প্রথম বাংলা হরফ তৈরি করেন গঙ্গা পারের পঞ্চানন

বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার ঘটনা ভূভারতের অন্য কোথাও ঘটেনি। তাই বাংলা ভাষা বাঙালির গর্ব। মাতৃভাষা দিবস বাঙালির অহঙ্কার। ভাষা নিয়ে এই আবেগ ফুরনোর নয়। বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা, তাকে মা’য়ের মর্যাদা দেওয়া আসলে তাকে শুদ্ধ প্রাণে প্রণাম জানানো। বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন এবং তার জেরে একটা নতুন দেশের জন্ম। এইসব কিছু নিয়ে বাংলা বড় আদরের, বড় প্রাণের যা শ্রদ্ধায় নত করে আমাদের।

বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের অজ্ঞতারও শেষ নেই। তার মধ্যে অন্যতম হলেন পঞ্চানন কর্মকার। যার ছেনির ঘায়ে রূপ পেয়েছিল তোমার-আমার বাংলা ভাষা। প্রথম বাংলা হরফ নির্মানের কৃতিত্ব তাঁরই। যিনি ‘বাঙালি ক্যাক্সটন’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন তামাম বিদেশির কাছে।

বিশ শতকের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে কোনও যোগ নেই পঞ্চানন কর্মকারের। তিনি এই প্রতিবাদ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেননি। কারণ ১৮০৪ সালেই তিনি পরলোক গমন করেছেন। তাই বলে ভাষা নিয়ে বিপ্লবের পেছনে তার অবদান কিছু কম নেই। তাঁর ছেনি-হাতুড়ির ঘায়েই গড়ে উঠেছে বর্ণ, অক্ষর, যুক্তাক্ষর-সহ বাংলা হরফ। আর তিনি পদ্মাপারের নয়, গঙ্গা পারের বাসিন্দা ছিলেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর কথা। বাংলাদেশ গঠন তো দূরের কথা, লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ তখন দূর অস্ত। ১৭৫৯ সালে হুগলির ত্রিবেণীতে জন্ম গ্রহণ করেন পঞ্চানন কর্মকার। তাঁর পূর্বসূরীরা ছিলেন কামার বা লৌহজীবী। আগে তাঁদের বাসস্থান ছিল হুগলী জেলার জিরাটের বলাগড়ে। পরে তাঁরা ত্রিবেণীতে এসে বসবাস শুরু করেন। পঞ্চাননের জন্মও এখানে। পঞ্চাননের পূর্বপুরুষেরা প্রথমে ছিলেন লিপিকার। তামার পাতে, অস্ত্রশস্ত্রে অলঙ্করণ বা নামাঙ্কনের কাজে তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। বংশানুক্রমে তিনিও পূর্বপুরুষদের এই শিল্পবৃত্তির গুনাগুণ রপ্ত করেছিলেন।

ছবিঃ ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের লেখা ‘অ্যা গ্রামার অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ বইটির প্রচ্ছদ

১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে চার্লস উইলকিন্স হুগলিতে ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের লেখা ‘অ্যা গ্রামার অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ বইটি মুদ্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বলা হয়ে থাকে এটি প্রথম বাংলা হরফে মুদ্রিত বই। পঞ্চানন তাঁর পূর্বসূরীদের থেকে প্রাপ্ত প্রযুক্তিজ্ঞান নিয়ে বাংলা হরফ প্রস্তুতের কাজে উইলকিন্সকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। তৈরি হয় নিখুঁত কেতাদুরস্ত নতুন বাংলা হরফ। পঞ্চাননই বাংলা মুদ্রণাক্ষরের স্রষ্টা ও মুদ্রণশিল্পের প্রযুক্তিবিদ।

রোমান হরফ নির্মাণের তুলনায় বাংলা হরফ নির্মাণ ছিল কষ্টসাধ্য। যেমন স্বরচিহ্ন ও সংযোগ চিহ্ন-সহ প্রায় ছয় শত অক্ষর নির্মাণের কাজ এদেশে বিদেশি চার্লস উইলকিন্স ও স্বদেশি পঞ্চানন কর্মকার ছাড়া আর কেউ করেননি। পঞ্চানন কর্মকার শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট সম্প্রদায়ের জন্যে এক সাট বাংলা হরফ নির্মাণ করে দেন। তিনি প্রত্যেকটি অক্ষরের জন্যে তখনকার দিনে দাম নিয়েছিলেন ১/০ সিকা। অক্ষরগুলো সম্ভবত কাঠের খোদাই ছিল। এই রকম গাছের ছালে অক্ষর খোদাইয়ে পরীক্ষামূলক কাজ করা হয় ‘ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া’ ও ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকার জন্য। প্রথমদিকে, যখন ধাতুনির্মিত ছাঁচে অক্ষর ঢালাই হয়নি, তখন কাঠের নির্মিত অক্ষরই ব্যবহৃত হতো। তাছাড়া, তামিল-পর্তুগিজ অভিধানের জন্যে ইগনাশিয়াস আইচামনি কাঠের হরফ নির্মাণ করেছিলেন। অবশ্য অনেকের মতে, ওই অক্ষরগুলো ধাতুর তৈরি ছিল।

কেরি সাহেবের উদ্যোগে শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে যোগ দেন পঞ্চানন। একটি পুরোনো মেশিন নিয়ে শুরু হয় কাজ। কিন্তু পঞ্চাননের মেধা, অক্লান্ত পরিশ্রম ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অল্প দিনের মধ্যে এটি এশিয়ার বৃহত্তম অক্ষর তৈরির কারখানা বা টাইপ ফাউন্ড্রিতে পরিণত হয়। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর তৈরি হরফে বাংলায় বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টর কেরিকৃত অনুবাদ ছাপা হয়। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনিই প্রথম ভারতবর্ষে দেবনাগরী ভাষায় হরফ নির্মাণ করেন। কেরির সংস্কৃত ব্যাকরণ মুদ্রণের জন্য তিনি দেবনাগরী ভাষায় হরফ তৈরি করে দেন। পরে তিনি আরও ছোটো ও সুন্দর এবং স্পষ্ট বাংলা হরফের নকশা তৈরি করেন। বাংলা মুদ্রণশিল্পে পঞ্চানন কর্মকারের তৈরি হরফের নকশা দীর্ঘকাল প্রচলিত ছিল। বাংলা ভাষায় ছাপার ইতিহাসে প্রথম চলনসই বাংলা ও সংস্কৃত অক্ষরের ছাঁচ তৈরির অগ্রদূত হিসেবে পঞ্চানন কর্মকারের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

অক্ষর কাটার ক্ষেত্রে পঞ্চাননের কীর্তি হল : আগে শব্দের আগে, মধ্যে ও শেষে ব্যবহৃত স্বর ও ব্যঞ্জনের চিহ্নগুলো আলাদা করে কাটা হত। ফলে অক্ষরগুলোর মধ্যে থাকত অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। পঞ্চানন তাঁর নিপুণ কর্তন ক্রিয়ায় এ ব্যবধান কমিয়ে আনেন। তিনি বাংলা হরফের বিভিন্ন সংযোজক চিহ্ন ছাড়া এক ফাউন্ট উড়িয়া টাইপও নির্মাণ করেন। তিনি মারাঠি ভাষার হরফ নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি।

পঞ্চানন বৃদ্ধ বয়সে একবার কলকাতার ‘বটতলা’ পুস্তক প্রকাশের জন্যে ছবি কাটতে এসেছিলেন। বর্ণময় কর্মজীবনে প্রায় ১৪টি বিভিন্ন বর্ণমালার হরফ তৈরি করেছিলেন পঞ্চানন। ভবিষ্যতে যাতে এ ব্যবস্থায় ধ্বস না নামে তার জন্য বহু সংখ্যক কর্মীকে কর্তন ও ঢালাই শিল্প শিখিয়েছিলেন নিজে হাতে। এঁদের মধ্যে মনোহর কর্মকারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পঞ্চানন তাঁর এই শিষ্যকে শুধু করিতকর্মা হিসেবে গড়ে তোলেননি, তাঁর সঙ্গে মেয়ের বিয়েও দিয়েছিলেন। পঞ্চাননের মৃত্যুর পর মনোহর কর্মকার প্রায় চল্লিশ বছর শ্রীরামপুর মিশন হরফ ঢালাইখানার অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেছিলেন। মনোহরের ছেলে কৃষ্ণ কর্মকারও আমৃত্যু এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হরফ শিল্পে পঞ্চাননের শিষ্য বেণীমাধব দে ও কার্তিকচন্দ্র বসাকের নামও বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে।