পাহাড়ের গাঁ বেয়ে ধীরে ধীরে সূর্যটা ঢলে পড়ছে । হেমন্তকালের হিমেল হাওয়া বইছে আর বাতাসে গাছের পাতাদের শোঁ শোঁ শব্দ । এলো চুলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নদী সূর্যাস্ত দেখছে । গোধূলীর সময়টা তার কাছে অদ্ভুত সুন্দর মনে হয়। সে হুমায়ুন আহমেদের বইয়ে পড়েছিল যে, গোধূলীর আলোয় নাকি মেয়েদের সুন্দর লাগে তাই সে এই আলোকে কন্যা সুন্দর আলো নাম দিয়েছিল। আচ্ছা তাকে কি সুন্দর লাগছে এ আলোয়? একবার আয়নায় গিয়ে নিজেকে দেখতে ইচ্ছে হল নদীর কিন্তু গেল না। নিজেকে দেখার চাইতে প্রকৃতি দেখতেই তার বেশী ভাল লাগছে। ধীরে ধীরে আঁধার নেমে আসছে । রাত নামছে হাজার বছরের পুরনো রাত। হাজার বছর ধরে উপন্যাসের এই লাইনটা নদীর খুব পছন্দের। একসময় সে অনেক উপন্যাস পড়ত, এখন তার নিজের জীবনটাই তার কাছে একটা উপন্যাস মনে হয়।
নদীর রুম ঠিক পাহাড়ের গাঁ ঘেঁষে । পাহাড় দেখতে নদীর বেশ লাগে। নদীর সাথে পাহাড়ের কত সখ্যতা! হঠাৎ নদীর মন খারাপ হয়ে গেল। এক অজানা বিষাদ মন ছেয়ে গেল। নদীর মনে হল কেউ তাকে কেন বুঝতে পারে না। এই পৃথিবীতে তার মনের কথাগুলো খুলে বলার মত আপনজন কেউ নেই। কাউকে কেন সে বিশ্বাস করতে পারে না? কেন তার নিজেকে খুব একা লাগে, অসহায় লাগে মাঝে মাঝে। কেন তার কারো সাথে কোন সখ্যতা নেই? নদীর মা বাবা কেউ নেই। সে তার খালার কাছে মানুষ হয়েছে। তার খালা খুব ভাল মানুষ কিন্তু তার খালু! খালুর কথা মনে হতেই নদীর দুচোখ ভেঙে কান্না এলো। এই অমানুষটা তার জীবনের একটা কালো অধ্যায় । ছোটকাল থেকে এই অমানুষটা বিভিন্ন বাহানায় তার বুকে হাত দিত। প্যান্টের ভেতরে হাত ঢুকানোর চেষ্টা করত। আর ভয় দেখিয়ে বলত খালাকে বলে দিলে গলা টিপে মেরে ফেলবে। ভয়ে নদী কাউকে কিছু বলত না, শুধু একা একা কাঁদত । একদিন খালা বাইরে থেকে এসে দেখল খালু নদীকে আপত্তিজনকভাবে জড়িয়ে ধরে আছে আর নদী তার হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য হাত পা ছোড়াছুঁড়ি করছে। খালা ছুটে এসে খালুর হাত থেকে নদীকে রক্ষা করল আর তার ঠিক পরদিনই খালা নদীকে একটি বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিল। খালু নামক অমানুষটার হাত থেকে সে রক্ষা পেল ঠিকই কিন্তু সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাকে তাড়া করে ফেরে। সে সহজ হতে পারে না কারো সাথে। লজ্জায় কাউকে বলতে পারে না এসব কথা, যা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় সারাক্ষণ। নদী চিৎকার করে কান্না করতে শুরু করেছে। তার কান্নার আওয়াজ পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে অদ্ভুত এক শব্দ তৈরী করছে। ভাবছে, সে তো এমন জীবন চায়নি। কেন তার বাবা মা তাকে ছেড়ে ওপারে চলে গেল! তাকে কেন সাথে করে নিয়ে গেল না!
নদীর প্রতিদিন কাটে ভয়াবহ এই স্মৃতিকে সাথে নিয়ে। মাঝে মাঝে নিজেকে ঘেন্না লাগে। নদী ভাবে কি লাভ এ জীবন রেখে! তবু মরে যাওয়ার সাহস হয় না। এখন নদী অনার্স শেষ বর্ষে পড়াশোনা করছে। এতসব দুঃসহ স্মৃতির মাঝে ভাল লাগার বিষয় হল নয়ন। নয়ন তার সাথেই পড়ে। খুব দুষ্ট ছেলে, পুরো ক্লাস সবসময় মাতিয়ে রাখে। নদীর নয়নকে বেশ লাগে। অনেকবার তার ভাল লাগার কথা নয়নকে বলতে চেয়েছে কিন্ত বলতে পারে না সংশয়ে পাছে নয়ন তাকে ফিরিয়ে দেয়। আর নদীর কিই বা যোগ্যতা আছে নয়নকে ভালবাসার! তবু মন তো মানে না। নয়নের প্রতি ভালবাসা দিন দিন বাড়তেই থাকে।
আর নয়ন? সে কি আমাকে ভালবাসে? নদী ভাবে।
নদী সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে পাছে নয়ন তার ভালবাসার কথা জেনে যায়। নদী প্রতিদিন নয়নকে একটা করে চিঠি লিখে। চিঠি লিখে আবার তা ছিঁড়ে ফেলে, নয়নকে হয়ত কখনই চিঠিগুলো সে দিতে পারবে না। সে শুধু ক্লাসে লুকিয়ে লুকিয়ে নয়নকে দেখে। মাঝে মাঝে কথা হয়।
একদিন হঠাৎ নয়ন এসে নদীকে বলল, কি রে নদী তুই লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে কি এত দেখিস! নদী হকচকিয়ে গিয়ে বলল, কই কিছু না তো । তোকে কেন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে যাব? নয়ন আড় চোখে ঠোঁটে এক বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, কি রে তুই আবার আমার প্রেমে পড়ে যাসনি তো! নদী লজ্জায় লাল হয়ে কি বলবে বুঝতে পারছে না। শুধু অভিমানের সুরে বলল, তোর মত বাঁদরকে কে ভালবাসতে যাবে?
এরপর থেকে নদী আর নয়নের মধ্যে প্রতিদিন চোখে চোখে কথা হয়, খুনসুটি হয় অনেক । কেউ কাউকে কখনো বলে না ভালবাসি কিন্তু কোথায় যেন দুজনার মধ্যে এক অলিখিত সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেছে। ভালই কাটছিল তাদের সময়। একদিন নদীর মনে হল, নয়নকে এখন তার ভালবাসার কথা বলা যায়। তাই সে নয়নকে একদিন বলল নয়ন চল দূরে কোথাও থেকে ঘুরে আসি। নয়ন তার স্বভাবসুলভ দুষ্টমী ভরা কন্ঠে বললঃ ঘুরতে যাবি? চল যাই। কবে যাবি ঘুরতে? নদী বলল, চল কালই যাই। নয়নের চোখে আবারো দুষ্টমীর আলো খেলে গেল, ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি দিয়ে নয়ন বলল, লিটনের ফ্ল্যাটে যাবি নাকি? নদী নয়নের মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল, একদম মার খাবি ফাজিল!
সারা রাত নদীর ঘুম এলো না চোখে, ভাবছে কাল কিভাবে নয়নকে তার ভালবাসার কথাটা বলা যায়! যদি ও ফিরিয়ে দেয়? নয়নকে নিয়ে যে তার অনেক স্বপ্ন! ও ফিরিয়ে দিলে সব স্বপ্ন নিমিষেই ভেঙে যাবে যে! তবু নদী সিদ্ধান্ত নিল যে, সে নয়নকে কালই তার ভালবাসার কথা জানাবে যাই হোক না কেন!
রাতে প্রতিদিনের মত সে নয়নকে একটি চিঠি লিখল। কিন্তু এবারের চিঠিটা সে ছিঁড়ে ফেলল না। খুব সযতনে হ্যান্ডব্যাগের ভেতরে লাল একটা লাভ আকৃতির খামে ভরে রাখল। কাল এটা নয়নকে সে দেবে।
সকালে খুব সুন্দর সাদা শাড়ি পড়ল নদী কারন নয়ন একবার নদীকে বলেছিল, নদীর পানির রঙ সাদা আর তুইও তো নদী , তাই তোরেও মনে হয় সাদা রঙের শাড়িতে ভাল লাগবে। একদিন সাদা শাড়ি পরিস তো! দেখবনি তোরে কোন নদীর মত লাগে!
তাই আজ নদী সাদা শাড়ি পড়েছে । লাল ব্লাউজ, কপালে লাল টিপ। হাতে লাল চুড়ি । ব্যাগের ভেতরে লাল খামে নয়নের জন্য চিঠি। নয়ন তার জন্য বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছে। নদী দ্রুত একটা রিকশা নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে গেল। নয়ন এখনও আসেনি। নদীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে । লজ্জায় চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। ভাবছে কিভাবে সে নয়নকে তার ভালবাসার কথা জানাবে! এমন সময় ফোন বেজে উঠল, ফোন বের করে দেখল নয়ন ফোন করেছে । ফোন রিসিভ করতেই নয়ন বলল, কিরে নদী তুই কই? আমি তো একটা কাজে বাসায় ফেঁসে গেছি। কাজটা শেষ করতে ২/৩ ঘন্টা লাগবে । তুই এক কাজ কর। আমার বাসায় চলে আয়। এতক্ষণ একা একা বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নাই। আমার কাজ শেষ করেই তোকে নিয়ে বের হব। প্রথমে নদী যেতে চাইল না, আবার পরক্ষনেই তার মনে হল এখন আর হোস্টেলে ফিরে গিয়ে কি হবে! এর চাইতে নয়নের বাসায় গিয়ে ওর পরিবারের সবার সাথে সময় কাটানো যাক, হবু শশুরবাড়ির লোকজন কেমন দেখে নেয়া যাক! এরকম সাত পাঁচ ভেবে নদী নয়নের বাসায় যেতে রাজি হল।
(আগামী পর্বে থাকছে বাকি অংশ… )