ধরুন, আপনি যে শহরের বছরের পর ধরে নির্বিঘ্নে বসবাস করে আসছেন, যে শহরটিকে আপনি নিজের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ শহর বলে মনে করে আসছেন একটা লম্বা সময় ধরে, আচমকা সেই শহরে এমন এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটল যার হাতে বীভৎসভাবে খুন হচ্ছে শহরের এক একজন বাসিন্দা। খুনীর আসল পরিচয় কারোর জানা নেই। আপনি শুধু জানেন, খুনিটি আপনারই শহরে বাস করছে, সেও ঠিক আপনারই মতো আপনার শহরেরই বাসিন্দাদের একজন। যেহেতু তার পরিচয় আপনার জানা নেই, সেহেতু এই খুনী যে কেউ হতে পারে–হয়তো আপনার পাশের ফ্ল্যাটে বসবাসকারী লোকটিই শহরজুড়ে এই বীভৎস খুনগুলো করে চলেছে। আপনারই মতো সেও আপনার শহরের সকল সুযোগসুবিধা ভোগ করছে; এমনও হতে পারে আপনি যে দোকানগুলো থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনছেন, সেও সেই একই দোকানগুলো ব্যবহার করছে তার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনার ক্ষেত্রে। কে জানে, পাবলিক বাসে চড়ার সময় যে ব্যক্তিটির সাথে আজ আপনার ধাক্কা লেগেছিল, হতে পারে সেই ব্যক্তিটিই খুনী। কিংবা আপনার অফিসের কলিগদের কেউ। অথবা আপনার বন্ধুদের কেউ সেই খুনীটি হতেই বা দোষ কোথায়? এমন হাজারো সম্ভাবনা জন্ম নেবে আপনার অবচেতন মনের কোণে, আর তা রূপান্তরিত হবে আতঙ্কে। আপনার স্বাভাবিক জীবনের গতিকে করবে বাঁধাগ্রস্থ।
ভয় নেই, আমি কোনো সত্য ঘটনা আজ আপনাদের বলছি না। বলছিলাম আমেরিকান লেখিকা টেস গেরিটসেন’র বহুল আলোচিত “রিজোলি-আইয়েলস” সিরিজের প্রথম উপন্যাস “দ্য সার্জন”-এর কথা। যেরকমটা শুরুতে বলেছি, ঠিক সেভাবেই বোস্টন শহরে আচমকা আবির্ভূত হয় এক নৃশংস খুনী, অনেকটা আকাশফুঁড়ে আবির্ভূত হওয়া বলা চলে। তবে খুনীটা যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার ওপর আক্রমণ করছে এমনটা নয়। বরং তার শিকার হচ্ছে বোস্টনের মেয়েরা।
উপন্যাসটির ঘটনাপ্রবাহ
এক বছরের ব্যবধানে কোনো কারণ ছাড়াই বোস্টন শহরে বীভৎসভাবে খুন করা হয় দুজন মহিলাকে। খুনের ধরন থেকে পুলিশ এটুকু নিশ্চিত যে কোনো সাধারণ ছাপোষা লোকের কাজ নয় এটা। কেননা খুনগুলো যে করেছে সেই ব্যক্তিটি মেডিক্যাল জ্ঞানসম্পন্ন এবং নিঃসন্দেহে নিজের কাজে ভীষণ দক্ষ। বোস্টনের সংবাদপত্রগুলো নাম না জানা এই পিশাচটার নাম দেয় ‘সার্জন’। বলাই বাহুল্য বোস্টনের মেয়েদের মধ্যে খুব দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকলো সার্জন আতঙ্ক।
এদিকে নড়েচড়ে বসে বোস্টন হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট। ব্যাপারটা তাদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলো ডিটেক্টিভ টমাস মুর এবং তার পার্টনার জেন রিজোলিকে। শুরু হয় সার্জনকে খুজে বের করার অভিযান। হাতে তেমন কোনো সূত্রও নেই যা ধরে আগাতে পারে ডিটেক্টিভদ্বয়। অন্যদিকে লাশের অটোপসি করে ডা. আইয়েলস বিস্ময়কর সব তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে থাকে তাদেরকে। নিজের কাজে ডাক্তার আইয়েলস এক কথা অদ্বিতীয়া। ল্যাবরেটরিতে লাশের সাথে সাথে ব্যবচ্ছেদ হতে থাকে খুনির মনস্তত্বও। পাশাপাশি থেমে নেই সার্জন। খুন করার বিষয়টিকে সে শৈল্পিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। রাতের অন্ধকারে শিকার করছে বোস্টনের মেয়েদেরকে।
ঘটনাচক্রে ডিটেক্টিভ মুর ও রিজোলি এক বিস্ময়কর তথ্য আবিষ্কার করে। দু’বছর আগে সাভানাতে অ্যান্ড্রু ক্যাপরা নামে এক মেডিক্যাল স্টুডেন্ট দক্ষ সিরিয়াল কিলার হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল, এবং বেশ কয়েকজন মেয়ে শিকার হয়েছিল তার এই নৃশংস খেলায়। মজার ব্যাপার হলো, বোস্টনের বর্তমান আতঙ্ক সার্জনের সাথে সাভানার সেই সিরিয়াল কিলার অ্যান্ড্রু ক্যাপরার খুনের ধরন ছিল অদ্ভুতভাবে হুবহু একই রকম, যেন ক্যাপরাই খুনগুলো করছে। অবশ্য তা হলে মন্দ হতো না, কিন্তু অদ্ভুত বিষয়টি হলো–দুই বছর আগে অ্যান্ড্রু ক্যাপরার ভবলীলাসাঙ্গ হয়েছিল তারই সর্বশেষ শিকার সার্জন ক্যাথরিন কর্ডেলের হাতে। ক্যাথরিনকে নিজের নৃশংসতার শিকার বানাতে এসে দূর্ভাগ্যের ফেরে কর্ডেলের গুলিতে ক্যাপরার মৃত্যু হয়।
তাহলে? কীভাবে বোস্টনের নব্য ত্রাস সার্জন দুই বছর আগে মারা যাওয়া অ্যান্ড্রু ক্যাপরার শিকার করার পন্থাটি হুবহু অনুসরণ করছে? কী করে সে ক্যাপরা কপিকাটে পরিণত হলো? কী সম্পর্ক রয়েছে এই দুই খুনীর মধ্যে? আর দুই বছর পর কোথা থেকেই বা উদয় হলো এই খুনী?
উপন্যাসটি সম্পর্কে ব্যক্তিগত মতামত
ডায়ানা স্টার্লিং–ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকুরিরত এক মেয়ে, যার খুনের মধ্য দিয়ে সূচনা হয়েছে এই শ্বাসরুদ্ধকর উপন্যাসটি। এরপরই সংগঠিত হয় আরো দু’টো খুন। এই খুনগুলোকে বেশ দক্ষ হাতে সাজিয়েগুছিয়ে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন ঔপন্যাসিক। ক্রাইম সিনের বর্ণনা এতটাই সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন যে বইটি পড়ার সময় হয়তো আপনিও চোখের সামনে ক্রাইম সিনটিকে দেখতে পাবেন। উপন্যাসটিতে যে ক’টা হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে, সেসবের বর্ণনা গা শিউরে ওঠার।
টেস গেরিটসেনের লেখনীর সাথে আমার পরিচয় “দ্য সার্জন” উপন্যাসটির মধ্য দিয়ে। গল্প বলার ভঙ্গীমা আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। বেশ ধীরে ধীরে এগিয়েছে ভবিতব্যের দিকে। কোথাও কোনো তাড়াহুড়ো নেই। চরিত্রায়নের ক্ষেত্রেও নেই কোনোপ্রকারের ঘাটতি নেই। গুরুত্বের ভিত্তিতে প্রত্যেকটা চরিত্রকে সাজিয়েছেন চমৎকারভাবে। বিশেষ করে ডিটেক্টিভ জেন রিজোলি চরিত্রটির কথা উল্লেখ না করলেই নয়। অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একটি চরিত্র। অবশ্য টমাস মুর বা ডা. আইয়েলসকেও ফেলে দেওয়া যায় না। মোট কথা, আমার মতে প্রত্যেকটি চরিত্রের সার্থক চিত্রায়ন করতে সমর্থ হয়েছেন লেখিকা।
শুধু হত্যার নৃশংসতা আর অপরাধী-পুলিশের দ্বৈরথ দিয়েই উপন্যাসের গল্প সাজানো হয়েছে তা কিন্তু নয়। বরং গল্পের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সামাজিক দিক থেকে একটা মেয়ের অবস্থান কেমন সেই চিত্রটাও লেখিকা তার লেখনিতে তুলে আনতে ভুল করেননি। পেশাগত জীবনে একটা মেয়েকে কী ধরনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়, তাকে কেন্দ্র করে তার সহকর্মীদের মধ্যে কী ধরনের মনোভাব বিদ্যমান থাকে সেসবের চিত্রও উঠে এসেছে উপন্যাসটিতে। শুধু সামাজিক প্রতিকূলতাই নয়, উঠে এসেছে পারিবারিক প্রতিকূলতার বিষয়টিও। পরিবারের সদস্য হিসাবে একটা মেয়েকে কী ধরনের প্রতিকূলতা সম্মুখীন হতে হয় সেটিরও আংশিক চিত্র উপন্যাসের প্রয়োজনে লেখিকা ঠিকই তুলে ধরেছেন। আর সব প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে নিজের সামর্থের পরিচয় দেওয়ার মূর্ত প্রতীক হিসাবে লেখক সৃষ্টি করেছেন তার অসাধারণ চরিত্র–জেন রিজোলিকে। এই বিষয়গুলোকে একটুও অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়নি। বরং এটি উপন্যাসটিকে আরো বাস্তবসম্মত করে তুলেছে।
সম্পূর্ণ উপন্যাসটিতে অনেকগুলো মেডিকেল টার্ম রয়েছে। তবে সেগুলো উপন্যাসটি উপভোগের ক্ষেত্রে মোটেও বাগড়া দেবে না। কারণ পড়ার সময় কোনটার কারণে কী হচ্ছে তা গল্পের মধ্যেই সাবলীলভাবে বলে দেওয়া হয়েছে।
আর সার্জন চরিত্রটাকে লেখিকা এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, তাকে ঘিরে পাঠকের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হতে বাধ্য বলেই আমি মনে করি। শেষ পরিণতিতে না পৌঁছা পর্যন্ত পাঠকের পক্ষে সার্জনের প্রকৃত পরিচয় জানা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
মোট কথা, উপন্যাসটি সত্যিই উপভোগ্য। সার্জনের বীভৎস হত্যাযজ্ঞে আপনার গা শিউরে উঠবে। তার শেষ পরিণতি না জানা পর্যন্ত সার্জন ভীতি তাড়া করে বেড়াবে।
লেখিকা সম্পর্কে কিছু কথা
ঔপন্যাসিক টেস গেরিটসেন’র জন্ম ১২ জুন ১৯৫৩ সালে। শৈশব কেটেছে ক্যালিফোর্নিয়াতে। ছোটোবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন ন্যান্সি ডিউ উপন্যাসের মতো নিজেই কোনো চরিত্র সৃষ্টি করবেন। প্রথম জীবনে লেখিকার নাম ছিল টেরি। রোম্যান্টিক উপন্যাস লেখার প্রয়োজনীয়তায় তিনি চেয়েছিলেন নিজের নামটাকে একটু মেয়েলি ধাচের করতে। সেজন্য টেরি বদলে হয়ে গেলেন টেস। ১৯৭৫ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে নৃতত্ত্বে বি.এ পাশ করেন। এরপর স্যান ফ্রান্সিসকোর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় মেডিসিনে ভর্তি হন এবং ১৯৭৯ সালে মেডিক্যাল ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাসটি। রোম্যান্টিক ঘরানা উপন্যাসটির নাম ছিল “কল আফটার মিডনাইট”। ডাক্তারি পেশা থেকে অবসর নিয়ে এখন তিনি স্বামী জ্যাকব গেরিটসেন ও দুই পুত্রের সাথে বসবাস করছেন।
বই সম্পর্কিত কিছু তথ্য
বইয়ের নাম : দ্য সার্জন
লেখিকা : টেস গেরিসেন
সিরিজ : রিজোলি-আইয়েলস
ঘরানা : সাসপেন্স থ্রিলার
প্রথম প্রকাশ : ২০০১
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৪১৬
**আন্তর্জাতিকভাবে বেস্টসেলার উপন্যাস হিসাবে স্বীকৃত।
বিভিন্ন বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত মন্তব্য
“দ্রুত বেগে বিন্যস্ত, লোমহর্ষক এবং উৎকণ্ঠায় পরিপূর্ণ একটি কাজ, যা পাঠককে ধীরে ধীরে টানটান উত্তেজনা এবং আতঙ্কের চরমসীমায় নিয়ে যাবে।”
_পিপল
“একটি উচ্চমার্গীয় থ্রিলার…চরিত্রের প্রখর বিন্যাস পাঠকের চোখকে বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে সহজে সরে যেতে দেবে না, রাত জেগে পড়তে বাধ্য করবে।”
_কারকাস রিভিউ
“এক শব্দে, ভয়ংকর…তবে পাঠক এর শক্তিশালী খপ্পর থেকে সহজে মুক্তি পাবেন না।”
_শিকাগো ট্রিবিউন
“দক্ষ কোনো সার্জনের হাতে থাকা স্কালপেলের মতো উপন্যাসটি গেরিটসেনের লেখনি দক্ষতায় চমৎকার একটি সাসপেন্স থ্রিলার হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।”
_পাবলিশার্স উইকলি
অনুবাদ বই সম্পর্কিত তথ্য :
মূল উপন্যাসটি ইংরেজি ভাষায় লেখা হয়েছে। তাই ইংরেজি বই পাঠের অভ্যাস না থাকলে বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হবে পাঠককে। তবে ঘাবড়ানোর কিছুই নেই, পাঠক চাইলেই বইটির বাংলা অনুবাদ সংগ্রহ করে পড়তে পারবেন। বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন সান্তা রিকি। বাতিঘর প্রকাশনি থেকে ২০১৬ সালের অমর একুশে বইমেলাতে প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদগ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৩৬। অনুবাদ বেশ ভালো বলে সুনাম কুড়িয়েছে।