে ভোররাতেই বেরিয়ে পড়েছিল। ছোট ভাইটার কাশি বেশ কদিন হলো কিছুতেই সারছে না. মাঝেমধ্যে মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। সুনন্দ তার নিজের ভাই না, তিতলির যখন দুবছর বয়স , তার মা মারা যায়।  বছর ঘুরতেই তিতলির মদ্যপ বাবা ঘরে তোলে তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীকে , সাথেই তার দুমাসের ছেলে। সৎমা তিতলিকে কোনোদিন মেনে নিতে না পারলেও সুনন্দ দিদি অন্তঃপ্রাণ। আধোআধো বুলিতে সে যখন প্রথমবার ‘তিততি , তিত্তি ‘ করে ডেকেছিল কোনো জানিনা চোখের জল আর বাঁধ মানতে পারেনি। ফল্গু নদীর ধারা প্লাবিত হয়েছিল তিতলির দুচোখ হতে. সুনন্দ না থাকলে হয়তো, মা কবেই তাকে ঘর থেকে বের করে দিতো!

রেল লাইন এর ধারে  আবর্জনা কুড়ায় তিতলি, কাগজ বোতল যা পায়ে তাই স্টেশনের  দীনুদাকে বিক্রি করে , এভাবেই নিজের পড়াশুনা চালিয়ে এসেছে এতদিন।স্বপ্ন দেখে কোনোদিন বাড়ছে সরকারি চাকরি করবে , নিজের পায়ে দাঁড়াবে আর দুই হাতে রোজগারের করবে। “দুই হাত” মা ছোট বেলায় বলতো ‘ ভুজার শক্তি অনেক বেশি রে তিতলি, দেখিসনি যে মা দুর্গার অপর নাম দশভুজা ‘. যদি শারীরিক বলপ্রয়োগে  যাস বাহুর জোর লাগবে গতর  দিয়ে খাটতে  হবে আর পড়াশুনা করলে মনে রাখবি যে কলমের মার্ শ্রেষ্ঠ মার্।  ‘ মায়ের কথাগুলো আজও কানে বাজে।  এখনো তো তাকে দৈহিক র মানসিক দুইইই পরিশ্রম করতে হচ্ছে, উপরে আবার ভাইয়ের অসুখ। ‘হে ভগবান কি যে করি ‘— একটা দীর্ঘ্যশ্বাস  ফেলে তিতলি। ছটা  প্রায় বেজে এলো , রেলের ধার শীতের চাদর ছেড়ে কর্মব্যস্ত হবার পথে এগোচ্ছে, এইসময় উল্টোদিক থেকে একটি ট্রেন যাবার কথা. লাইনের  পাশে রমেশের মা ছাই নিয়ে বাসন মাজছে, মুখে কালশিটে দাগ ; কালিকাকু রোজ রাতে মদ খেয়ে এসে বৌয়ের গায়ে হাত তোলে।

‘দিদি’____ ভোরের নিস্তব্ধতা খানখান করে দিয়ে সুন্দর ডাকটা  ভেসে এলো তিতলির কানে। নজর গেল কিঞ্চিৎ দূরে ফিসপ্লেটে পা আটকে দাঁড়িয়ে আছে সুনন্দ। ওদিকে আপের ট্রেন এলো বলে; সর্বনাশ!! গায়ের সমস্ত আলস্য ঝেড়ে দিয়ে দৌড়ে গেল তিতলি।…. “ওরে হতভাগা তুই এখানে কি করে??” বলতে বলতেই ঝটিতি হাত লাগিয়েছে ভাইয়ের পা ছড়ানোয়।  “আঃআঃ দিদি দিদি লাগছে!!”– চিৎকার ছেড়ে কাঁন্না জুড়েছে সুনন্দ। এরকমভাবে কিভাবে আটকালি! দুই পাটাতনের মাঝে পা দুইটা পুরো জুড়ে বসে গেছে । ওদিকে তীব্রআলোর সাথে ট্রেন তা সামনের বাঁক  ঘুরেছে। ভোরবেলার ঠান্ডাতেও তিতলি প্রথমবার অনুভব করলো আলোর উষ্ণতা।  শরীরে সমস্ত মোচড় দিয়ে তিতলি মুক্ত করলো ভাইয়ের পাদুটোকে, ছুঁড়ে দিলো লাইনের ধারে।  ঘড়ঘড় শব্দে ট্রেনটা  চলে গেল- সাথে তিতলির  হাতদুটোও।