আমরা সামাজিক জীব হিসেবে সমাজে বাস করি। দেশ, কাল, সমাজ আর ব্যক্তি ভেদে আমাদের মধ্যে রয়েছে চিন্তা ও ভাবনার ভিন্নতা ।
যেগুলো থেকে আমরা সচেতন বা অসচেতনভাবে বের হতে চাই না আবার অনেক সময় সমাজের চাপে বের হতে পারিনা। এই বিংশ শতাব্দীতে এসে সমাজের দোহায় দিয়ে যখন আমরা সমাজের ধরা বাঁধা চিন্তা ভাবনা থেকে বের হতে পারি না , তখন আমাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা সমাজের সেই প্রাচীন ধ্যান ধারনাকে আরও শক্ত পোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। কারণ সমাজ গঠিত হয় আমাদেরকে নিয়েই। সমাজের নিয়ম কানুন তৈরি করি আমরাই। তাই সমাজের দোহায় দিয়ে ধরা বাঁধা চিন্তা চেতনা থেকে যখন আমরা বের হয়ে আসতে পারি না, তখন সেই দায় আর সমাজের থাকে না সেই দায় হয়ে যায় আমাদের ব্যক্তিগত অপারগতা।
যাইহোক, এরকমই একটি বিতর্কিত এবং আমাদের সমাজের মানুষের মানসিক জগতে চলমান একটি দ্বন্দ্ব নিয়ে আজ লিখব। এই লেখার পেছনে অনুপ্রেরনা হিসেবে কাজ করেছে আমার আশেপাশের কিছু প্রিয় মানুষ যারা সমাজের এই বাঁধা ধরা চিন্তা চেতনার যাঁতাকলে পড়ে নিজেদের জীবনের মূল্যবান অনুভূতি আর সময়গুলো বিষণ্ণতায় কাটাচ্ছে।
বিষয়টি হচ্ছে, কম বয়সী ছেলে এবং বেশী বয়সী মেয়ের প্রেম এবং বিয়ে ।
আমাদের সমাজে এটা খুবই প্রচলিত এবং স্বীকৃত যে, বিয়ের ক্ষেত্রে সবসময় ছেলের বয়স বেশী হতে হবে এবং মেয়ের বয়স কম হতে হবে নাহলে বোঝাপড়া হবে না। আরেকটা কারন হিসেবে বলা হয় যে, মেয়ের বয়স ছেলের চাইতে বেশী হলে পরবর্তীতে যৌন জীবনে সমস্যা হবে। আবার এটাও ভাবা হয় বয়সে বড় মেয়ে বিয়ে করলে মেয়েটিকে স্বামীর চাইতে বেশী বয়স্ক দেখাবে লোকে কি বলবে ইত্যাদি ইত্যাদি । আরো নানারকম কথা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে আমাদের সমাজে। আসলেই কি তাই? আসলেই কি বয়সে বড় মেয়ে বিয়ে করলে এই সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হতে হয়?
আসলেই বয়সে বড় মেয়ে বিয়ে করলে কোন সমস্যা বা অসুবিধা হয় কিনা সেই বিষয়ে যাওয়ার আগে চলুন একটা অনানুষ্ঠানিক অনলাইন জরিপের দিকে চোখ বুলিয়ে আসি। এই অনলাইন জরিপটি করেছিলাম বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে। যদি সবগুলো গ্রুপের সদস্য সংখ্যা হিসাব করি তাহলে সব মিলিয়ে ৩ লাখ সদস্য হবে। কিন্তু এই জরিপটিতে গড়পড়তা ২০০ জন অংশগ্রহন করেছে। আর প্রশ্নগুলো নেয়া হয়েছে বয়সে বড় মেয়ে আর বয়সে ছোট ছেলের প্রেম অথবা বিয়ের ক্ষেত্রে সমাজে প্রচলিত কথা থেকে । আবার ভোটে অংশগ্রহণকারী অনেকেও তাদের নিজেদের উত্তর বা এরকম প্রেম বা বিয়ের ক্ষেত্রে তারা কি মনোভাব পোষন করে তা যুক্ত করেছিল। এখানে অংশগ্রহণকারীরা সবাই ছেলে ছিল।
প্রশ্ন ছিলঃ
কি কারণে আপনি আপনার চাইতে বয়সে বড় মেয়ে বিয়ে করতে চান না?
উত্তরসমূহঃ
১। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা —- ১৬০ জন
২। মেয়েকে দেখতে বয়স্ক লাগবে—- ১৪৫ জন
৩। ম্যাচিউরিটি বেশী থাকবে ছেলেদের চেয়ে —– ১২৮ জন
৪। ভবিষ্যৎ যৌন জীবন চিন্তা করে ——- ১২৪ জন
৫। বোঝাপড়া হবে না —— ৬২ জন
৬। পরিবার মেনে নিবে না —— ৫৯ জন
৭। সহজাত প্রবৃত্তি —— ৫১ জন
৮। Ego & Power Problem Conflict হবে –——- ৪০ জন
৯। ভালোবাসা থাকলে বয়স ফ্যাক্ট না —— ৩৮ জন
১০। করতে চাই না কে বলল —— ৩২ জন
১১। বয়স্ক মেয়েরা সব কিছুতেই প্রতিবাদ করবে বা যা বলা হবে তা সহজে মেনে নিবে না যা কম বয়সী মেয়েরা মেনে নিবে —– ২৭ জন
১২। বেশি বয়সী মেয়েরা নিজের অভিমত চাপিয়ে দিতে পারে ——– ২৩ জন
১৩। মেনোপজের পর আর বাচ্চা উৎপাদন করতে পারবে না ———- ২১ জন
১৪। বয়সে বড় মেয়েরাই বয়সে ছোট ছেলে বিয়ে করতে চায় না ———- ১৯ জন
১৫। বয়স্ক মেয়েরা আহ্লাদী হয় না ——- ১৮ জন
১৬। যৌনজীবনে সুখী হওয়া যাবে না —— ১৩ জন
১৭। আমি করতে চাই। বয়সে বড় মেয়ে বিয়ে করলে একটা সুন্নত আদায় হবে ——- ১২ জন
১৮। ভালবাসা না থাকলে সম্ভব না ——– ১২ জন
১৯। মানায় না — ১১ জন
২০। বয়সে বড় মেয়েরা ছেলেদের একটু underestimate করে এবং ছোট হওয়ার কারনে ভাই ভাই আচরন করে — ৯ জন
২১। বিবর্তনের ফলে আমাদের মাঝে থেকে যাওয়া জেনেটিক প্রোগ্রামিং ——— ৫ জন
২২। তাড়াতাড়ি বুড়ি হবে ———- ৫ জন
২৩। সিনিয়রদের উপর ক্রাশ খাওয়া যায়, প্রেম করা যায়, কিন্তু সাংসারিক লাইফে বোঝাপড়াটা মেলেনা ——— ৪ জন
২৪। এদেশীয় কালচারের কারণে। অনভ্যস্ততা থেকে ভয় ———- ৪ জন
২৬। অহং সত্তায় আঘাত লাগবে ———- ৪ জন
২৫। সবগুলি কারনই গ্রহনযোগ্য ————- ৪জন
দুই চতুর্থাংশ উত্তরেই দেখলাম সমস্যা মেয়েদের দেখতে বুড়ি লাগবে অর্থাৎ মেয়েদের বয়স্ক দেখাবে ছেলেদের চাইতে সেই ভয়ে অনেকে বয়সে বড় মেয়ে বিয়ে করতে আগ্রহী নয়। এটা দেখে কেন জানি মনে হল দেখি তো মেয়েদের চেহারা নিয়ে কোন প্রবাদ পাওয়া যায় কিনা। প্রচলিত আছে কিনা কোন প্রবাদ মেয়েদের দর্শন নিয়ে। যা পেলাম তা অবশ্য কিছুটা অনুমেয়ই ছিল। অনেক পেলাম । এখানে শুধু ৩টা উদাহরন দেই ।
“ছোটকালে সোনামুখ
বয়সের কালে আয়না
বুড়াকালে বান্দরীমুখ
কেউর দিকে কেউ চায় না”
“কুড়িতেই নারী হয় যে বুড়ি”
“উঁচ কপালী চিঁড়ল দাঁতী
লম্বা মাথার কেশ
এমন নারী করলে বিয়ে ঘুরবে নানান দেশ”
পুরুষদের চেহারা সুরত বা দর্শন বা বয়স হলে তাদের কেমন দেখতে লাগবে এমন কোন প্রবাদ বাক্য চিরুনি অভিযান করে পেলাম না। ছোটকাল থেকে একটা কথাই শুনে আসছি যে, ছেলেদের বয়স কোন বিষয় না, চেহারা বা গাঁয়ের রঙ কোন বিষয় না । এদের যোগ্যতাই সব । যেহেতু এদের চেহারা সুরত কোন বিষয় না তাই হয়ত ছেলেদের নিয়ে কোন প্রবাদ বাক্য নেই। আবার এটাও হতে পারে যে এসব প্রবাদ বাক্যের প্রবক্তা যেহেতু ছেলে এবং যেহেতু তারা নিজেদের সবসময় চির তরুন ভাবে সেহেতু তাদের বয়সকালে কেমন লাগবে সে নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা ছিল না।
কিন্তু মেয়েদের বয়স অনেক কিছু, বয়স বাড়লে আর মেয়েদের বিয়ে হবে না । মেয়ে কালো হলে ছেলে পছন্দ করবে না তাই মাখো রঙ ফর্সাকারী ক্রিম, মাখো মুখে হলুদ, মরিচ, রসুন । কারন যেকোন মূল্যে ফর্সা হতে হবে কেন না ফর্সা না হলে বিয়ের বাজারে কাটতি হবে না ।
যাইহোক, মেয়েদের বয়সকালে দেখতে ছেলের চাইতে বুড়ি লাগবে উত্তরে এত ছেলেদের ভোট দেখে আরো একবার উপলব্ধি হল কি কারনে কিশোরী বিয়ের হার এখনো এত বেশি । অর্থাৎ ছেলেকে বয়স্ক দেখালে কোন সমস্যা নেই কিন্তু মেয়েকে বয়স্ক দেখালে সেটা ভারী একটা অন্যায়ের কাজ । কোনভাবেই ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বয়স্ক দেখানো যাবে না। এখনও এটা খুবই স্বাভাবিক যে, একজন কিশোরী মেয়ের জামাই তার চাইতে যত বড়ই হোক তা কোন সমস্যা না। ছেলেটিকে যদি মেয়েটির আংকেলও লাগে দেখতে তবুও তা সহনীয় কারণ সে ছেলে । কিন্তু মেয়েটিকে ছেলেটির খালাম্মা লাগলে খুব সমস্যা যে!!!!! (চলবে…)