আপনি হয়তো ফ্লাইং ডাচম্যান সম্পর্কে একটি বা দুটি কথা জেনে থাকবেন “পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ান : ডেড ম্যান চেস্ট” এর বদৌলতে। মূলত জলদস্যুতা নিয়ে হলিউড ফ্র্যাঞ্চাইজিতে ফ্লাইং ডাচম্যান সমুদ্র জুড়ে এক কুখ্যাত কিংবদন্তি।
জাহাজের নাবিকরা এই ফ্লাইং ড্যাচম্যানের হিংস্র, ভয়ঙ্কর শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হলে তারা তাদের মানবতাবোধ হারিয়ে ফেলে। তবে যাই হোক, পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ানের ধারণা এর স্ক্রিনরাইটারের না। তিনি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন মূলত, ফ্লাইং ডাচম্যান এর কিংবদন্তি থেকে।পৃথিবীর বিশাল একটা জায়গা জুড়ে আছে সমুদ্র। বিশাল সমুদ্রের বুকে লুকিয়ে রয়েছে অনেক রহস্য। সাগরের বুকের এমনি এক রহস্যের নাম “দ্য ফাইং ডাচম্যান” নামের একটি জাহাজ।
ফ্লাইং ডাচম্যান হলো একটি কিংবদন্তী ভূতুরে জাহাজ, যা কোনোদিন কোথাও নোঙ্গর করেনি এবং সমুদ্রযাত্রায় চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে। ভুতূড়ে জাহাজ নিয়ে যত লোককাহিনী প্রচলিত আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত/কুখ্যাত এই “ফ্লাইং ডাচম্যান”। জাহাজটি কবে কোথায় তৈরী হয়েছিল তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন পর্তুগিজ নথিপত্র অনুসারে এই জাহাজটি ষোড়শ শতকের কোনো এক বছরে যাত্রা শুরু করেছিল। এটি ওলন্দাজদের তৈরি ছিল। ওই সময়ে ওলন্দাজরা সমুদ্রাযাত্রায় সবচেয়ে বেশি পারদর্শী ছিল।
এই লোককাহিনীটির উৎপত্তি মূলত ১৭ শতকের সামুদ্রিক লোকাঁচারবিদ্যা থেকে। প্রাচীন নথিপত্রে এই জাহাজটিকে ১৮ শতকের শেষের দিকের জাহাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রচলিত রয়েছে, ১৯ ও ২০ শতকের দিকে সমুদ্রের মাঝে জাহাজটিতে ভূতুরে আলো দেখা যেত। ফ্লাইং ডাচম্যান যখন কোনো জাহাজকে অতিক্রম করতো তখন এর ক্রুরা বহুদূরের প্রেতাত্মা বা অশুভ শক্তিকে বার্তা পাঠাতো। সামুদ্রিক কিংবদন্তী অনুসারে, অভিশপ্ত জাহাজটি ঝড়ের কবলে পড়ে সমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিল।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাড়া বিশ্বে নাবিকদের মাঝে এই অভিশপ্ত ও ভৌতিক জাহাজটির কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। অনেক নাবিক মনে করেন, জাহাজটি ও তার ক্রুরা সকলেই অভিশপ্ত এবং ঈশ্বরের অভিশাপের কারণেই তারা কোনোদিন নোঙ্গর করতে পারেননি। লোককাহিনী অনুসারে, ফ্লাইং ডাচম্যান সমুদ্রে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ায় এবং এটি যেমন সমুদ্রে হঠাৎ করেই অবির্ভাব হয় তেমনি হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায়। অনেক নাবিকরা তাদের জীবন বাজি রেখে ফ্লাইং ডাচম্যানকে তাদের জাহাজের পাশ দিয়ে যেতে দেখেছেন বলে বর্ণনা করেছেন।
লিখিত সংস্করণে ফ্লাইং ডাচম্যান সম্পর্কে প্রথম জানা যায় জর্জ বেরিংটন (১৭৫৫-১৮০৪) সংকলিত অ্য ভয়েজ টু বোটানি বে (১৭৯৫) (অ্য ভয়েজ টু নিউ সাউথ ওয়াল্স নামেও পরিচিত)-এর ষষ্ঠ অধ্যায়ে :
“ আমি প্রায়ই নাবিকদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন কাহিনীগুলো শুনতাম কিন্তু প্রতিবেদনগুলোতে কাউকেই খুব বেশি কৃতিত্ব নিতে দেখিনি; এটা মনে হচ্ছে যে, কয়েক বছর পূর্বে একজন ওলন্দাজ লোক যুদ্ধে কেপ অফ গুড হুপে হারিয়ে যান এবং জাহাজের ডেকের সকল নাবিকই অভিশপ্ত হয়ে যান। এসময় জাহাজটি মাঝ সমুদ্রে একটি ঝড়ের কবলে পড়ে এবং শিঘ্রই কেপ টাউনে এসে পৌঁছেন। পরবর্তীতে জাহাজটিকে সংস্কার করে ইউরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার জন্য প্রস্তুতি নেন কিন্তু একই অক্ষাংশে ভয়াল একটি ঝড়ে ফ্লাইং ডাচম্যান জর্জরিত হয়। একই রাতে কিছু লোক দেখেছিল অথবা দেখেছিল বলে কল্পনা করেছিল, একটি জাহাজ তাদের জন্য ঝড়ের মধ্যে যাত্রা করার উদ্দেশ্যে অপেক্ষা করছে। জাহাজটি যেমন হঠাৎ করেই উদয় হয়েছিল তেমনি হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে কাহিনীটি নাবিকদের মনে স্থান করে নিয়েছিল এবং যখন তারা নিজ নিজ দেশে ফিরে আসে তখন কাহিনীটি ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পরে এবং জাহাজটির নাম দেওয়া হয় ফ্লাইং ডাচম্যান। সেসময়কার ওলন্দাজদের কাছ থেকে ইংরেজ নাবিক ও কিছু ভারতীয় নাবিকও মনে করেন জাহাজটির ডেকে তারা কিছু প্রেতাত্মা দেখেছেন।”
জাহাজটি নিয়ে যেসব কাহিনী প্রচলিত রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলে— ১৭২৯ সালে “ফ্লাইং ডাচম্যান ১” নামে একটি ওলন্দাজ জাহাজ, যার ক্যাপ্টেন ছিলেন হেনড্রিক ভ্যান্ডারডেকেন। জাহাজটি কেপ টাউনের দিকে যাচ্ছিল কিন্তু যাত্রা পথে ঝড়ের কবলে পড়ে কিন্তু জাহাজে ক্রুরা ভয় পাওয়া স্বত্বেও ক্যাপ্টেন হেনড্রিক জাহাজটি কেপ টাউনে নিয়ে যাওয়ার জন্য সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। এক পর্যায়ে নাবিকদের কিছু অংশ বিদ্রোহ করে কিন্তু ক্যাপ্টেন বিদ্রোহীদের গুলি করে হত্যা করেন ও লাশ সাগরে ভাসিয়ে দেন। এরপর থেকে জাহাজটি সমুদ্রে চিরতরে হারিয়ে যায়।
অপর কাহিনীমতে— ১৭২৯ সালে ফ্লাইং ডাচম্যান এর ক্যাপ্টেনের উপর শয়তান কোনো কারণে অসন্তুষ্ট হয়ে অভিসম্পাত করে যে, এই জাহাজ নিয়ে ক্যাপ্টেন অনন্তকাল সমুদ্রে ভাসবে। তাঁর মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে কোন বিশ্বস্ত নারীর সত্যিকার ভালবাসা। তাই ধারণা করা হয় যে ফ্লাইং ডাচম্যান তার ক্যাপ্টেনসহ মাঝে মাঝে আবির্ভূত হয় সেই বিশ্বস্ত নারীর খোঁজে, মুক্তির আশায়।
লোকমুখে শোনা যায যে, দ্য ফ্লাইং ডাচম্যানকে নাকি পরবর্তীতে ভূত-জাহাজ হিসেবে বেশ কয়েক বার সমুদ্রে দেখা যায়, বিশেষ করে ঝড়ের মধ্যে।
ফ্লাইং ডাচম্যানকে স্বচক্ষে দেখেছেন বলে কেউ কেউ দাবিও করেছেন।
১৮৩৫ সালের একটি ব্রিটিশ জাহাজের ক্যাপ্টেন জাহাজটিকে দেখতে পেয়েছিলেন। তার লগবুকে লেখা ছিল যে— তারা সমুদ্রের মাঝখানে ঝড়ের মধ্যে আবৃত একটি জাহাজ দেখতে পেয়েছিলেন, যেটা সোজা তাদের জাহাজের দিকে ঝড়সহ এগিয়ে আসছিল। এক পর্যায়ে এত কাছে এসে পড়েছিল সেই ঝড়-আবৃত জাহাজটি, তারা ভয় পেয়ে যান, যে এখনই জাহাজ দুটিতে সংঘর্ষ হবে। কিন্তু হঠাৎ করেই ঝড়সহ ভুতুড়ে জাহাজটি গায়েব হয়ে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নিকোলাস মোন্সার্ট নামের এক নাবিক প্যাসিফিক সাগরে ফ্লাইং ডাচম্যান নামের জাহাজটিকে দেখেছিলেন বলে দাবি করেন।
জাহাজটাকে নিয়ে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটে ১৯৩৯ সালের মার্চে। দক্ষিণ আফ্রিকার গেগেনকেইন বিচে জড়ো হওয়া কিছু মানুষ অবাক হয়ে দেখে, সপ্তদশ শতাব্দীর একটা পালতোলা জাহাজ ধীরে ধীরে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সমুদ্রতীরে আঘাত হানবে ওটা। সমুদ্রে একটু বাতাস না থাকলেও পাল ফুলিয়ে তরতর করে এগিয়ে আসছিল জাহাজটি। তীরে দাঁড়ানো মানুষ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকলো কী ঘটতে যাচ্ছে, তা দেখার জন্য। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিল পরের ঘটনাটি। যেভাবে হঠাৎ করে উদয় হয়েছিল ফ্লাইং ডাচম্যান নামের ভুতুড়ে জাহাজ, একইভাবে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়।
এবং ১৮৮১, ১৯১১, ও ১৯৪২ সালে বিভিন্ন সময়ে ফ্লাইং ডাচম্যানকে আরও অনেকেই দেখতে পাওয়ার দাবি করেন। সবাই একই বর্ণনা দেন জাহাজটির এবং সবাই বলেন যে, জাহাজটি এক পর্যায়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। ফ্লাইং ডাচম্যানকে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল ১৯৪২ সালে কেপ টাউনের উপকূলে। নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে ছিল টেবিল বে-তে এবং আকস্মিকভাবে জাহাজটি অদৃশ্য হয়ে যায়।
জাহাজটিকে ঘিরে একইরকম আরো বেশ কিছু ঘটনার কথা শোনা যায়। এর কতটা সত্যি আর কতটাই বা মিথ্যা তাও জানা যায়নি। যদিও বিজ্ঞানমষ্করা দাবি করেন, এগুলো মানুষের হ্যালুসিলেশন ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে এতজন মানুষ কিভাবে একই রকম হ্যালুসিলেশনে আক্রান্ত হতে পারেন সেটাও রহস্যের ব্যাপার!
তথ্যসূত্র ও ছবি :
https://bramleegwater.deviantart.com/art/The-Flying-Dutchman-297460851
উইকিপিডিয়া : https://en.m.wikipedia.org/wiki/Flying_Dutchman