সামাজিক মাধ্যমে যারা দিনের খানিকটা সময় খরচ করে থাকেন, তাদের অনেকেই বেগুনি রঙের এক পাগল পাখির মাথা ঝাঁকুনিতে তিতিবিরক্ত হয়ে আছেন। উল্টোটাও সত্যি, অন্তত গত সপ্তাহখানেক কারো মেজাজ খারাপ করানোর জন্য এই বেগুনি ঘুঘুর কোন জুড়ি ছিলনা।
প্রথমবার এই বোকা পাখির মাথা ঝাঁকানিতে মেজাজ এমন খারাপ হয়েছিল, মনে হল নিজের মাথাটাই ঝাঁকিয়ে ছিঁড়ে ফেলি। চেষ্টা করে দেখলাম আমার ঘাড়ের ঝালাই অত মজবুত না- মেটালহেড হতে গিয়ে হ্যারি পটারের হেডলেস নিকের মত কল্লাকাটা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কি করা যায়? সেই পুরনো প্রবাদের আশ্রয় নিতে হল- বিষে বিষক্ষয়। যেই সুসন্তান আমাকে বেগুনি পাখির স্টীকার দেখাবে, তার টাইমলাইনে বেগুনি পাখির ঝাকশুদ্ধ ছেড়ে দেই, বোঝ ঠ্যালা বাছাধন।
এব্যাটাকে ঝাড়ে বংশে নির্মূল করতে হলে তো এর গোঁড়াটা জানা দরকার। ফেলুদার কাছে যোগাযোগ করে জানতে পারলাম সিধুজ্যাঠা এখন পরের রহস্যে ফেলুদাকে টিপ্পনী কাটার জন্য পড়াশোনায় ব্যাস্ত। শেষে সন্ধান মিলল সিধুজ্যাঠার খুড়তুতো ভাইয়ের ছেলে গুগলের কাছে। চলুন, এই ঘুঘুর দৌরাত্বের ইতিবৃত্ত খানিকটা জেনে নেয়া যাক গুগলদার কাছ থেকেঃ
‘ট্রাশ ডাভ’ তথা ময়লাখেকো পাখি এই মুহূর্তে আমজনতার জন্য উন্মুক্ত হলেও আদপে এটি তৈরি হয়েছিল আইওএস ১০ এর নিজস্ব মেসেঞ্জারের জন্য। এই মহামারিখানা তৈরি করেছেন ফ্লোরিডার এনিমেশন ডিজাইনার সিড ওয়েলার। সিড ওয়েলার একজন পেশাদার এনিমেশন নির্মাতা এবং গ্রাফিকাল ছবি আকিয়ে। কিভাবে তার মাথায় এই অদ্ভুত পাখির ভুত চাপল?
সিড ওয়েলার মিনসোটার এক পুকুর ধারে বসে অলস বিকেল কাটাচ্ছিলেন। হঠাৎ তার চোখ পড়ল বেগুনি রঙের কিছু পাখির দিকে। ডানা ঝাপটে মনের সুখে উড়ছে আর লোকের দেয়া খাবার খুটে খাচ্ছে পাখিগুলো। বিকেলের রোদে পাখিগুলোর ডানায় রঙের ঝলকানিতে কেমন যেন নেশা ধরে গেল সিডের, হাজার হলেও রঙ, আলো আর ছায়া নিয়েই তার কারবার। ঝটপট গোটাকয়েক ছবি একে ফেললেন বেগুনি ঘুঘুর। তারপর তাদেরকে রূপান্তর করলেন এনিমেশনে। লোকের দেয়া উচ্ছিষ্ট খাবার বা ‘ট্রাশ’ খাচ্ছিল বলে নাম দিলেন ‘ট্রাশ ডাভ।’ এরপর তিনি এই বস্তু আপলোড করে দিলেন অ্যাপল স্টোরে। প্রথমে ট্রাশ ডাভ শুধু আইওএসের মেসেঞ্জারে ইমোজি হিসেবে ব্যাবহার করা যেত। উপরি হিসেবে এই স্টীকার বানানোর ১৪ ঘণ্টার লাইভ ভিডিও ছাড়লেন সিড। ব্যাস, এক ধাক্কায় বেগুনি পাখি জয় করে নিল সামাজিক মাধ্যম।
কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে একটু বুঝি ঘুমিয়েছিলেন সিড, ঘুম ভেঙ্গে তার আক্কেল গুড়ুম। ট্রাশ ডাভের সাথে এক বিড়াল মিলিয়ে একটা ভিডিও বানিয়ে থাইল্যান্ড থেকে কেউ একজন ইউটিউবে ছেড়েছেন, এক রাতেই সেটা পাঁচ লাখ চল্লিশ হাজারবার দেখা হয়েছে। বেগুনি পাখির বাজার গরম, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন পক্ষী জননী- অসংখ্য পোস্তে তাকে ট্যাগ করেছে মানুষ। সেই সাথে টাইমলাইনে বেগুনি পাখির জলোচ্ছ্বাস। মাথা ঝাকিয়ে গোটা সোশ্যাল মিডিয়াই ভেঙ্গে ফেলার যোগাড় করেছে তার খেয়ালী সৃষ্টি।
জনপ্রিয়তা দেখে আইওএসের ইমোজিকে স্টীকারপ্যাক বানিয়ে ছাড়ল ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। মুহূর্তের মধ্যেই ফেসবুকেও ভাইরাল হয়ে গেল ময়লাখেকো পাখি। সেই থেকে চলছে এই পাখির দৌরাত্ব।
সিড তো তার পাখি বাজারে ছেড়েই খালাস, এখন এই পাখি নিয়ে মেতে আছে সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুক। পাল্লা চলছে কে কাকে কত বিরক্ত করতে পারে পাগলা পাখীর হেডব্যাং দিয়ে। অনেকে আবার এই পাখিকে কতল করার কাল্পনিক এনিমেশন বানিয়ে ছাড়ছেন ফেসবুক আর ইউটিউবে। একজন তো পাগলা পাখীর অত্যাচারে রীতিমত মেজাজ হারিয়ে ঘর-আসবাব ভাংচুরের ভিডিও ছেড়েছেন ইউটিউবে। অনেকে আবার আদিখ্যেতা করছেন ট্রাশ ডাভ নিয়ে। তার ভাবভঙ্গি নকল করে নানারকম ভিডিও বানাচ্ছেন, ট্রাশ ডাভের মুখোশ পরে রাস্তাঘাটে হেডব্যাং দিয়ে বেড়াচ্ছেন কেউ। খোদ আমেরিকাতে নাকি এই পাখি নিয়ে রাজনীতিও হচ্ছে! নিজেদের বিভিন্ন মতবাদ প্রচারের জন্য এই পাখিকে প্রতীক হিসেবে ব্যাবহার করতে চাইছেন ট্রাম্পের সমর্থকরা।
আমাদের এদিকে অবশ্য নাৎসিবাদ, বর্ণবাদ বা রাজনৈতিক মতাদর্শকে ছুঁতে পারেনি ট্রাশ ডাভ। নিখাদ শান্তিপূর্ণভাবে অন্যকে বিরক্ত করার কাজে এটি দক্ষতার সাথে ব্যাবহার করে চলেছি আমরা। ধরুন দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ফেসবুকে গুরুগম্ভীর একখানা স্টাটাস দিলেন আপনার বন্ধু, আপনি কমেন্টে একখানা ট্রাশ ডাভ ঠুকে দিন। আপনার দেখাদেখি আপনার জানের দোস্ত ঠুকলেন আরেকখানা। দুজনের কমেন্টেই রিপ্লাই হিসেবে আরেকখানা করে ট্রাশ ডাভ ঠুকলেন তৃতীয় বন্ধু। ব্যাস, জ্ঞানী বন্ধুর গাম্ভীর্যের সাড়ে সর্বনাশ আর ফিচেল বন্ধু আহ্লাদে আটখানা।
তো বন্ধুগন, ময়লাখেকো বেগুনি পাখীর জন্মবৃত্তান্ত তো জানলেন। এবার নেমে পড়ুন শিকারে। সাবধান, একান্ত যদি পাগল হয়ে মাথা ঝাঁকানো শুরু করতেই হয়- অবশ্যই ঘাড় ব্যাথার কলার পরে নেবেন মনে করে।
আর হ্যাঁ, এইসব খবর ভুলেও সিধুজ্যাঠাকে দেবেন না। উনি আবার আদিখ্যেতা একদম পছন্দ করেন না। বেগুনি পাখি নিয়ে মাতামাতি করছি জানতে পারলে আমি আর গুগলদা দুজনের কপালেই খারাবি আছে।
লেখকঃ মাহফুজুর রহমান। ভার্সিটির হলে থাকি আর পাশের রুমের সাথে দেয়ালে বাড়ি দিয়ে সিগ্ন্যাল বিনিময় করি। কোন দু:খে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়তে এসেছিলাম জানিনা। ভালবাসি ক্লাসের বই বাদে যেকোনো লেখা পড়তে আর আবোলতাবোল লিখতে। খোড়া কৌতুকের আজীবন রাজা হিসেবে আত্মস্বীকৃত।