বড় হতে হতে শিশু যে সকল অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়, বারবারই সেই অভিজ্ঞতার সাথে নিজের পরিবেশের একটা সামঞ্জস্য বিধান করে নিতে হয়। যেহেতু পৃথিবীর প্রায় সবকিছুই শিশুর কাছে নতুন, তাই বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা, বিচিত্র সব পরিবেশে সে নতুন নতুন তথ্যের সন্ধান পায়- সেগুলো প্রকাশের ভাষা হয়তো তার জানা নেই, শিশু খেলার মধ্য দিয়েই ঐসব অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সচেতন হতে শেখে। সেই বিশেষ পরিবেশে, বিশেষ পরিস্থিতিতে তার নিজস্ব সত্তা কি, সে সম্বন্ধে বিচার বিবেচনা করতে শেখে। এভাবেই বাস্তবের সাথে তার জীবনের একটি সংযোগ তৈরি হয়। যেহেতু পরিবেশ-পরিস্থিতি-অভিজ্ঞতা সতত পরিবর্তনশীল, এই কারণেই শিশুকেও তার ধ্যান ধারণা অনবরতই পরিবর্তন করতে হয়। খেলার সাহায্যে শিশু ঐসব পরিবর্তনশীল অভিজ্ঞতার সাথে তার বাস্তব জীবনের সামঞ্জস্যের সূত্রটি খুঁজে বের করতে পারে।
খেলা হচ্ছে শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক প্রকৃতি। শিশু জন্মগ্রহণের পর পরই হাত পা নড়াচড়া করে এবং কিছুদিন পর সে হাত পা নিয়ে খেলা শুরু করে। তবে এই ধরণের খেলা কোন অর্থ বহন করে না। অতীতে খেলাকে মনে করা হতো সময়ের অপচয় কিন্তু বর্তমানে শিশু মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে- খেলা শিশুর সার্বিক এবং সুষ্ঠু বিকাশের জন্য খুবই দরকার। এই খেলার মধ্য দিয়ে শিশু স্বাভাবিক জীবনে প্রবেশ করে। শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ এবং শিক্ষণ ভিত্তি হলো খেলা।
মিলড্রেড পার্টেন ১৯২৯ সালে আমেরিকার দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সীদের নিয়ে এক গবেষণায় শিশুদের ছয় ধরণের খেলা লক্ষ্য করেন। এছাড়াও এরিকসন তার সাইকো-সোশ্যাল থিওরিতে তিন ধরণের খেলার কথা বলেছেন। তবে পরবর্তীতে আরও কিছু টাইপ আবিষ্কার হয়। শিশুরা কত ধরণের খেলা খেলে- তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে খেলাকে তিনটা দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হয়। খেলার প্রকৃতি (আউটডোর নাকি ইনডোর), সামাজিকীকরণ বা সোশালাইজেশন এবং সেন্সরি মটর এ্যাক্টিভিটি বা অঙ্গ সঞ্চালন। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেন্সরি মটর এ্যাক্টিভিটির উপর ভিত্তি করে খেলাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
প্রথমটি এ্যাক্টিভ প্লে বা সক্রিয় খেলা। এই খেলাতে শিশু নিজে অংশগ্রহণ করে। আরেকটি হলো প্যাসিভ প্লে বা নিষ্ক্রিয় খেলা। এই খেলাতে শিশু নিজে অংশগ্রহণ করে না। তবে অনেক শিশু মনোবিদ এটাকে নিষ্ক্রিয় বলতে রাজি নন। কারণ এটিও শিশুর জীবনে প্রচন্ড অর্থবহ। শিশু তার বয়স অনুযায়ী খেলছে- এর অর্থ তার বিকাশ ঠিকমত হচ্ছে।
এখন দেখি এ্যাক্টিভ প্লে বা সক্রিয় খেলা বলতে আমরা আসলে কি বুঝাতে চাইছি-
১. সলিটারি প্লে বা একাকী খেলাঃ দুই থেকে তিন বছর বয়সে শিশুদের একা একা খেলা করার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এই ধরণের খেলায় কোন নিয়ম নীতি থাকে না, সঙ্গী থাকে না, বিশেষ কোন খেলনারও দরকার থাকে না। এই ধরণের খেলার ফলে শিশুর চিন্তাশক্তি ও অঙ্গ সঞ্চালনের বিকাশ ঘটে।
২. সিম্বলিক প্লে বা প্রতীকি খেলাঃ এটা এক ধরণের ছলনামুলক খেলা। এই ধরণের খেলায় শিশুর একাকীত্ব প্রকাশ পায়। এই খেলার মাধ্যমে সে কিছু আবেগের অবদমন করে, চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটায়। কাগজ দিয়ে নৌকা বানিয়ে ভাসানো বা উড়োজাহাজ বানিয়ে খেলা- সিম্বলিক প্লে র উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আড়াই বছরের পর শিশুরা কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। তখন এই ধরণের খেলা খেলে।
৩. প্যারালাল প্লে বা সমান্তরাল খেলাঃ দুই থেকে তিন বছরের শিশুরা এ ধরণের খেলা খেলে। এই খেলাতে দুইটি শিশু পাশাপাশি বসে খেললেও তাদের মধ্যে কোন ইন্টারেকশন হয় না। তারা একজন আরেকজনের খেলা দেখে কিন্তু একসাথে কিভাবে খেলতে হয় তা বুঝে উঠতে পারে না।
৪. কন্সট্রাকটিভ প্লে বা গঠনমূলক খেলাঃ এই ধরণের খেলায় শিশুর ম্যাটেরিয়ালস বা যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়। যেহেতু বয়স অনুযায়ী বাচ্চাদের জ্ঞানীয় বিকাশ, ফাইন মটর ডেভেলপমেন্ট ভিন্ন ভিন্ন, তাই সে কোন বয়সে কোন বস্তু নিয়ে খেলবে- তা ভিন্ন ভিন্ন। এই ধরণের খেলা শিশুর বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ করে। মটর ডেভেলপমেন্ট এবং বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটায়।
৫. কালেক্টিভ প্লে বা সংগ্রহমূলক খেলাঃ শিশুরা খেলার জন্য বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করে। চার পাঁচ বছরের শিশুদের খেলার জন্য মার্বেল, স্ট্যাম্প, বিভিন্ন জিনিসের যন্ত্রাংশ এগুলো জমাতে দেখা যায়।
৬. এ্যাসোসিয়েটিভ প্লে বা সহযোগিতামূলক খেলাঃ তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশুরা খেলে। তারা একজন অন্যের সাথে খেলনা ভাগাভাগি করে বা অন্যের খেলায় সহযোগিতা করে। যেমন- একজন দোলনায় বসলে আরেকজন তা ঠেলে। এই ধরণের খেলায় শিশুর সহযোগিতা ও সহমর্মিতার প্রকাশ ঘটে এবং তারা বন্ধুত্ব করতে শেখে।
৭. কো-অপারেটিভ প্লে বা দলবদ্ধ হয়ে খেলাঃ শিশুরা তিন থেকে পাঁচ বছরে সমবয়সী দল বা পিয়ার গ্রুপ গঠন করতে পারে। তখন তারা দলগতভাবে খেলে। এই ধরণের খেলা খেলতে গিয়ে তারা নিয়ম অনুসরণ করতে শেখে, হার জিত মেনে নিতে শেখে।
৮. ড্রামাটিক প্লে বা নাটকীয় খেলাঃ চার থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের ড্রামাটিক প্লে বা নাটকীয় খেলা খেলতে দেখা যায়। সাধারণত গল্প শুনে বা টিভি দেখে বা মা-বাবা-শিক্ষক বা পছন্দের কোন ব্যক্তিকে অনুসরণ করে তার মত হতে চাওয়াই এখানে খেলা। শাড়ি পরে মা বা টিচার সেজে খেলা করা- নাটকীয় খেলার উদাহরণ। এতে শিশুর আবেগ, চিন্তাশক্তি ও ভাষার বিকাশ ঘটে।
৯. এক্সপ্লোরেটিভ প্লে বা আবিষ্কারমূলক খেলাঃ শিশুদের কৌতুহলের অন্ত নেই, তাই তারা যেকোন খেলনা পেলে সেটাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করে। খেলনা দিয়ে শুধু খেলেই খুশি না, খেলনাটা কিভাবে তৈরি সেটাও তারা দেখতে চায়, তাই অনেক সময় খেলনা ভেঙে তার ভেতরে কি আছে তা দেখার চেষ্টা করে। এতে শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটে। তবে এই ধরণের খেলায় অভিভাবকের অংশগ্রহণ না থাকলে পরবর্তীতে তা ধ্বংসাত্মক আচরণে রূপ নিতে পারে।
১০. সোশাল প্লে বা সামাজিক খেলাঃ একটু বড় হয়ে শিশুরা দলগতভাবে প্রতিযোগীতামূলক খেলা খেলে। এর ফলে মানসিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটে, নিয়ম নীতি অনুসরণে সচেতন হয়। প্রতিযোগীতা থাকায় প্রত্যেকেই নিজের সর্বোচ্চটা দিতে চায়।
প্যাসিভ প্লে বা নিষ্ক্রিয় খেলার মধ্যে রয়েছে- গল্প শোনা, গান শোনা, কমিক্স পড়া, টিভি দেখা, ছবি দেখা, অন্যের কাজ দেখা।
আপনার ছোট্ট শিশুটিকে কি শিখছে, কি ভাবছে, কি পছন্দ করে কি অপছন্দ করে- এই সবকিছুই তার খেলাকে বিশ্লেষণ বা এ্যানালাইসিস করলে বেরিয়ে পড়বে। তাই খেলাকে নেহায়েতই সময়ের অপচয় হিসেবে ভাবাটা অনুচিত।