৩ পারমাণবিক শক্তি প্রকল্প ও বিজ্ঞানীদের রহস্যময় হত্যাকান্ড

listverse.com
listverse.com

পারমাণবিক শক্তির গবেষণা যে কোন রাষ্ট্রের জন্য একটি স্পর্শকাতর বিষয়। পারমাণবিক হামলা থেকে বাঁচার জন্য প্রত্যেকটি রাষ্ট্র সাবধানতা বজায় রেখে চলে এবং একই সাথে তারা নিজেদের রাষ্ট্রকে এই ক্ষেত্রে সর্বাত্মক উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। এই পারমাণবিক গবেষণাকে ঘিরে ঘটে চলেছে নানান রহস্যাবৃত ঘটনা, যার মধ্যে কিছু ঘটনার সমাধান আজো পাওয়া যায়নি।  চলুন দেখে নেই কয়েকটি তেমনি কয়েকটি অমীমাংসিত পারমাণবিক রহস্য।

১। ইউরেনিয়াম চুরি

“নিউক্লিয়ার ম্যাটেরিয়েলস আ্যন্ড ইকুইপমেন্ট কর্পোরেশন” সংক্ষেপে NUMEC একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় নিউক্লিয়ার গবেষণা সংস্থা। স্নায়ু যুদ্ধের আগে এবং চলাকালীন সময়ে NUMEC এর একটি গবেষণাগার ছিল পেনসেলভিনিয়াতে। সেখানে বিভিন্ন ধরণের পরমাণু গবেষণা চালানো হতো এবং তাতে ইউরেনিয়াম মজুদ করা ছিল। ১৯৮৩ তে এই ল্যাবটি বন্ধ করে দেয়া হয় কিন্তু এটি ছিল একটি  সুরক্ষিত স্থান।  এর সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল প্রশ্নাতীত।

১৯৯০ সালে এই ল্যাব থেকে আশেপাশের এলাকায় বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষজন দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে। NUMEC তাদের ল্যাবে একটি “সিপেজ” অর্থাৎ গ্যাস পাইপে ছিদ্র খুঁজে পায়। সেটি মেরামত করা হয় দ্রুত কিন্তু তারা আরো একটি ভয়ংকর ব্যাপার দেখতে পান। তারা দেখেন যে ইউরেনিয়াম চুরি হয়ে গেছে!

কারা চুরি করতে পারে এই ল্যাব থেকে ইউরেনিয়াম? ইউরেনিয়ামের মতো রেডিও আ্যকটিভ ধাতু ভুল হাতে পড়লে মহাসর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই এই চুরির তদন্ত ভার দেয়া হয় CIA কে।

CIA তাদের তদন্তের পর সন্দেহের আঙ্গুল তুলে ইসরায়েলের দিকে। কেননা ইসরায়েলি গুপ্তচরেরা নিউক্লিয়ার গবেষণা সংক্রান্ত সবকিছু সংগ্রহ করে আসছে। তারা সন্দেহ করে যে এই কাজ মোসাদের।

NUMEC এর প্রতিষ্ঠাতা জালমান শাপিরো CIA এর সাহায্যে ইসরায়েলি ডিফেন্স এবং ইন্টিলিজেন্স ব্যুরোতে গোয়েন্দা নিযুক্ত করেন। কিছুদিন পর CIA শাপিরোকে জানায়  ইসরায়েলের নিউক্লিয়ার রিআ্যক্টরে একটি দুর্লভ ধরণের ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা লক্ষ করা গেছে। সেই ধরণের ইউরেনিয়াম শুধু NUMEC তেই ছিল। আর কোথাও নয়।

পরবর্তীতে শাপিরো CIA কতৃক সংগ্রহীত সকল তথ্যপ্রমাণাদি ইসরায়েল সরকারের কাছে প্রেরণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপে NUMEC তাদের ইউরেনিয়াম উদ্ধারে সফল হয়। কিন্তু NUMEC মাত্র ২০০ পাউন্ড ইউরেনিয়াম ফেরত পেয়েছিল। কিন্তু চুরি হয়েছিল ৬০০ পাউন্ড ইউরেনিয়াম। প্রশ্ন হচ্ছে, বাকি ইউরেনিয়াম কোথায়? কি করা হয়েছে বাকি ইউরেনিয়াম দিয়ে?

২। ভারতীয় নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানীদের রহস্যময় অন্তর্ধান

সাধারণত নিউক্লিয়ার গবেষণায় নিযুক্ত বিজ্ঞানীদের বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। যে কোন দেশের জন্য নিউক্লিয়ার গবেষণা একটি স্পর্শকাতর বিষয়। কিন্তু গত কয়েক বছরে বেশ কিছু বিজ্ঞানীর রহস্যময়ভাবে মৃত্যু ঘটেছে। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটেছে ভারতে। ভারতে যেসব বিজ্ঞানীদের মৃতদেহ পাওয়া গেছে তারা কোন না কোন ভাবে পরমাণুকেন্দ্রীয় গবেষণায় নিযুক্ত ছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে তাদের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনা মনে হলেও মৃত্যুগুলো বেশ রহস্যজনক।

প্রথমে একটি রেললাইনে পাওয়া যায় দুজন উচ্চপদস্থ প্রকৌশলীর লাশ। তারা ভারতের সর্বপ্রথম নিউক্লিয়ার শক্তি চালিত ডুবোজাহাজের প্রকৌশলী ছিলেন। তাদেরকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল এবং তা দুর্ঘটনার মতো করে সাজানো হয়েছিল। পুলিশ প্রথমে বিষের কথা স্বীকার করলেও পরবর্তীতে তারা বলেন এটি ছিল নিছক দুর্ঘটনা। এরপর মারা যান আরেক বিজ্ঞানী। তাকে ঘুমের মধ্যে ছুরি দিয়ে আঘাত করে মারা হয়। কিন্তু পুলিশ একে সাধারণ ডাকাতির ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়। যদিও বাড়িতে ডাকাতির অন্য কোন আলামত পাওয়া যায় নি। এই ঘটনার কিছুদিন পর ল্যাবে আগুন লেগে মারা যান দুই পরমাণু বিজ্ঞানী। কিন্তু তারা সেদিন ল্যাবে কোন দাহ্য পদার্থ নিয়ে গবেষণারত ছিলেন না। তাহলে তারা কি নিয়ে গবেষণা করছিলেন? কি হয়েছিল সেদিন গবেষণাগারে? এই সত্য আজো সামনে আসেনি।

তাছাড়া আরেকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যিনি ছিলেন একটি পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে কর্মরত, তাকে কে বা কারা অপহরণ করে। তিনি আজও নিখোঁজ।

শুধু ভারতে নয়, ইরানেও বেশ কিছু বিজ্ঞানীর রহস্যময় মৃত্যু ঘটেছে। যার জন্য ইরান সরাসরি ইসরায়েল কে দায়ী করেছে।

৩। ক্যারেন সিল্কউড অন্তর্ধান

ক্যারেন সিল্কউড ছিলেন একজন কেমিক্যাল টেকনিশিয়ান এবং লেবার ইউনিয়নের একজন সক্রিয় কর্মী। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের “Kerr-McGee Cimarron Fuel Fabrication Site” নামক সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। সিল্কউডের কাজ ছিল নিউক্লিয়ার রি আ্যক্টরের জন্য প্লুটোনিয়াম প্যালেট তৈরী করা।

একবার Kerr-McGee তে প্লুটোনিয়াম চুরির হয়েছে বলে জানা যায়। এর পর থেকে সেখানকার কর্মীদের উপর তেজস্ক্রিয় পদার্থের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা রয়ে যায়। কেননা এই নিউক্লিয়ার প্লান্টে কর্মীদের যযথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিলো না। ক্যারেন সিল্কউড ১৯৭৪ সালে লেবার ইউনিয়নে যোগদান করেন এবং এই বিষয়টির উপর জোর প্রদান করেন। তিনি মালিকপক্ষের কাছে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ত্রুটিগুলো তুলে ধরেন। শুধু তাই নয়, তিনি এই ব্যাপারে “Atomic Energy Commission” এর কাছে নিজের আশঙ্কাগুলো তুলে ধরেন এবং যথাযথ প্রমাণ ও দেন। এরপরেও সিল্কউড Kerr-McGee এর কিছু অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে সন্দিহান ছিলেন যদিও তিনি কাউকে কিছু স্পষ্ট করে বলেননি।

১৯৭৪ এর নভেম্বরে তিনি রহস্যময়ভাবে প্লুটোনিয়ামের সংস্পর্শে আসেন। অর্থাৎ তার শরীরে প্লুটোনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা পরিলক্ষিত হয়।  শুধু তার শরীরেই নয়, তার বাড়ির বিভিন্ন অংশে প্লুটোনিয়ামের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর এই নভেম্বর মাসের ১৩ তারিখে তিনি বিখ্যাত যুক্তরাষ্ট্রীয় পত্রিকা “নিউইয়র্ক টাইমস” এর সাংবাদিকদের সাথে কোন এক ব্যাপারে কথা বলার জন্য একটি ক্যাফে থেকেকে ইউনিয়ন মিটিং সেরে সেখান থেকে বের হন। কিন্তু পথিমধ্যে রহস্যময় সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান।

সিল্কউড দাবি করেছিলেন, Kerr-McGee এর কর্মীরা অনিরাপদ অবস্থায় কাজ করছেন। সেই ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট প্রমাণ যোগাড় করেছিলেন। তাছাড়া তার কাছে কিছু কোম্পানির কাগজ ছিল যে ব্যাপারে তিনি সাংবাদিক ডেভিড বার্নহ্যামকে বলেছিলেন যে, এ সকল তথ্য শীঘ্রই প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন। যদিও সিল্কউডের মৃত্যুস্থানে কোন কাগজ বা ফাইল পাওয়া যায়নি। অথচ সাংবাদিকদের সাথে দেখা হওয়ার আগে তিনি তার ইউনিয়ন মিটিং এ ছিলেন এবং সেখানে তার কাছে একটি ফাইল ছিল বলে তার সহকর্মীরা দাবি করেন।

পোস্টমর্টেমে সিল্কউডের রক্তে প্রচুর পরিমাণে মারিজুয়ানা পাওয়া গেছে যদিও তিনি মিটিং এ পুরোপুরি স্বাভাবিক ছিলেন। তাছাড়া তার ফুসফুসে প্লুটোনিয়াম এমন ভাবে পাওয়া গেছে যেন তিনি তা নিশ্বাসের সাথে গ্রহন করেছিলেন। কিছু সাংবাদিক দাবি করেন যে সিল্কউডের গাড়িকে পেছন থেকে অন্য কোন গাড়ি জোড়ে ধাক্কা দিয়ে উলটে দিয়েছিল। তাছাড়া সিল্কউড অনেকদিন থেকে প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছিলেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, কারা সিল্কউডকে হত্যা করার জন্য এত তৎপর ছিল? কি হচ্ছিলো Kerr-McGee এর অভ্যন্তরে? কোথায় গেল সিল্কউডের যোগার করা তথ্যপ্রমাণ? এ সকল প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি।

ক্যারেন সিল্কউডের জীবনের উপর ভিত্তি করে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, যার নাম “সিল্কউড”। এতে ক্যারেন সিল্কউডের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বিখ্যাত অস্কারজয়ী অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপ।

লেখিকা সম্পর্কেঃ তাসনিয়া আজমী। শখ বই পড়া, বই সংগ্রহ করা। লেখালেখি শুরু করেছি বেশীদিন হয়নি, কিন্তু এরই মধ্যে লেখালেখি ভালবেসে ফেলেছি। ইচ্ছে ছিল সাংবাদিকতা নিয়ে পড়ার, বিভিন্ন কারণে হয়নি। ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে নিজের বই নিজের বুকশেলফে তুলে রাখার। ইচ্ছে আছে লেখিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার।