বিশ্বের অন্য সকল পৌরাণিক কাহিনীর তুলনায়, গ্রীক পুরাণের কাহিনীগুলো বরাবরই তুলনামূলক ভাবে চমকপ্রদ ও রহস্যময়তার আবর্তে পরিপূর্ণ। অলিম্পাসে বসবাসরত দেব দেবীগণ তাদের কামনা, লালসার শিকারে পরিণত করেছেন অসহায় মানুষকে। অনেকেই আবার হয়েছে বিনা দোষে প্রতিহিংসার শিকার। প্রাচীন গ্রীসের পুরাণসমূহ ঘাটলে তাই দেখা যায় দেবদেবীগণ ছাড়াই বরং মর্ত্যে মানুষদের সুখী বসবাস ছিল। ঘটনাবহুল গ্রীক পুরাণের চারটি উল্লেখযোগ্য ও অজেয় প্রেম কাহিনী তুলে ধরছি বাংলাহাব এর পাঠকদের জন্য।
১। কিউপিড ও সাইকিঃ
সাইকি ছিলেন এক রাজার কন্যা ও তিন বোনের মধ্যে কনিষ্ঠতম। তিনি এতটাই রুপসী ছিলেন যে সকল মরণশীলদের কে রুপের ঐশ্বর্যে ছাড়িয়ে গেলেন। সৌন্দর্যের দেবী ভেনাসের রুপ যখন সাইকির তুলনায় ম্লান হয়ে এল তখন দেবীর অভিশাপ বর্ষিত হল মেয়েটির উপর। ফলে পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দরী মেয়েটি হওয়ার পর ও কোন পুরুষের হৃদয়ে সাইকির প্রতি ভালোবাসা জন্মালো না। ভেনাস তখন তার পুত্র প্রেমের দেবতা কিউপিডকে ডেকে পাঠালেন এবং সাইকিকে দেখিয়ে আদেশ দিলেন এই মেয়ের হৃদয়ে এমন পুরুষের জন্য প্রেমের তীর বিদ্ধ করতে যে কিনা মর্ত্যে সবচাইতে কুৎসিততম। বলাই বাহুল্য, সাইকিকে দেখা মাত্রই কিউপিড নিজের তীর বিদ্ধ করলেন নিজেরই বুকে এবং মায়ের অগোচরে সাইকিকে আপন করে পাবার পায়তারা খুঁজতে লাগলেন। এদিকে রাজা মেয়ের কুমারিত্ব মোচনের উপায় হদিস করলেন এক ভবিষৎবক্তার কাছে। সে জানাল, সাইকিকে রেখে আসতে হবে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের শৈ্লখণ্ডের উপর, সেখানে এক বিষাক্ত পাখাওয়ালা সাপ গ্রহণ করবে তাকে, এটিই তার নিয়তি। সাইকি তা জানতে পেরে নিজের নিয়তিকে মেনে নিল এবং তাকে রেখে আসা হল পাহাড়ের উপর যেখানে সে অপেক্ষা করতে লাগল ভয়ংকর কিছুর আগমণের। রাত হলে সাইকি একটি উজ্জ্বলতম প্রাসাদ দেখতে পেল, যেটি স্বয়ং কিউপিড নির্মিত করিয়েছিল সাইকির জন্য, এবং এভাবেই সকলের অগোচরে কিউপিড ও সাইকি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হল। পরবর্তীতে বোনদের কুচক্রের শিকার হয়ে সাইকি বোকামিপূর্ণ ফাদে পা দেন ও কিউপিড তার বিরাগভাজন হয়ে তাকে রেখে চলে যায়। সাইকি এবার ভেনাসের সামনাসামনি চলে আসে, সে ভেনাসের কাছে নিজের স্বামী্র ঠিকানা প্রত্যাশা করে। ভেনাস, তখনও সাইকিকে পুত্রবধু হিসেবে গ্রহণ করার বদলে তাকে দিয়ে প্রতিহিংসা পরায়ণ মজা লুটতে থাকে। অবশেষে কিউপিড অভিমানের নিদ্রা হতে জাগ্রত হয়ে সাইকিকে উদ্ধার করে এবং নিয়ে যায় অলিম্পাসের চূড়ায়। সেখানে দেবতাদের সর্বসম্মতিক্রমে সাইকিকে অমরত্ব প্রদান করা হয় এবং ভেনাস পুত্র ও পুত্রবধুকে গ্রহণ করে নেয়।
২। বোসিস ও ফিলোমেনঃ
ফ্রিজিয়াতে বসবাসরত এক বৃদ্ধ, দয়ালু দম্পতি যাদের উপর দেবতাদের দয়া বর্ষণের কাহিনী উল্লেখিত রয়েছে। অলিম্পাসের সুখস্বাচ্ছন্দ্যে ক্লান্ত হয়ে দেবতা জুপিটার ও মার্কারি নেমে আসতেন মর্ত্যে, মানুষদের বিভিন্ন পরীক্ষায় অবতীর্ণ করতেন তারা। ফ্রিজিয়ার নগরীতে এমনই একদিন ভ্রমণে বেরোলেন জুপিটার ও মার্কারি দরিদ্র ভিক্ষুকের বেশে। দরিদ্র কুটির থেকে বিলাসবহুল রাজবাড়ি, সব জায়গা থেকেই বিতাড়িত হলেন তারা। কেউই তাদের আতিথেয়তা করতে রাজি হলনা। তারপর দুই দেবতা এসে হাজির হলেন শহরের সবচাইতে দরিদ্র কুটিরটিতে যেখানে বাস করত বোসিস ও ফিলোমেন। বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা তাদেরকে সাদরে আপ্যায়ন করলেন, সামর্থ্য অনুযায়ী খাওয়ালেন। বৃদ্ধ বোসিস এর মন তারপরও অজানা কারণে খচখচ করতে লাগল। তাদের ছিল একটি রাঁজহাস। সে জুপিটার ও মার্কারিকে বলল, আসলে রাঁজহাসটি মেরে সেটি দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করা উচিত ছিল। ফিলোমেন ও বোসিস মিলে তখন হাসটিকে ধরতে জুটে গেল কিন্তু কিছুতেই সেটি তাদের নাগালে আসছিল না। দুই দেবতা এই কান্ড দেখে ভারী মজা পেলেন। বোসিসকে ধরে তখন জুপিটার তার কুটিরের বাইরে নিয়ে এলেন এবং স্বরুপে আবির্ভূত হলেন। তিনি জানতে চাইলেন যে বোসিস তার কাছে কি চায়। বোসিস তখন শ্রদ্ধাভরে জুপিটারের মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের ভার চাইল এবং বলল, সে এবং ফিলোমেন সর্বদাই একসাথে থেকেছে। মৃত্যুর পরও যাতে তারা একসাথে থাকতে পারে। দেবতা এ অনুরোধে সম্মতি জ্ঞাপন করলেন, মৃত্যুর পর বোসিস ও ফিলোমেন পরিণত হল একটি লেবু গাছ ও ওক গাছে, একই গুড়ি থেকে যাদের উৎপত্তি। দূর দূরান্ত থেকে আজও মানুষ সে বিস্ময়কর গাছ দেখতে আসে।
৩। পিগম্যালিয়ন ও গ্যালাতিয়াঃ
একদা ছিল এক প্রতিভাবান ভাস্কর পিগম্যালিয়ন, নারী জাতির প্রতি তার ছিল চরম অবজ্ঞা। দারুণ সুদর্শন ও সুঠাম দেহের অধিকারী হওয়ার পরও কোন নারীর সান্নিধ্য তার কাম্য ছিল না। কেবল নিজের মূর্তিগুলোকে নিয়েই সে মেতে থাকত এবং এটিই যুবকটির জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। সে গড়ে তুলল সবচাইতে সুন্দর ও নিখুঁত নারীর প্রতিমূর্তি এবং ভালোবেসে ফেলল নিজের সৃষ্টিকর্মকে। কিন্তু হায়! প্রাণহীন জড় পদার্থকে ভালোবেসে সে হয়ে উঠল প্রেমিককূলের মধ্যে সবচেয়ে অসুখী। বাচ্চা মেয়ের পুতুল খেলার মত করেই সেও এই মূর্তিটিকে নিয়ে খেলায় মেতে থাকত। মূর্তিটির জন্য সে এনে দিত মূল্যবান উপহার যা কোন রক্তমাংসের প্রেমিকাকেই ভোলাতে পারে। বস্তুত সে মূর্তিটিকে তৈরী করেছিল এতটাই নিখুঁতভাবে যে সেটিকে দেখলে মানুষ বলেই মনে হত। দেবী আফ্রোদিতি বা ভেনাস তাই পিগম্যালিয়নের আহ্বানের অপেক্ষায় রইলেন। ভেনাসের পূজোর তিথি উপস্থিত হলে পিগম্যালিয়ন দেবীর কাছে মনে মনে প্রত্যাশা করল, যাতে মূর্তিটির ন্যায় কোন মানবীর সে বাস্তবে সন্ধান পায়। গৃহে ফিরে সে অভিভূত হয়ে পড়ল কারণ কাদামাটির মূর্তিতে প্রাণ সঞ্চার করেছেন দেবী । দেবীর নির্দেশ অনুযায়ী তখন মানবীটির নাম রাখল সে গ্যালাতিয়া। অতঃপর তাদের জীবন সুখময় হল।
৪। দাফনিঃ
দাফনির নামের সাথে অন্য কোন মানুষের নাম জড়িয়ে নেই কারণ বলা হয়ে থাকে সেই ছিল এপোলো বা জুপিটারের প্রথম প্রেমিকা। দাফনি ছিল দুরন্ত ও স্বাধীনচেতা। মূলত দেবতাদের সাথে প্রেমাসক্তি যে কোন কুমারী মেয়ের জন্য ছিল ভীতির কারণ। এর পরিণতিতে হয় তারা নিজের ঔরসজাত সন্তানকে হত্যা করত নতুবা নিজেরাই আত্মহত্যায় উপনীত হত। দাফনি এরুপ সম্পর্ককে ঘৃণা করত এবং সে এমনকি কোন মরণশীলকেও গ্রহণ করতে রাজি ছিল না। তার পিতা নদী দেবতা ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। একদা দাফনি জঙ্গলে শিকারে ব্যস্ত ছিলেন, তখনই এপোলোর চোখ পড়ল তার উপর এবং সাথে সাথেই শেষ হয়ে গেল সব। এপোলো ধাওয়া করলেন দাফনিকে কিন্তু দাফনিও দৌড়াতে লাগলেন, কিছুতেই ধরা দিবেন না দেবতার কাছে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে দাফনি নদী প্রান্তে এসে উপস্থিত হলেন এবং প্রার্থনা করলেন তার পিতার কাছে। তৎক্ষণাৎ ক্ষণ যৌবনা মেয়েটি পরিণত হল একটি লরেল গাছে। এপোলো অত্যন্ত হতাশ ও দুঃখ ভারাক্রান্ত হলেন। তারপর তিনি লরেল গাছকে বর দিলেন। এরপর থেকে যোদ্ধারা সর্বদা যুদ্ধ শেষে বিজয়ী বেশে ফিরে আসার পর তাদের ঢাল তলোয়ারের অগ্রভাগে পেঁচিয়ে নিত লরেল গাছের শাখা যা কিনা এপোলোর প্রতীকচিহ্ন রুপে প্রতীয়মান ছিল। এভাবে এপোলো ও লরেল এর নাম মিশে রইল একসাথে।
আরো পড়তে পারেন এরকম লেখা
ডেমনলজিঃ পর্ব ৬ – 7 Deadly Sins বা সাতটি মহাপাপ
ডেমনলজি বা পিশাচবিদ্যা পর্ব-৪ (বালবেরিথ ও বাফোমেট)
ডেমনলজি বা পিশাচবিদ্যা পর্ব-৩ঃ অশুভ আত্মা কী সত্যিই মানুষের উপর ভর করে?