“আমি বাবা ও মায়ের শত আদরের মেয়ে
আমি বড় হই সকলের ভালোবাসা নিয়ে
আমারও দুচোখে অনেক স্বপ্ন থাকে
আমি পড়া লেখা শিখতে চাই…..”
হ্যাঁ, মিনা কার্টুন । নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেয়া ছেলে মেয়েগুলোর মধ্যে এই লাইন গুলোর সাথে পরিচিত নয়, এমন খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। সেই নব্বইয়ের দশকে একটাই টিভি চ্যানেল ছিলো তখন, বিটিভি, বাংলাদেশ টেলিভিশন। আর সেই একখানা চ্যানেলে ছোটদের সবচেয়ে প্রিয় অনুষ্ঠান এই একখানা, মীনা কার্টুন।
এখনও মনে আছে, টিভির রুমে টিভি চলতো, কিন্তু দিনের বেলায় তেমন কেউই দেখতো না। বিনা নোটিশেই মীনা কার্টুন শুরু হতো, নির্দিষ্ট টাইম টেবিল ছিলো না!!!! তবে বৃহস্পতিবার বিকেলে মীনা কার্টুন প্রচারের জোর একটা সম্ভাবনা থাকতো। যেই পাশের রুম থেকে সূচনা সংগীতের প্রথম লাইন শুনতাম, যে কাজই থাকুক, দৌড়ে হাজির হতাম। গ্রামের এক কিশোরীর তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা পরিবর্তনের নিরন্তর চেষ্টা। কার্টুনটা দেখার সময় মনে হতো, আমিও একদিন মীনার মতো সব অনুচিত কাজগুলোর পরিবর্তন করবো!!! ক্ষুদ্র মনের বৃহৎ ইচ্ছা!!! একই টপিকের কার্টুন যে কতবার দেখেছি, সংলাপই মুখস্থ হয়ে যেত আমাদের….
” রিতা, ও রিতা, তুমি আমার রিতা!!”
কিংবা, ” যৌতুক বন্ধ করো।”…
সেই সময় জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনিসেফের তত্ত্বাবধানে নির্মিত জনসচেতনতামূলক কার্টুন ছিলো সেটি। দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে ডাবিং করে প্রচার করা হতো কার্টুনটি। প্রত্যেকটা কার্টুনই এক একটা থিম নিয়ে বানানো হতো। অতো ছোট বয়সে সেসব তেমন বুঝতাম না হয়তো, কিন্তু মীনা, রাজু আর মিঠুর প্রতি একটা দুর্নিবার আকর্ষণ ছিলো তখন। মীনার দাদিকে একেবারে সহ্য হতো না, শুধু রাজুকে আদর করতো!! স্কুলের সেই মোটা আপাটা, কেমন বদমেজাজি ছিলো। আর সেই লাল রঙের গরুটা, লালী। আমরা বড় হয়ে গেছি ঠিকই, কিন্তু এই চরিত্রগুলো এখনও সেই ছোট্টটি রয়ে গেছে!!!
এখন আর সেই একখান চ্যানেলের যুগ নেই। রিমোট টিপলেই পৃথিবীর অন্যপ্রান্তের সব খবরা খবর পাওয়া বা, অন্য দেশের চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখতে পাওয়া অনেকটা পানি খাওয়ার মতোই সোজা। আগে আমরা এক চ্যানেলে সব রকমের অনুষ্ঠান দেখতাম, আর এখন অনুষ্ঠানের ভিত্তিতেই তৈরি হচ্ছে আলাদা আলাদা চ্যানেল। কোনোটা সারাদিন গান, কোনোটা সারাদিন মুভি বা কোনোটা শুধু কার্টুন দেখানোর জন্যই তৈরি করা হচ্ছে। এখনকার বাচ্চারাও অনেক স্মার্ট। তারা নিজেরাই জানে রিমোটে কত নম্বর চ্যানেল চাপ দিলে তার প্রিয় চ্যানেল চলে আসবে, বাবা মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। এখন একটা বাচ্চা সকালের নাস্তা বা দুপুরের ভাত বা রাতের খাবার – সবই হয় টিভি দেখেই!!!! বাচ্চারা হা করে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে আর মায়েরা সেই হা এর ভিতর ভাত টেসে ঢুকিয়ে দেয়!!!!
কিন্তু বাচ্চার মন তো বাচ্চাই!! সে তার মনের আনন্দ অনুযায়ীই অনুষ্ঠান খুঁজে নিবে, এটাই স্বাভাবিক। আর এই আনন্দ গুলো এখন পাওয়া যায় বিদেশি চ্যানেলের বিদেশি কার্টুনগুলোতে!! বেশিদিন আগের কথা নয়, পুরো বাংলাদেশ ডোরেমন কার্টুন নিয়ে ব্যস্ত ছিলো!! দেশপ্রেমিকরা প্রশ্ন তুললো, বাচ্চারা বাংলা ভাষা না শিখে বিদেশি ভাষা শিখছে!! বিদেশি ভাষায় কথা বলছে!! প্রতিবাদের ফল স্বরূপ ঐ চ্যানেলই বন্ধ করে দেওয়া হলো। কিন্তু কতখানি লাভ হয়েছে জানি না। আমি এখনও অনেক বাচ্চাকে হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শুনি। যদি জিজ্ঞাস করি, তখন উত্তর পাই “মটু পাতলু কি জোড়ি!!!”
আমি বাচ্চাদের দোষ দিবো না। তারা সেটিই বেছে নিবে, যা তাদের আনন্দ দেয়। আর বাবা মায়েদের দোষও দেওয়া যায় না, কারণ দেশীয় চ্যানেলগুলোতে কার্টুন অনুষ্ঠান খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর!!!!! কিছু চ্যানেল পরবর্তীতে ডোরেমন কার্টুনই বাংলা ডাবিং করে প্রচার শুরু করে। খুব তাড়াতাড়ি জনপ্রিয়তা পাওয়ার শর্টকাট উপায়!!!! অন্তত বিদেশি ভাষা তো আর শিখছে না!!!
আমরা বাঙালীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলাই সবচেয়ে সহজ সমাধান ভাবি!!! বিদেশি সংস্কৃতি থেকে বাচ্চাদের রক্ষা করার জন্য আমরা হয় চ্যানেল বন্ধ করে দিচ্ছি, অথবা ভাষা পরিবর্তন করে নিজস্ব চ্যানেলে প্রচার করছি। কিন্তু মৌলিক চিন্তা ভাবনা আদৌ কয়জন করছি?? বিদেশি সিরিয়াল অনুকরণে আমরা চকচকে সিরিয়াল বানাচ্ছি, কিন্তু কার্টুন বানাচ্ছি কয়জন?? চ্যানেলগুলো বলে স্পন্সর পাই না, লস দিয়ে কার্টুন দেখাবো কেন??
ইউটিউবে সার্চ দিলে কিছু এনিমেটেড ঠাকুরমার ঝুলি বা রূপকথার গল্প খুঁজে পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তা দেখার আগ্রহী খুব কমই পাওয়া যায়!!! আর আমাদের দেশ এখনও এতোটা আপডেট হয়নি যে, বাবা মায়েরা মোবাইলের ডাটা খরচ করে নিজের বাচ্চাকে কার্টুন দেখাবে!!! আমরা এখনও ফ্রি ফেসবুক চালাতে আগ্রহী জাতি!!
নব্বইয়ের দশক থেকে ২০১৭। ক্যালেন্ডারে অনেকগুলো পাতা উল্টেছে। কিন্তু সমাজ কতখানি পরিবর্তিত হয়েছে?? মীনা যৌতুক বন্ধের কথা বলতো। যৌতুক শব্দের ব্যবহার বন্ধ হয়েছে ঠিকই, এখন সবাই বলে “উপহার”। আর উপহার দেওয়ার পরিমাণ!!! সে তো আমরা হরহামেশাই দেখি, পরিমাণটা আলাদা করে না হয়, নাই বললাম। স্যানিটেশন নিয়ে আমরা এখন এতই সতর্ক যে, নালার পানি আর নদীর পানি এখন সহোদর ভাই বোন!!! দুটোই কালো!!! এখনও মেয়েরা অল্প বয়সে মা হয়, তবে চুপিচুপি। আর সেই নবজাতক গুলোকে ছুঁড়ে ফেলা হয় ডাষ্টবিনে অথবা বিল্ডিংয়ের পিছনে!! এখনও গৃহকর্মীরা নির্যাতিত হয়। মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত তারা। ছেলে মেয়ের সমান অধিকার এখনও স্বপ্নই রয়ে গেছে, লোকাল বাসের সিট বন্টন দেখলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট বুঝা যায়!! ইভটিজিংয়ের শিকার তো আমি বা আমার ছোট বোন প্রতিদিনই হচ্ছি, কখনও মুখের ভাষায় , কখনো বা চাক্ষুষ দর্শন দ্বারা!!!
এমন আরো উদাহরণ দেয়া যাবে। ২০১৭ এর ডিজিটাল যুগেও মীনা কার্টুনের প্রয়োজনীয়তা এতটুকু কমে যায়নি। সমাজের সমস্যাগুলো কমেনি, বরং বেড়েছে!! নতুন অনেক কিছুই এখন যুক্ত হয়েছে, যেমন- মাদকাসক্তি, বেকারত্ব, যৌন নির্যাতন, অপসংস্কৃতি, শিশুহত্যাসহ আরো অনেক কিছু!! আমরা এখন এগুলোর জন্য মিটিং করি, মিছিল করি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করি। আর বাচ্চারা বিদেশি কার্টুনের নবিতাকে দেখে অলস হতে শিখে, কিংবা মিথ্যা বলতে শিখে। মটু পাতলু কার্টুনের পাতলুর মতো বলে উঠে ‘আইডিয়া’!!!! আমার পিচ্ছি চাচাতো ভাইটাও এখন বিছানা থেকে লাফ দেওয়ার সময় বলে উঠে, ” শিবা”!!! পরে জানলাম এই নামে একটা হিন্দি কার্টুন আছে!!!
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, যদি শিশুদের বিদেশি কার্টুন দেখতে না দেওয়া হয়, তবে তারা দেখবে কি?? বাংলা চ্যানেল গুলোর ভুড়ি ভুড়ি বিজ্ঞাপন?? নাকি হিন্দি চ্যানেলের অনুকরণে বানানো সিরিয়াল গুলো?? নাকি জাতীয় আঁতেলদের টক শো?? অথবা লেট নাইট লাইভ সংগীতানুষ্ঠান?? আমরা তরুণ – তরুণী বা কিশোর- বৃদ্ধ সবার জন্য কিছু না কিছু অনুষ্ঠান বানাচ্ছি। কিন্তু শিশুদের জন্য কই?? ‘শিশুদের জন্য অনুষ্ঠান’ ব্যানারে আদৌ যে অনুষ্ঠানগুলো হয়, সেগুলো কতজন শিশু আসলে দেখে তা জরিপ করে দেখা উচিত!!
শিশুদের ভবিষ্যতে সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই হোক অথবা তাদের দেশীয় সংস্কৃতি শিক্ষা দেওয়ার খাতিরেই হোক আমাদের নিজস্ব কিছু মৌলিক কার্টুন বা এনিমেশন তৈরি করা উচিত। আমাদের কার্টুনিস্টদের মাথায় আইডিয়া গিজগিজ করে ঠিকই, কিন্তু পকেট ফাঁকা থাকার দরুন তাদের সেই চলমান আইডিয়া গুলো এনিমেশনের বাস্তব রূপ পায় না!! মীনা কার্টুনের পর একুশে টিভির মন্টু মিয়া অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কিন্তু ব্যস, এতোটুকুই!! এরপর আর তেমন কোনো দেশীয় কার্টুন আমরা পাইনি।
তাই, সংস্কৃতি বাঁচানোর জন্য শুধু শুধু বাচ্চাদের তাদের বিনোদন থেকে বঞ্চিত না করে বরং তাদের জন্য দেশীয় বিনোদন সৃষ্টি করার প্রয়াস চালানো উচিত। আমাদের দেশে এই খাতে সম্ভাবনার অভাব নেই, তবে পৃষ্ঠপোষকতার অভাব যেন দিন দিন বাড়ছেই। প্রত্যাশা রাখি, মীনা বা মন্টু মিয়ার মতো আরো কিছু মনে রাখার মতো চরিত্র সৃষ্টি হবে। আজ থেকে বিশ- বাইশ বছর পরে গিয়ে আমার মতোই কেউ একজন হয়তো, তার ছোটবেলায় দেখা কার্টুন নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভুগবে….