হালো ইফেক্টঃ আমরা কেন সুন্দর জিনিসের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করি?

আপনার সাথে প্রথমবারের মত দু’জন মানুষের পরিচয় হলো। একজন দেখতে খুব সুন্দর এবং স্মার্ট। অন্যজন ততটা সুন্দর নয় এবং দেখতেও প্রথমজনের চেয়ে আনস্মার্ট। তো সেক্ষেত্রে আপনার কাছে এই দুইজনের ভেতর কাকে বেশি পছন্দ হবে? নিশ্চয়ই যাকে দেখতে আকর্ষণীয় লাগছে তাকে! আমরা হয়তো খেয়াল করি না, প্রতিদিন আমরা এরকম বহু সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি শুধুমাত্র ‘হলো ইফেক্ট’ নামের মানব মস্তিষ্কের একটি এলগরিদমের মাধ্যমে। কি অবাক হচ্ছেন?

কি এই ‘হলো ইফেক্ট ‘ যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এত ভূমিকা রেখে যাচ্ছে? ‘হলো ইফেক্ট’ মানব মস্তিষ্কের এমন একটি নির্বাচন প্রক্রিয়া,  যার মাধ্যমে আমরা কোন কিছু প্রথমবার দেখেই সেটার ব্যাপারে একটা প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। আমাদের মস্তিষ্ক সবসময় অনেকগুলো পথ কিংবা পদ্ধতি থেকে সবচেয়ে সহজ পথটি বেছে নেয়। যার কারণে আমরা যখন কোন জিনিস প্রথমবার দেখি আমাদের মস্তিষ্ক সবার আগে জিনিসটির গুণাগুন যাচাই করে না। সে তার সহজ পদ্ধতির মাধ্যমে অনেকগুলো জিনিস থেকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিসটি পছন্দ করে নেয় আপনার জন্য। আর আপনিও এতে প্রভাবিত হয়ে আকর্ষণীয় জিনিসটার দিকেই নজর দেন। আপনার অজান্তেই আপনার মনে জিনিসটি সম্পর্কে একটা পজিটিভ ধারণা তৈরি হয়ে যায়।আপনি ভাবতে থাকেন, জিনিসটি ভালো, এটা আপনাকে ভালো সার্ভিস দিবে। কিংবা পণ্যটি ক্রয় করে আপনি ঠকবেন না। এই ভাবনা থেকেই আপনি সেই পণ্যটি কিনে নেন। যদি না আপনার আগে থেকেই কোন সিদ্ধান্ত থেকে থাকে। অনেক সময় আপনার পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তের উপর জোর খাটাতে ওস্তাদ এই ‘হলো ইফেক্ট’।

মনে আছে,  শুরুতেই দু’জন মানুষের কথা বলেছিলাম? হ্যা ঠিক ধরেছেন। একজন স্মার্ট আর সুন্দর, অন্যজন আনস্মার্ট আর ততটা সুন্দর না। তো আপনি কাকে পছন্দ করলেন? নিশ্চয়ই যে সুন্দর আর স্মার্ট? হ্যা, প্রথম দেখায় মানুষকে পছন্দ করবেন কি করবেন না-সেটাও নিয়ন্ত্রিত হয় এই ‘হলো ইফেক্ট’ দ্বারা! এর কারণ কি? কারণ একটাই। মস্তিষ্কের ফাঁকিবাজি, না মানে বলছিলাম মস্তিষ্কের সহজ সমাধান থিওরির কথা। যেকোন পণ্যের মত মানুষকে প্রথমবার দেখেও আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন সে দেখতে কতটা আকর্ষণীয় তার ভিত্তিতে। ওই দুইজন মানুষের ভেতর যে দেখতে আকর্ষণীয়,  তার ব্যাপারে আপনার মনে হবে লোকটি কত সুন্দর দেখতে! তার হাসিটা কত সুন্দর! ওয়াও তার কথা বলার ধরণ দেখছি আরও দারুণ।

আর অন্যদিকে যে মানুষটি দেখতে একটু অসুন্দর তাকে দেখে ভাববেন, তার চেহারাটা কেমন জানি! নাকটা কেমন! হাসিটাও কেমন মরা মরা লাগছে! কথা তো দেখি ভালোই বলতে পারে।তো কি হয়েছে? আমার ভালো লাগেনি দেখতে। যত সময় গড়াবে মানুষটির প্রতি আপনার আকর্ষণ ততই কমবে। কারণ ওইযে প্রথম দেখায় ওকে ভালো লাগেনি!

জ্ঞানীরা বলে থাকেন, don’t judge a book by its cover! তাঁরা ভুল বলেননি।কেননা তারা মস্তিষ্কের এই দারুণ খেলাটির কথা জানতে পেরেছেন! তাই বলে দিয়েছেন,  শুধুমাত্র প্রথম দেখায় আকর্ষণীয় লাগলেই কোন জিনিসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না নিতে।আরও সময় নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে।

এখন একটা প্রশ্ন দেখা দেয়,  তবে কি এই ইফেক্টটা ভুল দিকে পরিচালিত করছে আমাদের? ব্যাপারটা সেরকম না। এই ইফেক্টটি নির্ভর করে আপনি কতটা অভিজ্ঞ তার উপর। একজন শিক্ষিত মানুষের চেয়ে একজন কম শিক্ষিত মানুষের উপর ‘হলো ইফেক্ট’ বেশি প্রভাব রাখে। মনস্তাত্ত্বিক বিভিন্ন গবেষণায় এই তথ্যটি উঠে এসেছে। আপনি কতটুকু চিন্তাশীল, সৃজনশীল কিংবা আপনার জীবনযাত্রার উপর ভিত্তি করে বলা যাবে আপনার উপর ‘হলো ইফেক্ট’ কতটুকু কাজ করবে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আকর্ষণীয় লাগা এবং না লাগার দুটো ফলাফল হতে পারে। আকর্ষণীয় ব্যাক্তিটি সবমিলিয়ে ভালোও হতে পারে, আবার খারাপও হতে পারে। তেমনি অনাকর্ষণীয় ব্যাক্তিটিও ভালো হতে পারে আবার না-ও হতে পারে।
সত্যিকার অর্থে ‘হলো ইফেক্টের’ পজিটিভ কিংবা নেগেটিভ দুটো দিকই আছে। বাস্তব জীবনের কতগুলো উদাহরণ থেকে  আপনি ব্যাপারগুলো ধরতে পারবেন।

১. প্রেমের পড়ার ক্ষেত্রেঃ  একজন মানুষ হিসেবে প্রেমে পড়া আমাদের জন্য স্বাভাবিক একটি প্রাকৃতিক  ঘটনা। প্রেমে পড়ার ক্ষেত্রে ‘হলো ইফেক্ট’ দারুণভাবে কাজ করে! একজন নারী একজন পুরুষের ভেতর প্রাথমিকভাবে যা খুঁজেন, একজন পুরুষও একজন নারীর ভেতর সেই জিনিসটাই খুঁজেন আগে।হ্যা, সেটা হলো মানুষটি দেখতে কতটা আকর্ষণীয়! এটাই প্রাথমিক সিদ্ধান্ত কিংবা ভাললাগার সিঁড়ি।
২.চাকরিঃ বর্তমান বিশ্বে চাকরির বাজার তো বলতে গেলে ফার্স্ট ইম্প্রেশন শব্দটা দিয়েই শুরু হয়! একজন চাকরিদাতা সবার প্রথমে আপনাকে দেখতে কেমন লাগছে সেটা দেখবে।এই প্রথম ভাললাগা ব্যাপারটা আপনার পুরো ইন্টারভিউ জুড়ে রয়ে যাবে।
৩.পণ্য ক্রয়ঃ একজন সুপরিচিত অভিনেতা কিংবা অভিনেত্রী কোন একটি পণ্যের বিজ্ঞাপন করলেন। এরপর থেকেই সেই পণ্যের বিক্রি বেড়ে যাবে। কারণটা কি জানেন? সেই ‘হলো ইফেক্ট’। আপনার প্রিয় একজন মানুষ যখন আপনাকে কোন পণ্যের ব্যাপারে পজিটিভ ধারণা দিবেন, আপনি সেই পণ্যটিই কিনবেন। পণ্যের বাজার এখন এভাবেই চলছে মশাই!

৪.ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তঃ  আমরা দৈনন্দিন জীবনে যে সিদ্ধান্তগুলো  নিই, তার বেশিরভাগ জুড়ে থাকে আমাদের ভালো লাগার বিষয়গুলো। এটা হতে পারে কোন ব্যক্তি, বস্তু কিংবা অন্যকিছু। প্রিয় মানুষদের সান্নিধ্যে সময় কাটানো, প্রিয় রেস্টুরেন্টে আড্ডা দেয়ার মত বিষয়গুলো আমাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে।