সার্বিয়ান-আমেরিকার উদ্ভাবক নিকোলা টেসলা ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি নিজ হাতে এই পৃথিবীকে দিয়েছেন অনেক প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, যা আধুনিক মানব সমাজের অব্যাহত বিকাশে ব্যাপক অবদান রেখেছে। বিংশ শতাব্দীতে আমরা রেডিও, মোটর এবং বিদ্যুৎ, বিশেষত বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক ক্ষমতাধর যে সকল প্রযুক্তি পেয়েছি তার বেশিরভাগই টেসলার অনন্য অবদানের বতে। তবে, তার ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য যথার্থভাবে প্রশংসা করা হলেও, তিনি বেশ কয়েকটি প্রস্তাবিত উদ্ভাবনের পিছনেও মস্তিষ্কে ছিলেন যা সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করা হয়নি কারণ তার ধারনা খুব অদ্ভুত বা উদ্ভট ছিল, সে সময়ে উপলব্ধ প্রযুক্তির সাথে এটি তৈরি করা অসম্ভব ছিল, অথবা নিকট ভবিষ্যতে তা কার্যকর যথেষ্ট সহজ ছিল না।
আসুন জেনে নেই টেসলার অসংখ্য দুর্দান্ত উদ্ভাবনগুলোর মধ্যে সাতটি আবিষ্কার; যা কখনোই তৈরি হয়নি।
১. ওয়্যারলেস বিদ্যুৎ
রেডিও, মাইক্রোওয়েভ এবং তার টেসলা কয়েল তৈরিতে কাজের সময় নিকোলা টেসলা অনেক দূরে বেতারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বা এনার্জি পৌঁছানোর জন্য একটি সিস্টেম তৈরির সম্ভাবনাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছেন। ১৯০১ সালে তিনি জে. পি. মর্গান নামক একজন ধনকুবেরের কাছে থেকে অর্থ সহযোগিতার জন্য বড় একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেখানে তিনি নিউইয়র্কের লোর আইল্যান্ডের শোরহামে ১৮৫ ফুট লম্বা ওয়্যারলেস পাওয়ার স্টেশন নির্মাণের কথা বলেছিলেন, যার নাম হবে ওয়ার্ডেনক্লিফ টাওয়ার। আটলান্টিক জুড়ে বার্তা প্রেরণ করতে সক্ষম এ টাওয়ারটিকে তিনি বেতার বিদ্যুৎ প্রেরণের একটি মাধ্যম হিসেবে দেখিয়েছিলেন যা গুগলেইলমো মারকনিয়ের রেডিও-ভিত্তিক টেলিগ্রাফ সিস্টেমের সাথে প্রতিযোগিতা করবে এবং সমস্ত নিউইয়র্ক সিটিকে আলোকিত করতে সক্ষম হবে।
দুর্ভাগ্যবশত, মর্গান এই প্রকল্পের অর্থায়ন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। এতে কয়েক বছর পর তাকে সম্পূর্ণরূপে এই প্রকল্পের বাতিল ঘোষণা করতে হয়েছিল। কার্যত ওয়ার্ডেনক্লিফ টাওয়ার টেসলার একটি ব্যর্থ প্রজেক্ট, যা আর চালু করা যায়নি।
২. বৈদ্যুতিক-শক্তিচালিত সুপারসনিক এয়ারশিপ
ওয়ার্ডেনক্লিফ টাওয়ারের ব্যর্থতার পর, টেসলা এভিয়েশন ব্যাবস্থার দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে তিনি তার মেধা কাজে লাগিয়ে বিদ্যুতের চালিত সুপারসনিক এয়ারশিপ তৈরিতে কাজ করতে পারেন। ১৯১৯ সালে এই বিজ্ঞানী বিমান নির্মান সম্পর্কে রিকন্সট্রাকশন ম্যাগাজিনে একটি নিবন্ধে প্রকাশ করেন যা নিউ ইয়র্ক সিটি থেকে লন্ডনে মাত্র তিন ঘণ্টায় যাত্রী পরিবহনে সক্ষম হবে। টেসলার মতে, এই উচ্চ গতির এয়ারশিপগুলির পাওয়ার সাপ্লাই “ভার্চুয়ালি আনলিমিটেড” ছিল কারণ এই যানবাহনগুলো সরাসরি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দ্বারা চালিত হবে।
তবে এই যানগুলো ওয়্যারলেস বিদ্যুৎ ব্যাবস্থার উপরে নির্ভরশীল ছিল। যেটা সক্ষম হলে হয়ত গতানুগতিক বিমানগুলোতে তেল পরিবহনের কোন প্রয়োজনই পড়তো না।
৩. হিউমানয়েড রোবট
১৮৯৮ সালে, টেসলা নিউইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে একটি বৈদ্যুতিক প্রদর্শনীতে প্রথমবারের মতো একটি রেডিও-নিয়ন্ত্রিত নৌকা প্রদর্শন করেছিলেন, যা কিছু মানুষ বিশ্বের প্রথম রিমোট কন্ট্রোল অস্ত্র হিসাবে বিবেচনা করেছিল। তবে, টেসলা তার নৌকা নকশাটিকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে বিচার করতে গিয়ে এটিকে “রোবটদের জাতি” বা “যান্ত্রিক পুরুষদের” বিকাশের দিকে প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে চিন্তা করেছিলেন যারা ভারী ভারী জিনিস পরিবহনে মানুষকে সাহায্য করবে। তিনি তার মডেলকে টেলোটোমাটন হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন এবং তিনি মনে করেছিলেন যে সামরিক স্থাপনাটিগুলো তার নকশা থেকে উপকৃত হতে পারে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গ্রেট ব্রিটেন সরকারের অস্ত্র সরবরাহ করতে পারে।
রোবোটিক্সের ক্ষেত্র তৈরির জন্য আজকে কিছু মানুষের দ্বারা টেসলার আবিষ্কারটি স্বীকৃত হলেও তার ধারণাটি তার সময়ের চেয়ে খুব বেশি অগ্রগামী ছিল এবং কয়েক দশক পরেও তার ব্যবহারিক অ্যাপ্লিকেশনগুলো কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি।
৪. চেতনা ক্যামেরা (Thought Camera)
একটি সময়ে বিজ্ঞানী টেসলা এমন একটি ক্যামেরা আবিষ্কার করেতে চেষ্টা করেছিলেন, যেটি মানুষের মনের ভাবনা পড়তে এবং বাস্তবে তার ফটোগ্রাফ উপস্থাপন করতে পারবে। ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রবন্ধে, এই ম্যাকানিক্যাল সায়েন্টিস্ট জানিয়েছিলেন যে তিনি অনেক বছর ধরেই যেগুলো নিয়ে কাজ করছেন সেগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে এই “চিন্তাভাবনার ফটোগ্রাফি” করার জন্য একটি যন্ত্র তৈরি করা। তিনি প্রথম এই ধারণাটি ১৮৯৩ সালে নিয়ে এসেছিলেন, কারন তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের রেটিনায় তার চিন্তাভাবনার চিত্রগুলো প্রতিফলিত হয়, যা পরবর্তিতে একটি যন্ত্র দ্বারা বন্দী করা যেতে পারে। টেসলার মতে, যদি এটি সম্ভব হয়, অর্থ্যাৎ যদি ব্যক্তির প্রতিটি চিন্তাভাবনা পড়তে পারা যায় তবে মানুষের মন শুধু একটি খোলা বইয়ের মতো হবে।
টেসলা কখনো তার “থট ক্যামেরা” তৈরির পরিকল্পনাটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে যাননি। তবে বিজ্ঞানীরা আজ মস্তিষ্কের সংকেতগুলো ব্যাখ্যা করার পদ্ধতি এবং তাদের মনের মধ্যে একজন ব্যক্তিকে দেখার চিত্রগুলির ক্রুড সংস্করণগুলোতে রূপান্তরিত করার পদ্ধতিগুলো অনুসন্ধান করছেন।
৫. ভুমিকম্প যন্ত্র
১৮৯৩ সালে, টেসলা একটি বাষ্পযুক্ত চালিত যান্ত্রিক অস্কিলেটর পেটেন্ট করেছিলেন, যা তিনি খুব উচ্চ গতিতে উপরে এবং নিচে কম্পন করার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ডিজাইন করেছিলেন। কয়েক বছর পরে ১৮৯৮ সালে যখন তিনি সাংবাদিকদের জানান যে নিউ ইয়র্ক সিটিতে তার গবেষণাগারে তার যন্ত্রটি টিউন করার সময় তার যন্ত্রটি ভূমিকম্প ঘটাতে পারবে। পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্স দ্রুত সেই স্থানে পৌঁছেছিল বটে কিন্তু টেসলা তার আগেই অস্কিলেটরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছিলেন এবং তার কর্মচারীদের মুখ বন্ধ করানোর মাধ্যমে ভূমিকম্পের আসল কারণ গোপন রেখেছিলেন। পরবর্তিতে বিজ্ঞানী আরও দাবি করেছিলেন যে তার “ভূমিকম্প যন্ত্র” টি এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের চেয়ে লম্বা কিছুও ধসিয়ে দিতে পারে, যদি তারা তা চায়।
৬. আর্টিফিসিয়াল টাইডাল ওয়েভ
টেসলা বিশ্বাস করতেন যে, ভবিষ্যতে সামরিক দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধবিগ্রহ প্রতিরোধে বিজ্ঞান যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে। তাই ১৯০৭ সালে, নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড পত্রিকায় সমুদ্রে শক্তিশালী বিস্ফোরকগুলো ধ্বংসে ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি ব্যবহার করার ব্যাপারে টেসলার প্রস্তাব প্রকাশ করে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে, যা শত্রুযান নিউট্রিলাইজ করতে সক্ষম বিশাল আর্টিফিসিয়াল টাইডাল ওয়েভ তৈরিতে ট্রিগার করবে। সংবাদপত্রের মতে, এই আর্টিফিসিয়াল টাইডাল ওয়েভ নৌযানগুলোকে নোটবুকের কাগজে তৈরি ভাসমান নৌকার মতোই নিরর্থক করে তুলবে। টেসলার এই বিশেষ সামরিক উদ্ভাবন ছিল যুদ্ধের ভয়াবহতা রোধ করবে এমন একটি হাতিয়ার হিসাবে গণ্য হয়েছিল যা মানবজাতিকে বিশ্ব শান্তি অর্জনের কাছাকাছি পেতে সহায়তা করবে। টেসলার এই প্রযুক্তিটি সেভাবে তৈরি করা হয়নি বটে, কিন্তু তা যুদ্ধে ব্যবহার্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র তৈরির অভিপ্রায়ে বহু বছর পর পারমাণবিক অস্ত্রের আকারে এসেছিল।
৭. ডেথ রে
১৯৩০-এর দশকে, ৭০ বছর বয়সী নিকোলা টেসলা নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন যে তিনি একটি নতুন সামরিক আবিষ্কার নিয়ে এসেছেন, যা লক্ষ লক্ষ বাহিনীকে তাদের যাত্রাপথেই নিমেষে মেরে ফেলে দিতে পারে। এটি ছিল পারদ কণাগুলোকে ত্বরান্বিত করতে পারে এমন একটি ভ্যাকুয়াম চেম্বার, যার গতি ছিল শব্দের গতির চেয়ে ৫০ গুণ দ্রুত। এটি এমন একটি শক্তিশালী বিম তৈরি করতে সক্ষম ছিল যা ২৫০ মাইল দূরত্বে থাকা দশ হাজার শত্রু বিমানের একটি বহরও নিমেষে শেষ করে দিতে পারে। এই প্রস্তাবিত সামরিক অস্ত্রটি সেই সময়ে মিডিয়া কর্তৃক “ডেথ রে” হিসেবে নামকরন করা হয়েছিল। কিন্তু টেসলা এটিকে “পিস রে” (Peace Ray) বলে অভিহিত করেছিলেন। কারণ এটি বিমান আক্রমণ এবং আক্রমণের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কার্যকর এবং যৌক্তিক প্রতিরক্ষা হিসাবে জীবন বাঁচাতে সক্ষম হতো।
বিজ্ঞানী এই “ডেথ রে” নির্মাণের জন্য অর্থায়ন করতে ইচ্ছুক একটি সরকার খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নই একমাত্র দেশ যারা তার ধারণাটি মেনে নিয়েছিল। ১৯৩০ এর দশকের শেষ দিকে তারা এটির উপরে আংশিক পরীক্ষার চেষ্টাও করেছিল। টেসলা তার পিস রের একটি প্রোটোটাইপ নির্মাণে সফল হয়েছিলেন কি না তা আজও অজানা। তবে যখন তিনি মারা যান, তার পরে আমেরিকান সরকার এই বিমের জন্য তার পরিকল্পনা খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তেমন কোন সুত্র পাওয়া যায়নি বলেই জানানো হয়।
পরিশেষে বলতে হয়, অনন্য ব্যক্তিত্ব এবং তার ভবিষ্যৎ জীবনযাত্রার কথা মাথায় রেখে প্রস্তাবিত উদ্ভাবনের কথা বিবেচনা করে, বিজ্ঞানী টেসলা “Mad Scientist” বা “পাগল বিজ্ঞানী” হিসাবে ব্যপকভাবে পরিচিত। তবে, প্রকৌশলী ও পদার্থবিজ্ঞানী সমর্থকদের মতে তার উদ্ভাবনী ক্ষমতা ছিল টমাস আলভা এডিসন, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল বা তাদের মতো সমসাময়িক অন্যান্য বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের চেয়েও উজ্জ্বল। তার মৃত্যুর পরেও তার আবিষ্কৃত বৈজ্ঞানিক কৃতিত্বগুলো বহু বছর ধরে প্রাপ্য স্বীকৃতি পায়নি। তবে সৌভাগ্যবশত, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার প্রতিভা এবং অর্জন আরো বেশি করে জানতে পারা যাচ্ছে এবং বর্তমান মানুষেরা যতটা না তার প্রাপ্য স্বীকৃতি দিতে পেরেছে, তার চেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ হয়েছে।
Feature Image Source: Learning History
Article Source: history, gizmodo,theweek, wikipedia, suite.io, livescience, teslasociety