বাড়ির দক্ষিন দিকের ছোট্ট ঐ ঘরটা ভীষন রকমের পছন্দ ফিহার। অদ্ভূত অদ্ভূত একগাদা পুরাতন আমালের কতগুলো জিনিস দিয়ে ঠাসা ছোট্ট একটা ঘর। দেখলেই কেমন যেনো মুগ্ধতায় জুড়িয়ে যায় ফিহার সমস্ত মনপ্রান। বড় মামার সংগ্রহ ওটা।
সেদিন মামার পুরাতন বইয়ের আলমারিটা ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে হঠাৎ করেই খুঁজে পেলো সেই কাঙ্খিত জিনিসটা।তন্ত্র মন্ত্র নিয়ে লিখা ছোট্ট একটা বই। জীর্ন শীর্ন জিনিসটা দেখে কেমন যেনো লোভে চকচক করে উঠলো ফিহার চোখ দু’টো।টুপ করে বইটা তুলে নিলো সে হাতের মুঠোয়।তারপর পা টিপেটিপে সে দ্রুত চলে এলো নিজের ঘরে। অদ্ভূত রকমের কতগুলো মন্ত্র, চিহ্ন আর একগাদা আচার অনুষ্ঠান দিয়ে ভরপুর সে বই। খুব খটমটে ভাবে আগোছালো অস্পষ্ট অক্ষরে লিখা থাকা সত্বেও মন্ত্রমুগ্ধের মতো বইটা পড়ে যেতে লাগলো ফিহা।এবং…. একসময় বিশেষ একটি জায়গায় এসে থমকে গেলো সে।চোখ আটকে গেলো লিখাটার ওপর। লিখাটা এমন –
“গুপ্তধন লাভের উপায়”
বিধি : রবিবার দিন ঘুঘু পাখি আর প্যাঁচার হৃদপিন্ড পেষন করে গুটিকা তৈরী করতে হবে। কালো তিতির পাখি ধরে এনে কিছু খেতে দেয়া যাবে না তিনদিন। পুকুর কিংবা নদীর ধারে গিয়ে ধরে আনতে হবে একজোড়া সঙ্গমরত ব্যাঙ।তারপর প্যাঁচার মাংস, চন্দন, কুমকুম, পায়রার বিষ্ঠা একসঙ্গে পিষ্ঠ করে কপালে তিলক পরিধান করতে হবে।অতঃপর মাঝরাতে পরিষ্কার কালো কাপড় পরে বসতে হবে পাকুড় গাছের নিচে।তিনদিন ধরে না খাওয়া তিতির পাখি আর ব্যাঙদুটোকে বলি দিতে হবে। তারপর খেয়ে ফেলতে হবে তাদের কাঁচা মাংস এবং পান করতে হবে তাজা রক্ত।এরপর হৃদপিন্ড পেষন করা গুটিকা সেবন করতে করতে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে তাদের দেহাবশেষ।এবং সবশেষে পাঁকুড় গাছের মূল তুলে নিয়ে বেঁধে ফেলতে হবে ডানহাতে।ব্যাস…. তিনদিনের মাঝেই পেয়ে যাবেন ফলাফল।
বিদ্র : এই কাজ অতি সাবধানে করতে হবে এবং গুরুর আদেশ ছাড়া এ কাজ করতে যাওয়া উচিত নয় একদমই। অনিয়ম ঘটলে হতে পারে ভয়ঙ্কর অনিষ্ঠ কিংবা মৃত্যু।
ফিহা খানিকটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলো লিখাটার দিকে। এটা কি সত্যিই কাজ করে? ঠিকঠাক মতো সব করতে পারলে কি সত্যিই গুপ্তধন পাওয়া যায়?
চেষ্টা করে দেখা যায় একবার! – আপনমনে কথা বলে উঠলো ফিহা। কেমন যেনো অসুস্থ একটা কৌতুহল নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো তার মনের ভেতর। উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠলো তার হৃদপিন্ডটা।
দৌড়ে চলে এলো সে ঘরের বাইরে। মর্জিনা খালাকে একগাদা টাকা গছিয়ে দিয়ে যোগাড় করে ফেললো বিদঘুটে দর্শন একটা প্যাঁচা, তিতির পাখির বাচ্চা আর খুব সুন্দর দেখতে একটা ঘুঘু পাখি। ছাদ থেকে নিয়ে এলো পায়রার বিষ্ঠা। আর টানা তিনদিন নানান পুকুর পাড় ঘুরে ফিরে অবশেষে যোগাড় করে ফেললো সঙ্গমরত একজোড়া ব্যাঙ।
ব্যাস কাজ শেষ! এবার শুধু অপেক্ষার পালা। মাঝরাত হলেই দৌড়ে চলে যাবে সে উঠোনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল পাকুড় গাছটার নিচে। তারপর…………!
আর ভাবতে পারলো না ফিহা।টের পেলো উত্তেজনায় সরসর করে দাঁড়িয়ে গেছে তার গায়ের সবক’টা লোম। থরথর করে কাঁপছে রীতিমতো তার হাত পা ।
সেদিন ভীষনরকমের খুশী ছিলো ফিহা। বাড়িসুদ্ধু মানুষগুলোকে রান্না করে খাইয়েছিলো নিজহাতে। কায়দা করে খাবারের মাঝে মিশিয়ে দিয়েছিলো একগাদা ঘুমের ওষুদ।সে ওষুদের প্রভাবে ঘরভর্তি মানুষগুলো যখন নাক ডেকে ঘুমুচ্ছিলো, ঠিক তখনি চুপিচুপি ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো ফিহা।
উঠোনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল পাঁকুড় গাছটাকে দেখে কেমন যেনো একটা সূক্ষ্ম ভয় খেলে গেলো ফিহার মনের মাঝে। মনে হচ্ছিলো বিশাল একটা প্রাচীন দানব দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। ওটার রক্তিম উজ্জ্বল পাতাগুলো দেখে মনে হচ্ছিলো লকলকে লাল জিহ্বা। আর কমলা রঙা ফলগুলো দেখে মনে হচ্ছিলো দানবের চোখ।
ধীরে ধীরে গিয়ে বসলো সে পাঁকুড় গাছটার নিচে। হাতে ধরা ধাঁরালো ছুড়িটা দিয়ে ধীরে ধীরে কেটে ফেললো তিতির পাখি আর ব্যাঙদুটোকে।ঝর্নার মতো একগাদা রক্ত বের হয়ে এলো দ্রুতগতিতে। ভাসিয়ে দিলো ফিহার সমস্ত শরীর। নষ্ট করে দিলো ওর কাপড় চোপড়। উত্তেজিত ফিহা পরম যত্নে রক্তগুলো জমা করে নিলো ছোট্ট একটি পাত্রে।
তারপর ভয়ে ভয়ে কামড় বসালো কাঁচা মাংসে।এবং সাথে সাথেই থ্যাপ করে বিচ্ছিরি ধরনের একটা বোঁটকা গন্ধ এসে ধাক্কা মারলো তার নাকের ভেতর। ঘেন্নায় বমি হবার উপক্রম হলো প্রায়। অনেক কষ্টে সামলে নিলো সে নিজেকে। তারপর কচকচ করে চিবিয়ে খেয়ে ফেললো একগাদা কাঁচা মাংস। নাক টিপে ধরে চোখ বন্ধ করে ঢকঢক করে গিলে খেয়ে ফেললো পাত্রের সবটুকু তাজা রক্ত। দ্রুগতিতে মাটিতে পুঁতে ফেললো বাকি দেহাবশেষ।টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেললো পাঁকুড় গাছের মূল। তারপর ধীরে ধীরে তা বেঁধে নিলো ডানহাতে!!
” এবার তাহলে অপেক্ষার পালা। ” -উত্তেজনায় প্রায় চিৎকার করে উঠলো ফিহা।….. এবং ঠিক তখনি মনে পড়ে গেলো কথাটা। টের পেলো বিশাল বড় একটা ভুল করে বসেছে সে। হৃদপিন্ড পেষণ করা গুটির পাত্রটা পড়ে আছে মাটিতে! ওটা খেতে ভুলে গেছে সে!
এবার কি হবে তাহলে?? নিয়ম ঠিকমতো না মানলে তো মহাবিপদ ঘটে যাবে!! তাহলে কি মারা যাবে এখন ফিহা??? নাকি……
ঠিক তখনি প্রবল গতিতে নড়েচড়ে উঠলো চারপাশের সবকিছু। তীব্র একটা গরম বাতাস এসে ধাক্কা মারলো ফিহার চোখেমুখে। ভয়ঙ্কর একটা মাংসপঁচা গন্ধে প্রায় বমি করে দেবার উপক্রম হলো ফিহার। আতঙ্কিত ফিহা দেখলো গাছের আড়াল থেকে ছায়ার মতো বিশাল কি যেনো একটা বের হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। কালিগোলা অন্ধকারের মাঝে ধকধক করে জ্বলছে ওটার চোখদুটো। সে চোখে নিষ্ঠুরতার ছাপ স্পষ্ট।
চোখের নিমিষেই ছায়ামতো জিনিসটা ঝাঁপিয়ে পড়লো ফিহার ওপর। আঁচড়ে কামড়ে ছিঁড়ে ফেললো ওর গায়ের নরম চামড়া। টান দিয়ে তুলে ফেললো ওর গালের একদলা মাংস। নখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে তুলে ফেললো ওর ডান চোখটা।
অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠলো ফিহা।। অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে নিজের নিষ্ঠুর মৃত্যু দেখার মতো ভয়ঙ্কর কিছু বোধহয় আর নেই। এত ভয়ঙ্কর কান্ডের মাঝেও তার মৃত্যু হচ্ছে না কেনো – সেটা ভেবেই কেমন যেনো অবাক হয়ে গেলো সে!!
চরম আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে দেখলো পিশাচটা তার ধারালো নখগুলো বসিয়ে দিয়েছে ফিহার বুকের বামপাশে। নরম মাংস ভেদ করে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসছে ওর স্ট্রবেরী রঙা হৃদপিন্ডটা।…..
আর সহ্য করতে পারলো না ফিহা। প্রবল আতঙ্কে বন্ধ করে ফেললো তার বামচোখটা।
ছবিঃ ১ঃ http://www.playbuzz.com/madelinejulialee10/which-pirates-of-the-caribbean-character-are-you
২ঃ https://omsi.edu/program/hunters-of-the-sky