ভাবুন তো, খুব প্রাচীন গন্ধমাখা, পাতায় পাতায় ক্ষয়ে যাবার ভয় ও মলাটে বিষাদজনিত পঙক্তি আঁকা, ইতিহাসের ধূলিময় কোণে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া একটি বই, যার সাহিত্যরস আস্বাদনে আপনি মগ্ন। বইপ্রেমিক মাত্রই এমন অপূর্ব রহস্যের হাতছানি শরীরে দোলা দিয়ে যাবে। এই রহস্যের পাট উন্মোচন করতে যেয়ে দেখলেন, বাস্তব থেকে তা আপনাকে কল্পনার ভেতর ই টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বইয়ের মধ্যকার চরিত্রগুলো যেন পাঠকের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। এবং ধীরেধীরে আপনি বন্দী হয়ে গেলেন ঠিক বইয়ের ভেতর, রহস্যময়তার অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী হয়ে।
আর্কাইক ফ্যান্টাসি জনরার মেটাফিকশন ঘরানার তেমনি একটি কাহিনী অবলম্বনে রচিত। এর শুরুর গল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় যখন আমি কেবল কলেজের ছাত্রী। মেটাফিকশনের সাথে যারা পরিচিত তারা হয়ত জোস্টেন গার্ডার এর নাম শুনে থাকবেন। কলেজের লাইব্রেরীতে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম লেখকের বিশ্বনন্দিত বই “সোফির জগত”। পড়ে বিস্মিত হয়েছিলাম, এমন কিছুও বুঝি লিখা যায়! তারপর মেটাফিকশন জগতের আরো কিছু দিকপাল সম্পর্কে জানলাম, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এমনকি আইজ্যাক আজিমভ ও লিখেছেন মেটাফিকশন। ছোটবেলা থেকে অভ্যেস ছিল আমার, যা যখন মনে হত মোটা মোটা খাতা লিখে ভরে ফেলতাম, খাতার একটি পাতায় তখন ঠাই পেল মেটাফিকশন নিয়ে যত জল্পনাকল্পনা।
বাংলাদেশে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এ রচনা পাঠকপ্রিয়তা পাবে কিনা তা নিয়ে প্রথমে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। তবেঁ আগ্রহের কাছে দ্বিধা কাটা পড়ল। ত্রিপুরা জমিদারবাড়ির অন্তরালের গল্প, আনতারিসের জাদুর পৃথিবী ও বর্তমানের আধুনিকমনা প্রাণচঞ্চল কিশোরী এসকল চরিত্রের মিশেলে সমৃদ্ধ হয়েছে আমার কিশোর মেটাফিকশন গল্প “আর্কাইক”। এখানে বলে রাখা ভালো, বইটি দেশের কিশোর কিশোরী, মূলত যারা টিন এজার, তাঁদেরকে উদ্দেশ্য করে লিখা, কেননা, ছোটকাল থেকে বই পড়ার অভ্যেস গড়ে তোলার ব্যাবস্থা বাংলাদেশের খুব কম পরিবারেই দেখা যায়। তিন গোয়েন্দা বা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচীর কল্যাণে এক্ষেত্রে বেশ উন্নতি সাধিত হলেও তার ক্রমান্বয় লয়প্রাপ্তি অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় না। স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের জন্য ভিন্নধর্মী সাহিত্য নির্ভর কিছু লিখবার প্রয়াস থেকেই রুপ লাভ করেছে আর্কাইক। মূল বইটির কিছু টুকরো ভগ্নাংশ নিচে উল্লেখ করা হল।
- “আলী খুব শান্তভাবে ধ্যান গ্রস্থ বালকের মত হাটু গেড়ে বসে আছে। ওকে সম্মোহন করা হয়নি, তবেঁ ভাবগতি কেমন যেন মোহ আবেশে নিমগ্ন বলে মনে হচ্ছে।” মেয়েটি পড়ে চলল, সে খুব ভালো করেই জানে আলী নামের চরিত্রটির মাথায় এখন কী চলছে। প্রার্থনা করল সশব্দে, “আলী, না, যা করতে চলেছো তা উচিত নয়, একদমই নয়।” মাথায় হঠাৎ খেলে গেল, “আমার কথা নিশ্চয় বই এর চরিত্র শুনতে পাবে না” পরের লাইন পড়ল মেয়েটি, “মুচকি হাসছে আলী। ও জানে, রচয়িতা মোটেও নির্বোধ নয়। এই দূরত্ব প্রাবল্যে লুকিয়ে থাকা পরস্পর বোধগম্যতা অর্জন করা হয়েছে বলেই কিনা এত আয়োজন। আলী ভাবে, এত কারসাজি করার মূল উদ্দেশ্যই তোমাকে হাসিল করা। নিয়ত ধূর্ত ও চঞ্চল মগজের পেছনে কার চেহারা ছায়াসদৃশ আড়াল দিয়ে রেখেছে, এ রহস্য স্বচক্ষে অবলোকন যে আমায় করতেই হবে।”
- “কল্পনার চোখে ওরা শিলাদের বাড়িটিকে দেখে ফেলল যেন একদম। এখানে সবচাইতে সুন্দর হচ্ছে ভৈরব সিং এর সমাধিস্থল। মুনা আপনমনে বলে উঠল, “আচ্ছা মারা যাওয়ার পর এত সুন্দর করে সমাধি সাজানো হয় কার জন্যে?” ঠোট উলটে পারুল বলল, “শখ, আর কী!”
-“অনেকে সৌখিন মনোভাবের হয়ে থাকেন, মৃত্যুর পূর্বে পরিবারের মানুষদের কে নির্দেশ দিয়ে যান কিভাবে কি করে সাজিয়ে তাকে কবর দিতে হবে। কিন্তু যারা কিছু না বলে মারা যান, তাদের কবরফলক ও প্রায়শই সাজিয়ে দেয়া হয়। যা হয়ত মৃত ব্যক্তির ইচ্ছা, অভিরুচি অনুযায়ী হয়না।” শশী বেশ ঠাণ্ডা স্বরে কথাগুলো বলে থামল।
-“তাতে কী হয়েছে?” জিজ্ঞেস করল মুনা।
-” কিছু হয় নি। তবেঁ বিষয়টা কেমন যেন। অনেকটা আমাকে অনিচ্ছাকৃত ভাবে তোমার কাপড় পরিয়ে দেয়া হয়েছে।” ইতস্তত করে উত্তর দিল শশী।” - “রাতের অন্ধকার মিইয়ে গিয়ে ভোরের আলো সবে ফুটে উঠছে, নাযিরার সবচাইতে প্রিয় সময়, যদিও আজ তা বিশেষভাবে উপভোগ্য নয়। ভোরের বাতাসেও আজ সেই মৃদুমন্দ ঠাণ্ডা ভাবটা নেই, যেন প্রকৃতি টের পেয়েছে শিষ্টের পতন। আজিমভের একান্ত কামরায় বন্দী হয়ে আছে নাযিরা। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আনাতিয়ার সেনাদল নাৎজকা অভিমুখে রওনা দিয়েছে আন্তালিব ও আর্কাইকের বইকে হস্তগত করার জন্য। নাযিরার গণনা অনুযায়ী পূর্ণিমাতিথির দু দিন পর আনাতিয়া আক্রমণের জন্য ছিল উপযুক্ত সময়, হায়ালিনের মিশ্রণ তৈরীই ছিল। সে মিশ্রণকে আগুনে পুড়িয়ে সম্মোহনী ধোয়ার সৃষ্টি করেছিল নাৎজকা সৈন্যরা। কাজ হয়েছিল এতে, ধীরে ধীরে পরাজয় মেনে নিচ্ছিল আজিমভ বাহিনী। যুদ্ধের ময়দানের মাঝে এসে হুট করেই আবির্ভূত হল এক বৃদ্ধা নারী, বয়সের ভারে কুঁজো কিন্তু হাসিহাসি চেহারার সেই নারী তুড়ি বাজালো, মুহূর্তে আগুনগোলার বর্ষণে সব ধ্বংসপ্রাপ্ত হল। পায়ের আওয়াজে ধ্যান ভাঙ্গল নাযিরার, আজিমভ হিংসাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে”
কেবলমাত্র পাঠক প্রিয়তা লাভের আশায় নয়, বরং দীর্ঘদিনের সঞ্চিত ইচ্ছের প্রতিরুপ হিসেবে আর্কাইক এর কাহিনীপট এঁকেছি। ফ্যান্টাসি প্রিয় তরুণ কিশোরদের কাছে বইটি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে বলেই আমার বিশ্বাস। অমর একুশে বইমেলা ২০১৮ তে মাসব্যাপী দাঁড়িকমা প্রকাশনীর স্টলে থাকছে আমার তৃতীয় একক কিশোর উপন্যাস “আর্কাইক”। সকলের প্রতি তাই স্বচ্ছন্দ আমন্ত্রণ।