অবসর সময়ে নিজেকে সুখী করার জন্য, আনন্দ পাওয়ার জন্য আমরা কেউ কেউ গান শুনি, কেউ ছবি আঁকি বা সিনেমা দেখি। আমরা অনেকেই নিজেদের মনের ভেতর একটি শখ লালন করি যা আমাদের আনন্দ দেয়, মনে শান্তি আনে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কিছু আছে যারা শখের বসে খুন করে! জি হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়েছেন। আমাদের মাঝে এমন অনেকেই আছেন যারা শখের বসে খুন মানুষ হত্যা করেন। মানুষ হত্যা করে তারা অসম্ভব রকমের মানসিক তৃপ্তি পান। মানুষকে ভুলিয়েভালিয়ে নিত্যনতুন কায়দায় একের পর এক খুন করে যাওয়া মানসিকভাবে অসুস্থ রোগীরাই “সিরিয়াল কিলার” বলে পরিচিত। আজ তেমনই একজন সিরিয়াল কিলার নিয়ে আজ আমাদের এই ফিচার, যার নাম লিওনার্দা সিয়ানসিউলি।
লিওনার্দা শুধু একজন খুনি ছিলেননা। তার মানসিকতা এতটাই বিকৃত ছিলো যে তিনি মানুষ খুন করে সেসকল মৃতদেহের হাঁড়-চর্বি-গোশত দিয়ে সাবান এবং কেক বানাতেন!
লিওনার্দা
জন্মসূত্রে লিওনার্দা ছিলেন ইটালিয়ান। তিনি বড় হয়েছেন এক ধার্মিক পরিবারে। তার পরিবার শুধু ধার্মিক ছিলোনা, তার পরিবার ছিলো নানান ধরণের ধর্মীয় গোঁড়ামি আর কুসংস্কারের ডিপো। লিওনার্দার বেড়ে ওঠার পরিবেশ স্বাভাবিক ছিলোনা বলেই হয়তো তার মনে ভয়ঙ্কর অসুখ তিল তিল করে মহীরুহে পরিণত হয়েছিলো। লিওনার্দার পরিবার ছিলো এক ফরচুন টেলারের ভক্ত। তারা তাদের সমস্ত সিদ্ধান্ত সেই ফরচুন টেলারের অনুমতি নিয়েই গ্রহণ করতেন। সেই ফরচুন টেলারই লিওনার্দার ভবিষ্যৎবাণী করে বলেছিলেন যে লিওনার্দার বিয়েও হবে এবং তিনি হবেন অনেক সন্তানের জননী। তবে তারা সকলেই খুব অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ করবে। এই ভবিষৎবাণী লিওনার্দার মনে গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিলো।
লিওনার্দা বিয়ে ১৯১৭ সালে বিয়ে করেন এক রেজিস্ট্রি অফিসের ক্লার্ককে। এই বিয়েতে তার বাবামায়ের একেবারেই সম্মতি ছিলোনা। তারা লিওনার্দার বিয়ে ঠিক করেছিলো এক ধনী ব্যক্তির সাথে। এই বিয়েকে কেন্দ্র করে লিওনার্দার বাবা মা তার সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং লিওনার্দার বিয়েকে তারা অভিশপ্ত বলে ঘোষণা করেন। লিওনার্দা কখনো শান্তি পাবেনা, এমন অভিসম্পাতই তারা দিয়েছিলেন। বিয়ের পর লিওনার্দা স্বামী নিয়ে স্থায়ী হন করেজিয়ো নামের এক মফস্বলে।
লিওনার্দা ও তার স্বামী
লিওনার্দা তার বৈবাহিক জীবনে মোট ১৭ বার গর্ভবতী হন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, তা গর্ভজাত মাত্র ৪ জন সন্তান জীবিত ছিলো। বাকিদের অনেকেই গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন মারা গেছে অথবা শৈশবেই অকালে ঝরে গেছে। লিওনার্দা তার বাড়ির পাশে একটি ছোট্ট দোকান চালাতেন এবং তার ছেলেমেয়েরা তাকে সাহায্য করতো। তিনি ছিলেন তার সন্তানদের ভালোবাসায় অন্ধ। কাউকে তিনি এক মূহুর্তের জন্য চোখের আড়াল করতেন না। কিন্তু চিত্রপট পালটে যেতে লাগলো যখন শুরু হলো ২য় বিশ্বযুদ্ধ।
লিওনার্দার সবচেয়ে বড় ছেলের নাম ছিলো জিসেপি। সে ছিলো তখন টগবগে যুবক। অন্যান্য তরুণ ইটালিয়ানের সে ও ইটালিয়ান সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণ করতে চাইলো। তখনই লিওনার্দার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরলো! জিসেপি ছিলো তার সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। তাকে হারানোর আশঙ্কায় লিওনার্দার ঘুম হারাম হয়ে গেলো। সে অনেক চেষ্টা করেছিলো জিসেপিকে থামানোর। কিন্তু সে ছিলো তার মায়ের মতোই জেদি এবং একরোখা। সে চলে গেলো যুদ্ধে। অন্যদিকে সন্তান হারানোর চিন্তায় লিওনার্দা তখন পাগলপ্রায়। হঠাৎ একদিন তার মাথায় এলো, প্রাণের বদলে উৎসর্গ করতে হবে প্রাণ। জিসেপির প্রাণ বাঁচানোর জন্য তাকে বলি দিতে হবে অন্য কোন প্রাণ। যে সে প্রাণী হলে চলবে না, মানুষের বদলে মানুষের প্রাণই উৎসর্গ করতে হবে!
লিওনার্দার এলাকার মহিলারা তাকে খুব পছন্দ করতো। লিওনার্দাকে ধার্মিক এবং সৎ বলেই তারা জানতো। তারা বিশ্বাস করতো যে লিওনার্দার কিছু আধ্যাত্মিক ক্ষমতা রয়েছে। তেমনি একজন মহিলা ছিলেন ফস্টিনা সেতি।
ফস্টিনা সেতি ছিলেন একজন মাঝবয়েসী অবিবাহিত মহিলা। তখনকার দিনে মধ্যবয়সী মহিলার অবিবাহিত থেকে যাওয়া এক বিশাল ব্যাপার! ফস্টিনা লিওনার্দাকে খুব পছন্দ করতেন। তিনি লিওনার্দার কাছে আসতেন দুটি শান্তির, ধর্মের কথা শুনতে। আর এই ফস্টিনাকেই টার্গেট করলেন লিওনার্দা। লিওনার্দা ফস্টিনাকে বললেন যে তিনি ফস্টিনার জন্য একজন বিবাহযোগ্য পাত্র খুঁজে পেয়েছেন। পাত্র তারই আত্মীয়, সে ফস্টিনাকে বিবাহ করতে আগ্রহী। তবে পাত্র থাকে ‘পুলা’ শহরে। ফস্টিনাকে যেতে হবে সেখানে। তখনকার দিনে এমনটা প্রায়ই হতো।
ফস্টিনা সরল মনে বিশ্বাস করলেন সবকিছু। লিওনার্দা তাকে এও বললেন, বিয়ের কথা যেন কেউ জানতে না পারে। তাহলে লোকের কুনজরে ভেস্তে যাবে সব। তিনি বললেন যাওয়ার আগে যেন ফস্টিনা পোস্টকার্ডে করে লিখে সবাইকে সবকিছু জানিয়ে যায়। তাহলে সবাই নিশ্চিন্তে থাকবে। ফস্টিনা তাই করলো। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো, আত্মীয় স্বজনদের নামে পোস্টকার্ড পোস্ট করে গেলো, সেখানে লেখা ছিলো পুলা তে তার হবু স্বামীর কথা। যাওয়ার আগে সে দেখা করতে গেলো লিওনার্দার সাথে। সেটাই হলো তার কাল।
বিকেলবেলা লাগেজ লিওনার্দার বাড়ি গেলো ফস্টিনা, সেখান থেকে সোজা স্টেশনে যাবে সে। লিওনার্দার বাচ্চারা তখন বাইরে খেলছে। ফস্টিনাকে ঘুমের ওষুধ মেশানো রেড ওয়াইন খাওয়ালেন লিওনার্দা। তারপর তার অচেতন দেহটিকে নিয়ে গেলেন বেজমেন্টে। সেখানে কুঠার দিয়ে আলাদা করে ফেললেন ফস্টিনার মাথা। তাজা রক্ত জমা করলেন একটি ডিশে। তারপর দেহটিকে নয় টুকরা করলেন। পরের প্রক্রিয়া শুনুন তার জবানীতে,
“প্রথমে ওর শরীরটাকে নয় টুকরা করলাম। তারপর চুলোতে চড়িয়ে দিলাম বিশাল এক হাড়ি। আমার দোকানে বিক্রির জন্য আমিই সাবান বানাই। সেই সাবান বানানোর জন্য সাত কেজি কস্টিক সোডা রাখা ছিলো। ফস্টিনার গায়ের মাংস চর্বিগুলো কস্টিক সোডা দিয়ে সেদ্ধ করলাম। হাড়গুলো তুলে ফেললাম, পরে সেগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলেছি। গোশত চর্বি গলে যখন পুরো মিশে গেলো, তারপর মিশ্রনটা ঢেলে দিলাম একটা সেপটিক ট্যাঙ্কে। সেখানে যখন সাবানটা জমাট বাঁধলো, কেটে টুকরো টুকরো করে নিলাম। তারপর জমাট বাঁধা রক্তগুলো ওভেনে একটু বেক করে রক্তের পানি শুকিয়ে ঝরঝরে করে নিলাম। তারপর ওতে একে একে ময়দা, চিনি, চকলেট, ডিম, দুধ এবং মার্জারিন মিশিয়ে খুব ভালো করে মিশিয়ে খামির বানালাম। এবং এই খামির থেকে বানালাম প্রচুর টি কেক। সেই কেক দোকানে বিক্রি করেছি, মেহমান এবং ঘরের লোকদের খাইয়েছি, আমিও খেয়েছি।”
লিওনার্দা তার ২য় ভিক্টিম ফ্রাঞ্চেসকা ক্লিমেনটিনা সোভিকেও অন্য শহরের চাকরির প্রলোভন দেখায় এবং একই উপায়ে হত্যা করে তার মৃতদেহ থেকে সাবান ও কেক বানান।
যে পাত্রে সাবান বানানো হতো
লিওনার্দার তৃতীয় ভিক্টিম ছিলো গরীব বিধবা ভার্জিনিয়া ক্যাসিয়োপো। তাকে চাকরীর লোভ দেখিয়ে ঠিক আগের মতোই ফাঁসানো হয়। তবে লিওনার্দার ভাষায়া, অন্যন্য ভিক্টিমদের চেয়ে ভার্জিনিয়া বেশ ভালো ছিলো। অন্যদের মৃতদেহ থেকে সাধারণ গন্ধবিহীন সাবান বানালেও ভার্জিনিয়ার মৃতদেহ থেকে তিনি বানিয়েছিলেন সুগন্ধী সাবান! ভার্জিনিয়ার গায়ে চর্বি বেশি থাকায় সাবানগুলো খুব “ক্রিমি” হয়েছিলো। টি কেকগুলোও নাকি ছিলো চমৎকার! তার ভাষায়, ভার্জিনিয়া খুব “মিষ্টি” মেয়ে ছিলো!
লিওনার্দার ভিক্টিমেরা
লিওনার্দার প্রথম দুই ভিক্টিম তাদের পরিবারের কাছে ছিলো বোঝাস্বরূপ। কিন্তু ভার্জিনিয়া তেমন ছিলোনা। ভার্জিনিয়া সবাইকে পোস্টকার্ডের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছিলো যে সে চাকরীর জন্য ফ্লোরেন্স শহরে যাচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘদিন তার খোঁজ না পাওয়ার তার ভাবী শরণাপন্ন হয় পুলিশের। তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে ভার্জিনিয়া ফ্লোরেন্সে নেই। ভার্জিনিয়ার ভাবী জানতো যে শহর ছেড়ে যাওয়ার আগে ভার্জিনিয়া দেখা করতে যাবে লিওনার্দার সাথে। সে দেখেছিলো ভার্জিনিয়ে লিওনার্দার বাড়িতে ঢুকতে। ভার্জিনিয়ার ভাবী পুলিশ নিয়ে যায় লিওনার্দার বাড়িতে। পুলিশ যখন তাকে জিজ্ঞাসা করব ভার্জিনিয়ার কথা, লিওনার্দা পষ্টাপষ্টি জানিয়ে দেয় যে সে খুন করেছে ভার্জিনিয়াকে। পুলিশ তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার করে তাকে।
আদালতে লিওনার্দা
আদালতে সকল অপরাধ অকপটে স্বীকার করে লিওনার্দা। তার ছেলেমেয়েরা যেন দীর্ঘায়ু লাভ করে, তাই জন্যে সে নরবলি দিয়েছে। তার সন্তানের প্রাণের বদলে অন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছে সে। তার স্বীকারোক্তি এবং খুনের বর্ণনা শুনে আদালত তাকে মানসিক রোগী বলে আখ্যায়িত করে এবং তাকে মেন্টাল আ্যসাইনমেন্ট রাখার আদেশ দেয় এবং তাকে সলিটারি কনফাইনমেন্টে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়।
১৯৭০ সালের ১৫ই অক্টোবর ইতালির পটজুলি শহরের মহিলা ক্রিমিনাল আ্যসাইলেমে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যান লিওনার্দা। যে হাঁড়িতে তিনি তার ভিক্টিমদের সেদ্ধ করতেন, সেটি আজও ইতালির রোমে “ক্রিমিনোলজিক্যাল মিউজিয়াম” এ সংরক্ষিত আছে।