মার্কিন নির্বাচন ঘিরে উইকিলিক্স থেকে ফাঁস হওয়া ১০ মারাত্মক তথ্য

wikileaks.jpgসাম্প্রতিক মার্কিন ইলেকশন ছিল আমেরিকান ইতিহাসে সবথেকে বিদঘুটে সময়। আর যখন উইকিলিক্স হাজার হাজার ইমেইল ফাস করে দেয়, তখন সময়টা আরো অদ্ভুত থেকে অদ্ভুততর হয়। এখানে বেশ কিছু ইমেইল ফাস ঘটিত ঘটনার চুম্বক অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি কোন রাজনীতি বা কুটনিতি বিশেষজ্ঞ নই। সুতরাং, যদি কোন ভুলভ্রান্তি আপনার চোখে ধরা পড়ে তবে তা অবশ্যই কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না। আর ভালো লাগলে অবশ্যই শেয়ার করবেন।

ফাঁসকৃত ইমেইলগুলো দেখতে এখানে ক্লিক করুন

১. হিলারির বন্ধু কারা

এটা জানতে হলে আমাদের খুব বেশী পিছনের দিকে যেতে হবে না। ২০১৪ সালের ১৮ই নভেম্বর হুমা আবেদিন নামক এক ব্যাক্তির কাছে থেকে একটি ইমেইল এসেছিল। ইমেইলে লেখা ছিলঃ

“যেসব গ্রুপ হিলারির বন্ধু তালিকার লিস্টে আসতে চায় তাদের ব্যাপারে আমাদের আরো চিন্তা-ভাবনা করা উচিৎ। কারন এতে ফায়দা আছে। মনেহয় এটা সামনাসামনি আলোচনা করাটাই সবথেকে ভাল হবে।”

২০১৬ সালের জানুয়ারিতে পোদেস্তার কাছে  ntanden@gmail.com থেকে আরেকটা ইমেইল পাঠানো হয় যেখানে একটা ডার্ক সেন্স অফ হিউমরের ইঙ্গিত দেয়া আছে। সেখানে লেখা ছিল, “কিন্তু আমি যেটা বলি, হিলারির যখন যা প্রয়োজন হবে, আমি ওর পাশে আছি। ওর কাছে আমার অনেক ঋণ। […] Let’s hope it doesn’t come to this and she wins Iowa.”

 

২. স্বাধীন তথ্য অধিকার আইন প্রত্যাহার করার প্রচেষ্টা

বিগত কয়েক বছরে মার্কিন সভায় তথ্য অধিকার আইনের কথা অসংখ্যবার এসেছে। আর ফাঁস হওয়া বেশ কিছু ইমেইলে দেখা যায়, তথ্য অধিকার প্রত্যাহার করার পূর্ণ ষড়যন্ত্রের চিত্র। এই স্ক্যান্ডালের সম্পুর্ন কনটেক্সটের সাথে হিলারির প্রাইভেট ইমেইল সার্ভার সরাসরিভাবে জড়িত। যেখানে দুর্নীতিবাজ কিছু কংগ্রেসম্যান এর ঘৃণ্য মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে।

৩. UFO অবসেশন

অনেকেই আমরা ১৯৪৭ সালে নিউ ম্যাক্সিকোর রসওয়েলের ঘটনা ও গুঁজব সম্পর্কে জানি। হিলারি নিজেই একবার জিমি কিমেল এর কাছে বলেছিলেন, আমাদের ন্যাশনাল সিকিউরিটি জড়িত কোন বিষয় ফাইলে না থাকলে, রসওয়েল ফাইলকে আমরা ডি-ক্লাসিফায়েড করতে পারি।

তখন জন পোদেস্তা ছিলেন প্রেসিডেন্ট ওবামার সিনিয়র অ্যাডভাইসর। সে অবশ্য ওটাকে দ্রুত ডি-ক্লাসিফায়েড করার পক্ষেই ছিলেন। অথচ ফাঁস হওয়া ইমেইল অন্য ঘটনা জানান দেয়। ওই ইমেইলগুলোর ভেতরে একটা ইমেইল ছিল যেটায় Blink-182 এর টম ডি লং পোদেস্তাকে ইউএফও এর ব্যাপারে ইমেইল পাঠিয়েছিলেন। টম পোদেস্তাকে অনুরোধ করেছিলেন দুজন অতি গুরুত্বপুর্ণ কাউকে দিয়ে যেন ওয়াশিংটন ডিসিতে একটা মিটিং রাখা হয়। অন্য কিছু ইমেইলে দেখা যায় ডি লং, পোদেস্তা ও অ্যাস্ট্রোনট সুজান ম্যাকক্যাসল্যান্ড উইলকারসন এর মাঝে একটা মিটিং সেট-আপ করার প্ল্যানিং। কি ঘটেছিল সেটা পরিস্কার নয়, তবে এখন আমরা জানি পোদেস্তা ছিলেন ডি লং প্রযোজিত ইউএফও ডকুমেন্টরির একটি অংশ।

৪. বেনগাজি কমিটি লিক

আমরা বেনগাজিতে কি ঘটেছিল তার গভীরে যাব না। শুধু ক্লিনটন ক্যাম্পের বিরুদ্ধে কি পাওয়া গিয়েছিল শুধু সেটুকুই সংক্ষেপে দেখার চেষ্টা করব। বেনগাজি সম্পর্কিত কিছু ইমেইলে হাউজ সিলেক্ট কমিটির কয়েকজন ডেমোক্রেটিক মেম্বার ক্লিনটন ক্যাম্পকে দরজার ওপাশে কি ঘটছে সেই ব্যাপারে জানাচ্ছিল। একটাতে তারা বেনগাজিতে তারা কিসের সম্মুখিন হতে যাচ্ছে সেই ব্যাপারে আগাম সতর্ক করেছিল। আর কমিটির প্রধান, ট্রে গওডি, ন্যাশনাল টেলিভিশনে যাবার জন্য সিগনেচারও করেছিলেন। এই ইমেইলটি এসেছিল ডেভিড কেনডাল নামক একজন অ্যাটর্নির কাছ থেকে, যিনি ১৯৯৩ সালে হোয়াইটওয়াটার ইনভেন্সটিগেশনে অ্যাসিস্ট করার সময় থেকেই ক্লিনটন ক্যাম্পের সাথে আছেন।

 

৫. DOJ লিক

ফাঁস হওয়া ইমেইল থেকে আমরা আরো জানতে পারি, বেনগাজি কমিটিই শুধু ক্লিনটন ক্যাম্পের কাছে তথ্য দিচ্ছিলেন না। আরটি নিউজ বাছাই করে একজনকে নিয়েছিল যে ছিল ক্লিনটনেরই এক বক্তা, ব্রাইন ফ্যালন। তিনি Department of Justice (DOJ) এর লোকেদের কাছে থেকে যে তথ্য পেয়েছিলেন, তা ক্লিনটন ক্যাম্পে পাঠিয়েছিলেন।

এই অবস্থায় এই ইমেইলগুলো পেয়ে ট্রাম্প খুব দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়ে ও প্রমান করতে সমর্থ হন যে সরকারি কর্মচারীরা ক্লিন্টনের গোপন কাজগুলোতে সাহায্য করেছে। পরে ট্রাম্প ঘোষণাও দেয় যে হিলারীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে স্পেশাল প্রসিকিউটর নিয়োগ দেবে।

৬. ইমেইল স্ক্যান্ডাল নিয়ে কৌতুক

ক্লিনটন ক্যাম্পেইনের সময় সবথেকে বড় স্ক্যান্ডাল ছিল প্রাইভেট ইমেইল সার্ভারের ব্যাবহার, আর লিকড ইমেইলগুলোতে দেশের জনগনের অ্যাটেশন কিভাবে একটা নির্দিস্ট টপিক থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে এগুলো নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। ২০১৫ সালের মার্চের কিছু ইমেইলে বেনগাজির দিকে কিভাবে ফোকাস রাখতে হবে সে ব্যাপারে আলোচনা করা আছে। আবার ইমেইলগুলোতে অন্য পথের বর্ননাও দেয়া আছেঃ ওগুলো নিয়ে কৌতুক করা।

মার্চের ৩ তারিখের ইমেইলে সাবজেক্ট লাইন ছিল “HRC joke on emails at Emily’s List” যেখানে লেখা ছিল “আমার একটা আইডিয়া আছে, HRC আজ রাতে ডিনারের সময় Emily’s List এর ইমেইল সিচুয়েশন নিয়ে কৌতুক করবে।”

আর সেটার রেসপন্স কি ছিল? “আমার মনে হয় না, সঠিক বিষয়টা তুলে ধরতে না পারলে কাজ হবে।”

৭. ওয়াল স্ট্রিট বক্তব্য

স্টেট ডিপার্টমেন্ট ত্যাগ করার পরে, ক্লিনটন ওয়াল স্ট্রিটে কয়েক দফা বক্তব্য দিয়েছিলেন। বন্ধ দরজার ভেতরে দেয়া তার বক্তব্য আর তার ইমেইল লিক থেকে প্রাপ্ত তথ্য ছিল তার বাইরের রূপের থেকে সম্পুর্ণ ভিন্ন।

হয়ত সবাই বলবে এই টাকার অ্যামাউন্টের ৯৯% এর সাথেই হয়ত হিলারি ক্লিনটনের কোন সম্পর্ক নেই। হিলারিও লিখেছিল, যদিও সে দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে, তার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই প্রমাণ করে, তাকে আর সাধারন মানুষের মত প্রতিদিন অর্থনৈতিক সংগ্রাম করতে হয় না। আর অবশ্যই তার রাজনৈতিক রুচি আর ব্যাক্তিগত জীবন দুটোকেই আলাদা রাখতে হয়।

ইমেইলগুলো বেশ কিছু কারনে উল্লেখযোগ্য। তার বক্তব্যের উদ্ধৃতাংশগুলো শুধু যে ফ্রি ট্রেড্রের মত বিশেষ কিছু অবস্থানে প্রতি অনুকূল তাই নয়, তার ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রির প্রতি প্রথাগত অভিরূচির বিরোধী। কূটনৈতিকদের মতে এগুলোর ফলে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। যেমনঃ বিশ্বাসযোগ্যতা, বা এর অভাব। ইমেইলগুলো আরো প্রকাশ রাখে যে জনগণকে যেটা বুঝানো হয়, কখনো কখনো তার উল্টোও করতে হতে পারে।

৮. ইউরেনিয়াম ডিল

২০১৫ সালের এপ্রিলে NYT তে “Cash Flowed to Clinton Foundation Amid Russian Uranium Deal” শিরোনামে একটা আর্টিকেল বের হয়, যেখানে পাঠকদের শিরোনাম দেখেই বুঝতে বাকি থাকে না ভেতরে কি লেখা আছে। আর্টিকেলটি ছিল ইউরেনিয়াম ওয়ান নামের একটি রাশিয়ান কোম্পানিকে কেন্দ্র করে, যারা আসলে ইউএস এর এক-পঞ্চমাংশ ইউরেনিয়ামের মালিকানা দখল করে নিয়েছিল। সুস্পষ্টরূপেই ইউরেনিয়াম একটি ভয়াবহ বস্তু, তাই এই ধরনের চুক্তি করতে ক্লিনটন স্টেট ডিপার্টমেন্ট সহ সকল ডিপার্টমেন্টেরই অনুমতির প্রয়োজন ছিল। বছরের পর বছর এই ধরনের ডিল করতে ইউরেনিয়াম ওয়ান সরাসরি ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ডোনেশন করেছে। কিন্তু ডোনেশনের পুরোটাই ছিল পর্দার অন্তরালে।

ডোনেশনের ঘটনা ফাসের পরে ক্লিনটন ক্যাম্প টাইমস এর আর্টিকেলটিকে সম্পুর্ণ বানোয়াট বলে আখ্যায়িত করে। বিষয়টিতে তারা অবশ্য তৎকালীন অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইকোনোমিক, এনার্জি & বিজনেস অ্যাফেয়ার্সের কাছে থেকে সাপোর্টও পায়। পরবর্তিতে ইমেইল লিক হবার পরে জানা যায় উক্ত অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি, হোসে ফার্নান্দেজ, কখনোই কোন নিরপেক্ষ সাক্ষী ছিলেন না, যেভাবে পুর্বে উল্লেখ করা হয়েছিল। সে ক্লিনটন ক্যাম্পের কাছে এমনও ইমেইল পাঠিয়েছিল, তার অবস্থান থেকে এ ব্যাপারে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করতে তা সে করবে।

৯. আইসিস, কাতার ও সৌদি আরব

২০১৪ সালে, ক্লিনটন ও পোদেস্তার ভেতরে সিরিজ-ইমেইল আদান-প্রদান হয়, যেখানে শুধুমাত্র ISIL নিয়ে তাদের কি করা উচিৎ তাই নয়, তাদের ফান্ডিং কোথা থেকে করা হবে তাও আলোচনা করা হয়েছিল।

ইমেইল-এর একটা অংশ ছিল, “[…] we need to use our diplomatic and more traditional intelligence to bring pressure on the governments of Qatar and Saudi Arabia, which are providing clandestine financial and logistic support to ISIL and other radical Sunni groups in the region.”

বাংলা করলে দাঁড়ায়, “[…]আমাদের আরো বেশি ডিপ্লোম্যাটিক ও ট্রাডিশনাল ইন্টেলিজেন্স ব্যাবহার করে কাতার ও সৌদি সরকারের উপর প্রেশার দেয়া উচিৎ। আর এভাবেই ISIL ও অন্যান্য র‍্যাডিকেল সুন্নি গ্রুপগুলোকে গোপনে অর্থনৈতিক ও লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে হবে।”

কথোপকথনে আরো ছিল, “কুর্দি রিজিওনাল গভর্মেন্টের পেশমেরগা ফাইটার্স এবং যদি আরো বিশ্বাসযোগ্য কোন ইরাকি আর্মি গ্রুপ থাকে তাদের রিসোর্স ব্যাবহার করে ইরাকে ISIL কে ঢুকানোটা আমাদের জন্য গুরুত্বপুর্ণ।”

টেররিস্ট গ্রুপের ফান্ডিং এর জন্য সৌদি আরবের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক আগে থেকেই ছিল। এমনকি ইউকে সৌদিকে একটু রয়েসয়ে লোকাল অরগানাইজেশন ও ছোট গ্রুপগুলোর সাথে টিম করতে সাজেশন দিয়েছিল, যাতে টাকাগুলো যেন কোন ভুল হাতে না চলে যায়।

১০. মিডিয়ার দৌরাত্ম্য

আমারা সাধারনত ভেবে থাকি, মেইনস্ট্রিম মিডিয়া জনগনের সামনে সর্বদা সত্য ফ্যাক্টগুলো তুলে নিয়ে আসবে, কোন মিথ্যা গল্প নয়। তবে ইমেইল সংক্রান্ত কিছু ঘটনা আমাদের মিডিয়ার অন্য অংশ দেখতেও বাধ্য করেছে।

ওই ইমেইলগুলোর মধ্যে বেশ কিছু ছিল সিএনবিসি চ্যানেলের জন হারউডের। যিনি সেখানে বলেছেন, “বিরোধী দল ডিবেটে পাগলের মত লাইনচ্যুত হবে”। সে হিলারিকে বেশ কয়েকবার সাবধান থাকার জন্য এমন ইমেইলও পাঠিয়েছে যে, “বেন কারসন বেশ ঝামেলা করতে পারে”, সাথে তার মতামতের বেশ কিছু লিংক, ভিডিও ক্লিপস, আরো অনেক কিছু যাতে তারা বেন-কে একটা সমস্যা ভাবতে বাধ্য হয়।

দ্য বোস্টন গ্লোবকে একবার একটা আপ-কামিং সম্পাদকীয় এর স্ট্যাটাসের জন্য জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, যেটা আসলে খারাপ কিছু ছিল না। কিন্তু গ্লোব অবশ্য বিষয়টা নিয়ে একটু বেশিই এগিয়েছিল। তারা জন পোদেস্তা ও ক্লিনটন ক্যাম্প-কে বিশেষ বিশেষ অবস্থায় বেশ কিছু কূটনৈতিক সাজেশনও দিয়েছিল।

নিউইয়র্ক টাইমস ও ক্লিনটন ক্যাম্পের ভেতরেও বেশ কিছু ইমেইল চালাচালি হয়েছিল। একটা ইমেইল-এ আপকামিং প্রেস অ্যাপয়েন্টমেন্টের একটা আউটলাইন ছিল। সেই ইমেইল-এই অফ দ্য রেকর্ডে টাইমস’এর মার্ক লেইবোভিচ এর একটা নোট ছিল। যেখানে মার্কের লেখা NYT ম্যাগাজিনের একটা অংশ ছিল-যেটা ছিল ভীষণ সিমপ্যাথেটিক। পরবর্তিতে ক্যাম্পেইনের সময় তাকে সমকামী অধিকারের উপরে মন্তব্য করতে বলা হলে সে ইমেইল-এর কথা জানায় ও বলে, “Pleasure doing business!” পরবর্তিতে উইকিলিক্সে ইমেইল ফাসের পরে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলে মার্ক বলে, “I’m the Last Thing Standing Between You and the Apocalypse”।

(সোর্সঃ লিস্টভার্স)