হে আমার চোখ, পোশাক ভেদ করে তুই শরীর দেখিস ; মানুষ আমি ভাল , আমার কি দোষ!

প্রথমেই ঝটপট কোন চিন্তা ছাড়াই কিছু প্রশ্নের উত্তর দিন তো।

১।  প্রশ্নটা শোনার আগেই চোখ দুটো বন্ধ করুন । এখন কল্পনা করুন তো একটি ভদ্র মেয়ের ছবি । কি দেখতে পাচ্ছেন? ভদ্র মেয়ের কোন বৈশিষ্ট্য আপনার চোখে ভেসে উঠছে? এই ভদ্র মেয়ের সাথে আপনি কি কি করতে পারেন?? দেখতে পাচ্ছেন কিছু??? আচ্ছা দেখা হয়ে গেলে এখন চোখ খুলুন।

কি দেখতে পেলেন?  এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দিন ।

২। প্রশ্নটা শোনার আগে আবার চোখ দুটো বন্ধ করুন। এবার কল্পনা করুন তো একটি অভদ্র, উগ্র মেয়ের ছবি । কি দেখতে পাচ্ছেন? অভদ্র মেয়ের কোন বৈশিষ্ট্যগুলো আপনার চোখে ভেসে উঠছে ? এই অভদ্র মেয়ের সাথে আপনি কি কি করতে পারেন? মনে মনে উত্তরগুলো লিখে রাখুন । একটু পরেই জিজ্ঞাস করব ।

না এখনই প্রশ্ন শেষ হয়নি । আরো দুটো প্রশ্ন আছে ।

৩। আবার চোখ বন্ধ করুন । একটা ভদ্র ছেলের ছবি আঁকুন মনে মনে । ভদ্র ছেলের কোন কোন বৈশিষ্ট্য আপনার চোখে ভেসে উঠছে? এই ভদ্র ছেলের সাথে কি কি আপনি করতে পারেন? ভাবুন এবং মনে রাখুন ।

৪। শেষবারের মত চোখ বন্ধ করে কোন অভদ্র ছেলের ছবি আঁকুন মনে । ভাবুন তো এই অভদ্র উগ্র ছেলের কি কি বৈশিষ্ট্য হতে পারে? আর এসব বৈশিষ্ট্যের জন্য আপনি তার সাথে কি কি করতে পারেন?

এই ৪ ধরনের চিত্রই মনে রাখুন একটু পরেই এখানে আবার আমরা ফিরে আসব ।

যুগে যুগে নারী ও পুরুষদের প্রতি সহিংসতার বিভিন্ন চিত্র পাওয়া যায় । তবে পুরুষদের তুলনায় নারীদের প্রতি সহিংসতার পরিমান অপেক্ষাকৃত অনেক বেশী । নারীদের প্রতি এই সহিংসতার ধরন একেক সময় একেক রকম হয় কিন্তু আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটি চিন্তা সবসময় একইরকম রয়ে যায় । তা হল নারীর পোশাক নিয়ে চিন্তা ধারা । নারীর পোশাক নিয়ে তর্ক বিতর্ক এবং যেকোন সহিংসতার জন্য প্রথমেই এবং শেষ পর্যন্ত নারীকেই দোষারোপ করা ।

ধরা যাক, কোন নারী ধর্ষিত হল; প্রথমেই আমাদের চোখ চলে যায় তার পোশাকের দিকে । তার পোশাক কি ঠিক ছিল? সে কি ওড়না ছাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল? সে কি টাইট পোশাক পরিধান করেছিল?

তারপর আসে সে কেন একা একা নির্জন পথে গিয়েছিল? তার কি দরকার ছিল এত রাতে একা একা বাইরে যাওয়ার? নিশ্চয় মেয়ের চরিত্র খারাপ; একদম ঠিক কাজ হয়েছে ধর্ষন হয়েছে, এইরকম বেপর্দা হয়ে চলে কেন? মাথায় কাপড় নাই, বুকে ওড়না নাই, তো ও ধর্ষন হবে না তো কে হবে? একদম ঠিক কাজ হইছে ইত্যাদি ইত্যাদি ।

যেন একটা মেয়ে বেপর্দা হয়ে চললেই তাকে ধর্ষন করাটা অতি মাত্রায় জায়েজ । কি অদ্ভুত এক অসুস্থ মানসিকতা নিয়ে আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিজেদের যৌন লালসা মেটানোর জন্য মেয়েদের প্রতি হওয়া অন্যায়কে জায়েজ করে নিচ্ছে! ধর্ম কি বলেছে যে, বেপর্দাদের ধরে ধরে ধর্ষন করতে?

শুধু কি পুরুষ সমাজই এমন চিন্তা করে? না। শুধু পুরুষ নয় আমাদের সমাজের ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন নারীকূলও পুরুষের এইরকম চিন্তাকে নির্দ্বিধায় সমর্থন করে যাচ্ছে । যদিও বা ধরেই নিই যে নারীর পোশাকই তাদের ধর্ষনের অন্যতম কারন তবে বিগত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া পর্দানশীল মেয়েদের কেন ধর্ষনের শিকার হতে হয়েছে? খুব সম্প্রতি নুসরাতের ঘটনা আমাদের সবার মনকে নাড়া দিয়ে গেছে, সে মাদ্রাসার ছাত্রী এবং পর্দানশীল; কিন্তু তবুও কি সে যৌন হয়রানির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে? মাদ্রাসার শিক্ষকের কুনজর এবং কুপ্রস্তাবের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে? সত্যিটা হচ্ছে পায়নি। বরং নুসরাতের করুণ মৃত্যুর পর কিছু নিউজ পোর্টালের খবরের নিচে মানুষ নামক পশুদের কমেন্ট পড়লে বোঝা যায় আমরা আধুনিক যুগে বাস করেও কতটা আদিম, কতটা বন্য চিন্তা করতে পারি।

কমেন্টে কেউ কেউ লিখেছে, ইরানী বোরখা পড়ছে এই জন্যই তো এমন হয়েছে, কেউ কেউ আবার বলেছে মালটা ধর্ষন করার মতই ছিল এবং  অবাক করা বিষয় হচ্ছে এসব কমেন্ট করেছে সব শিক্ষিত যুব সমাজ। এসব কমেন্ট আসলে এটাই প্রমান করে যে, কতটা বিকৃত এবং অসুস্থ মানসিকতার অমানুষদের মধ্যে অনিরাপদ হয়ে আমরা বেঁচে আছি। বোরখার মধ্যে দিয়েও যাদের চোখ স্ক্যানার এর মত নারী শরীরের অবয়ব দেখে শিহরিত হয়, নারী শরীরের গন্ধে মাতাল হয় ।

তাহলে কোন নারী নিরাপদ? পর্দানশীল নারী? অপর্দানশীল নারী? কাকে নিরাপদ বলবেন যেখানে গনহারে সবাইকেই ধর্ষন হতে হয়, যেখানে গনহারে সবাইকেই যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়? কোন ছেলেকে নিরাপদ ভাববেন, যেখানে নিজের বাবা তার কন্যা শিশুকে ধর্ষন করে?

যদিও বা ধরেও নিই যে, পোশাকের জন্যই মেয়েরা ধর্ষনের শিকার হয় তাহলে ২/৩ বছরের শিশু কেন ধর্ষনের শিকার হয়? মধ্য বয়স্ক নারী, বৃদ্ধা কেন ধর্ষনের শিকার হয়?

কোন একটা ধর্ষন বা যৌন হয়রানীর খবর বের হলেই সাথে সাথে ধর্মকে টেনে আনা হয়, মেয়েটির পোশাককে টেনে আনা হয় কিন্তু একবারও সেই বিকৃত মানসিকতার অমানুষের মানসিক বিকৃতির কথা বলা হয় না । হ্যাঁ, আমি এদের অমানুষই বলব কারণ কোন মানুষ এমন করতে পারে না । আর ধর্মের কথা যদি বলি, তবে ধর্মে ছেলেদের চোখের পর্দা করতে বলা হয়েছে। চোখের দৃষ্টিকে সংযত করতে বলা হয়েছে । একবার যদি কোন মেয়ের দিকে চোখ চলে যায় তো দ্বিতীয়বার যেন চোখের দৃষ্টি নিচের দিকে থাকে তা বলা হয়েছে । ছেলেদের ও পোশাক নিয়ে ধর্মে বলা আছে । কয়টা ছেলে ধর্মীয় পোশাক পরিধান করে? আর ছেলেদের মডার্ন পোশাক দেখে কয়জন তাদের ধর্ষন করার চিন্তা করে?

আচ্ছা মডার্ন পোশাকের কথা ছেড়েই দিলাম, বেশ কয়েক মাস ধরে মাদ্রাসার ছেলে শিশুদেরও বিভিন্ন যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কথা পড়ছি খবরগুলোতে । আজ পেপারে পড়লাম এক নর পশু এক ছেলে শিশুকে মাদ্রাসায় ধর্ষন করেছে, আর পায়ুপথের অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরনে শিশু ছেলেটি মারা গেছে  । তো সেই ছেলে শিশুটি তো ধর্মীয় পোশাকই পরিধান করে ছিল তবে কেন এই ছেলে শিশুগুলোকে এমন যৌন হয়রানির শিকার হতে হল? ধর্ষিত হয়ে প্রান হারাতে হল?

উত্তর আছে কোন ?

এবার আসি শুরুর প্রশ্ন গুলোর দিকে, সততার সাথে একটু বলুন তো ভদ্র মেয়ের ছবিতে কি দেখেছিলেন? নিশ্চয় বোরখা পরিহিত অথবা বোরখা না পরিহিত হলেও হিজাব পরিহিত যথাস্থানে ওড়না, অন্যায় দেখলেও মুখ বুজে চুপ করে থাকা, তর্ক না করা এই চিত্রই কি দেখেছেন? আর প্রশ্ন করেছিলাম এই ভদ্র মেয়েদের সাথে কি কি করা যায়? উত্তরটা হয়ত অনেকেই ভেবেছেন আর যাই হোক এদেরকে কেউ যৌন হয়রানি বা ধর্ষন হওয়ার কোন সুযোগ নাই কারন এরা পর্দা করে নিজের অবয়বকে ঢেকে চলে।

খুব ভাল কথা । তাহলে তনু বা নুসরাত এরা কেন গন ধর্ষন আর যৌন হয়রানির শিকার হল?

উত্তর আছে কোন? ভেবেছিলেন, ধর্ষন শুধুমাত্র অভদ্র আর বুক দেখিয়ে চলা উগ্র মেয়েদের জন্যই আবশ্যক এবং উপযুক্ত উপায় অভদ্র আর উগ্র হওয়া থেকে বিরত রাখার । কিন্তু তনু আর নুসরাত তো অভদ্র নয়, বাসে প্রতিদিন লাঞ্চিত হওয়া বোরখা পরিহিত মহিলা, মেয়ে, বৃদ্ধা তো অভদ্র নয় । তাহলে তাদের সাথে কেন যৌন হয়রানি হচ্ছে?

এবার সেই ভদ্র আর অভদ্র ছেলের ছবিতে আসি। ভদ্র ছেলে বলতে চুল সিঁথি করে আঁচড়ানো, ইস্ত্রি করা শার্ট-প্যান্ট পরিহিত শুদ্ধ উচ্চারনে কথা বলা কেউ, আর অভদ্র ছেলের ছবি বলতে নিশ্চয় চুলে স্পাইক করা, স্থানে স্থানে ছেঁড়া শার্ট- প্যান্ট পরিহিত কারো ছবি আপনাদের চোখে ভেসে উঠেছিল!

কিন্তু এই ভদ্র বা অভদ্র ছেলের কাউকে কি আপনাদের মাথায় একবারও ধর্ষন করার চিন্তা এসেছিল যেমন অভদ্র মেয়েটির উগ্রতার জন্য তাকে ধর্ষন করার বা ধর্ষনই তাদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা এই চিন্তা একবার হলেও মাথায় উঁকি দিয়েছিল ! দেয়নি তো !

তাহলে সমস্যাটা আসলে কোথায়? পোশাকের দোহায় দিয়ে আমরা মানুষ নামক এই অমানুষদের আর কতকাল প্রশ্রয় দিয়ে যাব? পোশাকের দোহায় দিয়ে আর কতকাল এদের বিকৃত যৌন লালসাকে জায়েজ করে দিব? আর কত?

মেয়েদেরকে কোন বাক্সে বন্দী করে রাখব আমরা, যাতে করে তাদের শরীর আর বুক দেখে  কোন অমানুষের যৌন বিকৃতি জেগে না ওঠে? আছে কোন জামা যা দিয়ে ঢাকলে আর নারীর অবয়ব দেখা যাবে না??

আছে কোন জুব্বা যা পরিধান করলে আর কোন শিশু বা কিশোর ছেলেকে যৌন হয়রানির শিকার হতে হবে না?

আছে এমন কোন বাক্স যেই বাক্সের চাবি যৌন বিকৃত অমানুষদের হাতে নেই?