১।
ভারতের সাথে আমাদের দেনাপাওনার হিসেবটা বেশ পুরনো। ২০০৭ বিশ্বকাপে ‘পুঁচকে’ বাংলাদেশের কাছে হেরে গ্রুপপর্ব থেকেই বাদ পড়ে যায় ভারত। ২০১১ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেই দুঃখ ভুলে যাওয়ার বছর পেরোতে না পেরোতেই ২০১২ এশিয়া কাপ!শচীন টেন্ডুলকারের শততম সেঞ্চুরির ম্যাচটাও যেন দুঃস্বপ্নের মতোই ধরা দিলো ভারতীয় ক্রিকেটারদের সুখনিদ্রায়। বাংলাদেশের কাছে হেরে এশিয়া কাপ ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হলো ভারত।
এরপরের গল্পটা অবশ্য শুধুই ভারতের। ২০১৫ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল, ২০১৬ এশিয়া কাপ ফাইনাল, ওয়ার্ল্ড টোয়েন্টি-টোয়েন্টির সেই হতাশাজনক ডু অর ডাই ম্যাচ, ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল, ২০১৮তে নিদাহাস ট্রফির ফাইনাল… একে একে সবকটাই হেরেছে বাংলাদেশ। মাঝখানে ২০১৫তে ওয়ানডে সিরিজ জিতলেও, কোন টুর্নামেন্টে আর ভারতকে হারাতে পারিনি আমরা।
এর মধ্যে অবশ্য ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালটা যথেষ্ট বিতর্কিত। একপ্রকার জোর করেই বাংলাদেশকে হারিয়ে দেয়া হয়েছিলো ম্যাচটাতে।প্রবল ক্রিকেটীয় আবেগসম্পন্ন বাংলাদেশিদের চোখে ওই ম্যাচের পরেই যেন ভারতীয় ক্রিকেট দল হয়ে যায় চিরকালের রাইভাল । এরপর ভারতের সাথে প্রতিটা ম্যাচে আমাদের একটাই চিন্তা, একটাই ভয়…আম্পায়ার! কে জানে, গতকাল এশিয়া কাপের ফাইনালেও হয়তো সেই জুজুর ভয় ফিরে এসেছিলো! লিটন দাসের আউটটা যথেষ্ট বিতর্কিত ছিল, সন্দেহ নেই! বাংলাদেশ ছাড়া অন্যকোনো দল হলে বেনিফিট অব ডাউটটা হয়তো ব্যাটসম্যানের অনুকূলেই যেতো।
২।
আইসিসিতে সবচেয়ে বেশি অবদান ভারতের। স্পন্সর,জনপ্রিয়তা থেকে শুরু করে আইসিসির সব প্রজেক্টেই ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য। আইসিসির আয়ের অর্ধেকেরও বেশি যায় ভারতের পকেটে। বিশ্বের বাঘা বাঘা সাবেক ক্রিকেটাররা আজকাল নিজের দেশের চেয়ে ভারতীয় চ্যানেলে ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করতেই বেশি পছন্দ করেন। এমনকি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান দলের সাবেক লিজেন্ডরাও নিজের দেশ ছেড়ে বরং ভারতের ক্রিকেটারদের পারফর্মেন্স গ্রাফের উন্নতির চেষ্টাতেই ব্যস্ত থাকেন।
কাজেই ভারত চুরি করবেই! কেউ যদি বলে ভারত পরিচ্ছন্ন খেলা খেলে ম্যাচ জিতে নেয় তবে সে আসলেই নির্বোধ। শুধু বাংলাদেশ কেন, সব দলের সাথেই ভারত চুরি করে। এজন্য আইসিসিকে টাকা দিয়ে কিনে নিতে হবে এমনটা না। আইসিসির বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ পদে ভারতীয়রাই, আর আইসিসিতে ভারতের অবদানের কৃতজ্ঞতায় ভারতের প্রতি কিছুটা দুর্বলতা আইসিসির সাদা চামড়ার কর্তাব্যক্তিদের মধ্যেও থাকে। ভারত চুরি করবে এতে তাই অবাক হওয়ার কিছুই নেই।
৩।
তিনবছর আগের কথা। বাংলাদেশ-ভারত টেস্ট সিরিজ চলছে। সাকিব-আল-হাসান সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন।
সংবাদ সম্মেলনের একেবারে শেষ দিকে এক ভারতীয় সাংবাদিক সাকিবকে হিন্দিতে প্রশ্ন করলেন! ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি তো হিন্দি বোঝেন, হিন্দিতে যদি একটু টেস্টের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলতেন।’
বছরের পর বছর আইপিএল খেলার সুবাদে সাকিব নিশ্চয়ই হিন্দি বোঝেন; হিন্দি বোঝা বা বলায় তো দোষের কিছু নেই। তাই বলে জাতীয় দলের সংবাদ সম্মেলনে হিন্দিতে উত্তর দিয়ে দেউলিয়া করে দেবেন সাকিব!
সাকিব একটু সময় ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে থেকে শুদ্ধ ইংরেজিতে বললেন, ‘স্যরি, আমি আপনার কথা বুঝতে পারিনি। ইংরেজিতে বলবেন প্লিজ?’
সাকিব বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র ক্রিকেটার, অসাধারণ খেলেও যার কেবল গঞ্জনাই সইতে হয়। তিন ফরম্যাটে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হওয়া একমাত্র ক্রিকেটার সাকিব-আল-হাসান, এই কথাটা আমরা ভুলে যাই কি করে? একই টেস্টে সেঞ্চুরি আর দশ উইকেট নেয়া তিনজন ক্রিকেটারের একজন সাকিব-আল-হাসান, এটা কেন আমাদের মনে থাকে না? সাকিবের রেকর্ডের কথা বলতে গেলে যত সময় লাগবে, ‘সাকিপ তুমার বউ বুরকা পরে না ক্যান’ কিংবা ‘সাকিপ তুমি নিজে রুস্ট খাও আর কাজের মেয়েরে দ্যাও সাদা পুলাউ’ বলতে ততটা সময় লাগে না, তাই বোধহয় আমরা ‘সাকিব কালা পারে না’ কেন সেটা নিয়ে গবেষণা করতে এতটাই ব্যস্ত হয়ে যাই যে, দিনের পর দিন ইনজুরি লুকিয়ে খেলতে নামা এই মানুষটার আঙুলে যে ইনফেকশন হয়ে বসেছিলো, সেটা শুনেও আমরা বলি, ‘এগুলো গুজব’। দিনশেষে সদ্য হজ করে ফেরা মুখভর্তি দাড়ি নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা সাকিবের ছবিটা আমাদের টাইমলাইনে ঘোরাফেরা করে।
৪।
ক্রিকেটের সাথে দেশপ্রেম মেলানো হয়তো ঠিক না। কিন্তু বাংলাদেশিদের কাছে ক্রিকেট স্রেফ একটা খেলা নয়, একটা আবেগ, একটা গর্ব , একটা ভালোবাসার জায়গা। রাত এগারোটার মধ্যেই বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়া ছেলেটাও যখন রাত দুটো পর্যন্ত চলা ম্যাচে পক্ষপাতদুষ্ট আম্পায়ারিং আর ভাগ্যের নির্মমতায় তীরে এসে তরী ডুবতে দেখে, বুকের ভেতরটা সত্যিই হাহাকার করে ওঠে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। সেই হাহাকার আরো তীব্র, আরো প্রখর হয় ভারতের সাথে হারলে! সবার হয় কি না জানি না, কারো না কারো তো নিশ্চয়ই হয়!
তাই মাশরাফি যতই বলেন, একটা ট্রফি দিয়ে তিনি নিজেকে বিচার করতে চান না, ট্রফি পাওয়া না পাওয়ায় কিছুই আসে যায় না, আমরা মাশরাফিভক্তরা কিন্তু সেভাবে ভাবতে পারি না। মাশরাফি হাতে একটা আন্তর্জাতিক ট্রফি উঁচিয়ে না ধরেই অবসরে যাবেন, এ কথা ভাবতেই তাই আমাদের কান্না পায়। সোনালি হরফে লিখে রাখা কোন রেকর্ডের অধিকারী না হয়েই হয়তো তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আজ থেকে বহুবছর পরে যখন বিশ্বকাপের ভারত-বাংলাদেশ ফাইনালে শেষ ওভারে ছয় রান দরকার পড়বে, হাতে থাকবে না কোন বোলার, এই প্রজন্মের কোন এক ক্রিকেটভক্ত নিশ্চয়ই মাশরাফির কথাই সবার আগে ভাববেন, এমন পরিস্থিতিতে মাশরাফি কি করতেন! মুস্তাফিজকে বলা ‘ম্যাচটা জিতিয়ে দে’ কিংবা মুশফিককে বলা ‘যুদ্ধে নেমে পিছিয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই’, এমন একেকটা কথা যে কি ভয়াবহ উদ্দীপনার বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে তা হয়তো মাশরাফি নিজেও জানেন না! তাই হয়তো দেবব্রতদা মাশরাফিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “মাশরাফি কি বাংলাদেশের ক্রিকেটে একটা মিথ?”
মাশরাফি আসলেই একটা মিথ। একটা রূপকথা, এক সার্থক মহাকাব্য। মহাভারতের চির অবহেলিত মহাবীর কর্ণ কিংবা রামায়ণের রাবণপুত্র মহাবীর মেঘনাদের মতোই মাশরাফির গল্পটা।
যে গল্পটা লিখতে শুরু করলে হয়তো সমুদ্রের সুবিশাল জলরাশি পরিমাণ কালিও ফুরিয়ে আসবে একসময়!