আমাদের এই সমাজে সৌন্দর্য্য বিচারে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় গায়ের রঙ। মুক্তো ঝরানো হাসি, দীঘল কালো চুল, নির্মল হৃদয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা, এসব কিছুর উর্ধ্বে থাকে একটাই প্রশ্ন, “মেয়ের গায়ের রঙ ফর্সা তো?”আমাদের আশেপাশে তাকালে এমন অনেক মেয়েদের পাওয়া যাবে, যাদের জীবন এখন অভিশাপের মতো হয়ে গেছে শুধুমাত্র তার কালো রঙ এর চামড়ার জন্য। লজ্জাজনক হলেও সত্যি যে, এই যুগেও আমাদের কাছে সৌন্দর্য্য বিচারের মাপকাঠি হচ্ছে চামড়ার রঙ।
ভারতীয় ম্যাগাজিন “দ্যা স্যুপ” তাই আমাদের সামনে তুলে ধরেছে এমন কয়েকজন নারীর কথা, যারা শ্যামবর্ণা, কিন্তু তাদের আত্মবিশ্বাসের উজ্জ্বলতার কাছে ম্লান হয়ে গিয়েছে নিন্দুকের বাক্যবাণ। বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন পেশার ১০ জন “কালো” মেয়ের কাছ থেকে আমরা শুনবো তাদের জীবনের কথা।
এই লেখাটি পড়ার সময় না থাকলে, শুনতে পারেন এর অডিও ভার্সন, প্রথম ৫ জনকে নিয়ে। ক্লিক করুন নিচের প্লে-বাটনে। ভয়েস দিয়েছেন মিলি আক্তার
১। মীরা গণপতি
“দ্যা স্যুপ ম্যাগাজিনের এডিটর মীরা গণপতি বলেন, ” আমি এমন একটা পরিবেশে বড় হয়েছি, যেখানে আমাকে গায়ের রঙ নিয়ে কোন খোঁটা দেয়া হয়নি। আমাকে শেখানো হয়েছিলো, মানুষের মনের রূপই তার আসল রূপ। কিন্তু স্কুলে গিয়ে দেখতাম অন্যান্য কালো মেয়েদের হলুদে রাঙা মুখ, পাউডার লাগানো ফ্যাকাশে চেহারা। তারপর যখন ২১ বছর বয়সে মুম্বাই চলে আসি, তখন আমি বুঝতে পারি, মানুষের কাছে সুন্দর মানেই ফর্সা। কালো বলে আমাকে কাজে নেয়া হতো না, আড়ালে ‘কালি’ বলে ডাকা হতো। প্রথমে হীনমন্যতায় ভুগতাম। পরে বুঝতে পেরেছি, আমার গায়ের রঙ কখনই আমাত সাফল্যের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। এই তথাকথিত সুন্দরের জগতে একজন কালো মেয়ে হয়ে আমি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। এবং তখনই দেখেছি এই পৃথিবীর ভয়ানক রূপ। এমনকি বলিউড তারকারাও সারাক্ষণ বলতে থাকেন নানা রঙ ফর্সাকারী প্রসাধনের কথা। সব প্রসাধনই আজ ‘Whitening lightening Brightening’। তাই আমি আমার ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, যাদের গায়ের রঙ তাদের আত্মবিশ্বাসকে টলাতে পারেনি।”
২। মান্ডবী মেনন
ছাব্বিশ বছরের মান্ডবী মেনন, “Homegrown” এর সহ প্রতিষ্ঠাতা এবং এডিটর বলেন “আমি ছোটোবেলা থেকেই খেলাধুলায় আগ্রহী ছিলাম। আ্যথলিট বলেই সবাই জানতো আমাকে। সে সুবাদে মাঠেমাঠেই রোদে পুড়ে আমার দিন কাটতো। সবাই বলতো, ‘পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছো বাজে লাগবে দেখতে’। কিন্তু আমি সেকথায় কান দিইনি। আমি আমার গায়ের তামাটে রঙ খুবই ভালোবাসি। আমার এই রোদে পোড়া ত্বকই আমার পরিচয়, আমি একজন আ্যথলিট।”
৩। মাদিহা আলী
“আমি ছোটবেলা থেকেই খুব আদরে বড় হয়েছি। আমার পরিবারের আমিই দেখতে কালো, বাকি সবাই ফর্সা। কিন্তু এজন্য আমাকে কখনো কোন বাজে কথা বলা হয়নি” বললেন ২৮ বছরের মাদিহা আলি। পেশায় তিনি ছাত্রী। তিনি আরো বলেন, “আমার বোন খুবই ফর্সা। লোকে যখন তাকে বলতো, ‘তুমি সুন্দর, তোমার বোন কালো’, সবচেয়ে বেশি ঝগড়া সে করেছে। আমার মা তো আমার গায়ের রঙ নিয়ে কোন কথাই পছন্দ করেন না। তার ধারণা, আমি যেমন আছি, তেমনই আমাকে মানায়।”
৪। নিকিতা চিন্নারি
নিকিতা চিন্নারি, ২১ বছর বয়স। পেশায় তিনি একজন ফিনান্সিয়াল আ্যনালিস্ট। তিনি বলেন, “ওড়িশায় জন্ম হলেও আমি মুম্বাইয়ে বড় হয়েছি। দেখেছি শ্যামলা মেয়েদের হীনমন্যতায় ভুগতে। তারা গায়ে চন্দন বেসন লাগাতো, হলুদ মাখতো। কিন্তু আমি কখনো এই নিয়ে মাথা ঘামাইনি। লোকে আমায় ‘কালি’ বলে ডাকতো। তাতে আমি কান দিইনি। বড় হয়েছি নিজের মতো। আমার আত্মবিশ্বাস আমার গায়ের রঙের সাথে সম্পর্কিত নয়। আমার গায়ের রঙ গোলাপি হলে যে সাহস আমার থাকতো, কালো রঙে তার চেয়ে কম কিছু নেই।”
৫। মেঘনা রমেশ
মেঘনা রমেশের বয়স আটাশ। তিনি পেশায় কপিরাইটার। তিনি তার স্কুলজীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেন। “স্কুলে থাকতে আমাকে কুৎসিত বলে ক্ষ্যাপানো হতো, সবাই দূরে ঠেলে দিতো। একা একা কাঁদতাম। কোন বন্ধু ছিলোনা। আত্মবিশ্বাস শূন্যের কোটায় ছিলো। যখন বড় হলাম, নিজেকে ভালোবাসতে শিখলাম। দেখলাম, উজ্জ্বল সবুজ আইলাইনার আমার চোখে খুব সুন্দর বসে। লাল লিপস্টিক আমার ঠোঁটে গাঢ় হয়ে ফুটে ওঠে। আমি আমার এই ক্যারামেল রঙ নিয়ে গর্বিত।”
৬। শিল্পা কুল্লুরু
তেত্রিশ বছরের শিল্পা কুল্লুরু একজন ব্র্যান্ড কনসালটেন্ট। তিনি বলেন যে, “জন্মসূত্রে আমি দক্ষিণ ভারতীয়। তাই ছোটবেলায় গায়ের রঙ নিয়ে কোন বাজে কথা শুনিনি। কিন্তু বড় হয়ে যখন দিল্লী ইউনিভার্সিটি তে পড়তে আসি, তখন বুঝি যে, গায়ের রঙ দিয়ে এখানে রূপ মাপা হয়। প্রথম প্রথম আত্মবিশ্বাসের অভাব হতো। পরে আমি শিখেছি নিজের জন্য লড়তে, নিজেকে ভালবাসতে। আজ যখন নন্দিতা দাস বা কঙ্কনা সেন শর্মার মতো শ্যামবর্ণাদের দেখি, আমি তাদের জন্য গর্ববোধ করি। আমি আজ নিজের জন্য গর্ববোধ করি।”
৭। সঙ্গীতা থমাস
“ছোটবেলায় রিডার্স ডাইজেস্ট পত্রিকায় আমি পড়ি সোমালিয়ান অভিনেত্রী, মডেল, লেখক এবং সমাজকর্মী ওয়ারিস ডিরি সম্পর্কে। তার জীবন থেকে আমি অনুপ্রাণিত হই। তিনি আমার জীবনাদর্শ। তাই আমি আমার গায়ের রঙ নিয়ে খুবই খুশি কেননা আমার আদর্শ ওয়ারিস ডিরি একজন শ্যামবর্ণা নারী।” কথাগুলো বলেন আটাশ বছরের সঙ্গীতা থমাস। তিনি “Golden Sachs” এর ভাইস প্রেসিডেন্ট।
৮। ঐশ্বরিয়া আরুম্বাকাম
চলচ্চিত্রকার ঐশ্বরিয়া আরুম্বাকাম বলেন যে, “ভারতীয় সাহিত্যে, পূরাণে কৃষ্ণাভ নারীদের সৌন্দর্য্যের কথা অনেকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। মানুষ সেটা কেন ভুলে যায়। ব্যক্তিগতভাবে, আমি কখনো গায়ের রঙ নিয়ে কখনো কিছু ভাবিনি। মানুষের কথায় আমি কান দেইনি কখনো। আমার জীবনে আমার কাজ, পরিবার, স্বাস্থ্য ছিলো আমার চিন্তার বিষয়। আমার গায়ের রঙ আমার শরীরের অংশ। এ নিয়ে আলাদা কিছু ভাবার নেই।”
৯। স্মৃতি রাও
তিরিশ বছর বয়সী স্মৃতি রাও “Myntra” এর আ্যসোসিয়েট ম্যানেজার। তিনি বলেন, “ছোটবেলায় আমি মানসিক অবসাদে ভুগতাম যার প্রধান কারণ আমার গায়ের এই কালো রঙ। ছোটবেলায় আমার ধারণা ছিলো, সুন্দর মানেই ফর্সা। ফর্সা হওয়ার প্রতি এতটাই অনুরক্ত ছিলাম যে, আমি নাওয়া খাওয়া ভুলেই সারাদিন ভাবতাম, কিভাবে আমার গায়ের রঙ গোলাপী হবে। চন্দন, বেসন, হলুদ, লেবু, কমলালেবু সব লাগাতাম চামড়ায়। একবার এক বন্ধু ঠাট্টা করে বললো, শিরীষ কাগজ ঘষে চামড়া তুলে ফেললে নাকি ভেতর থেকে সাদা চামড়া বের হয়ে আসে। ছোট ছিলাম, তাই বিশ্বাস করে শিরীষ কাগজ যোগাড় ও করেছিলাম। কিন্তু মা হাতে নাতে ধরে ফেলে। এবং আমাকে বুঝায় যে আমি সুন্দর। আমার গায়ের রঙ আমাকে খুব মানায়। মনের রূপই আসল রূপ। আমি শুনিনি। এখন বুঝি, মা কি বলতে চেয়েছিলেন। এখন আমি নিজেকে ভালবাসি। নিজের এই তামাটে রঙ আমার ভালো লাগে। এখন আমার লক্ষ্য একজন ভালমানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার। এখন আমি বুঝেছি, যার মন সুন্দর, তার সব সুন্দর।”
১০। বিনীতা শেট্টি
ব্লগার এবং ব্র্যান্ড ম্যানেজার বিনীতা শেট্টি বলেন, “আমার আত্মীয় স্বজন বন্ধুরা আমাকে দেখে নাক সিঁটকাতো, আমাকে কুৎসিত বলতো। আমার মাড়ি গুলো কালো, তাই মন খুলে হাসতে পারতাম না। সবাই বলতো আমার হাসি খুব বাজে। বেছে বেছে নির্দিষ্ট রঙের জামা পরতে দেয়া হতো, যাতে কালো না লাগে। উজ্জ্বল রঙের পোশাক আমার খুব প্রিয়। কিন্তু আমাকে দেয়া হতো গাঢ় রঙের পোশাক। খুব খারাপ লাগতো। বড় হয়ে যখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি, তখন নিজের ইচ্ছায় চলা শুরু করি। উজ্জ্বল হলুদ, লাল, কমলা পোশাক পড়া শুরু করি। মন খুলে হাসি। লোকের কথা শুনতে শুনতে এখন আর তার কটু কথা গায়ে লাগেনা। আমার ব্লগে অনেকেই আমার পোশাক নির্বাচন, মন খোলা হাসি ও আত্মবিশ্বাসের প্রশংসা করেন। এখন আমি নিজেকে ভালোবাসতে শিখেছি। কিন্তু পেছনে ফিরে তাকালে একটু আক্ষেপ হয়। কেন যে অন্যের কথায় কান দিয়ে নিজের ইচ্ছেগুলো ছুঁড়ে ফেলেছিলাম!”
লেখিকাঃ তাসনিয়া আজমী