করোনা ভাইরাস নিয়ে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখবেন কিভাবে?

Image Source: Internet

সারা বিশ্ব এখন করোনা আতঙ্কে আতঙ্কিত । গৃহবন্দী আছে হাজার হাজার মানুষ । প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। এরকম প্রাকৃতিক বা মানব সৃষ্ট দূর্যোগকালীন সময়ে মানুষের শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যও প্রবল হুমকির মুখে পড়ে। যেমন, ভয়, উদ্বিগ্নতা, বিষন্নতা, হতাশা, নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা ইত্যাদি বেড়ে যায়। তো এসময় শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়াটাও খুব জরুরী। কারণ  মানসিক সমস্যার কারনে শারীরিক অসুস্থতা বৃদ্ধি পায়।

আবার এমনও হতে পারে যে, আগে হয়ত ব্যক্তির কোন মানসিক অসুবিধা ছিল না কিন্তু এই দূর্যোগের কারণে তার মধ্যে মানসিক অসুবিধা দেখা দিল। এখন করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রনের লক্ষ্যে যেহেতু সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে, সুতরাং মানুষের মধ্যে আতঙ্ক এবং উদ্বিগ্নতা জেঁকে বসেছে।

তো এই মানসিক অসুবিধাগুলো থেকে কিভাবে বের হয়ে আসতে পারেন বা কিভাবে এই মানসিক অসুবিধাগুলোকে মোকাবিলা করতে পারেন সে বিষয়ে আলোচনা করব।

আজকে আলোচনা করব উদ্বিগ্নতা নিয়ে। তাহলে প্রথমেই জেনে নেয়া যাক উদ্বিগ্নতা আসলে কি ।

“উদ্বিগ্নতা হল ভবিষ্যতে হবে কিন্তু এখনো হয়নি এমন কোন বিষয় নিয়ে আশঙ্কা বা ভয়। এই ভয় বা আশঙ্কা তৈরী হয় বর্তমান পরিস্থিতিতে পর্যাপ্ত পরিমান প্রস্তুতি বা পরিকল্পনার ঘাটতি থাকলে বা ব্যক্তির সাথে জড়িত কিন্তু ব্যক্তির নিয়ন্ত্রনে নেই এমন কোনকিছু যা ব্যক্তির ভবিষ্যতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন কোনকিছু নিয়ে অনিশ্চয়তা”।

blank
Image Source: Internet

বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে অনেকের মধ্যেই এমন উদ্বিগ্নতা কাজ করছে যা ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত করছে। যেমন, এখন অনেকের মধ্যেই এই চিন্তা আসছে যে-

  • কি হবে যদি আমার করোনা হয়?
  • আমার পরিবারের বা আমার কি হবে যদি মারা যাই?
  • কি হবে যদি আমার লাশটাও পরিবার বা স্বজনেরা জানাজা দিতে না পারে?
  • কি হবে যদি আর কোনদিন বন্ধুদের সাথে দেখা না হয়?
  • যদি এই গৃহবন্দী অবস্থা আর শেষ না হয়?
  • যদি এরপরে খাবার না পাওয়া যায়? কাজ না থাকার ফলে ঘর ভাড়া না দিতে পারি?
  • চাকরিটা যদি আর না থাকে?
  • আবার সোনালি দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারব তো? ইত্যাদি ইত্যাদি।

যদি আপনার মধ্যে আসলেই এই চিন্তাগুলো এসে থাকে এবং আপনাকে বিচলিত করে তবে বলব যে, থামুন। একটু লক্ষ্য করুন, আপনি যেসব চিন্তা করছেন সেগুলো কি এখনো হয়েছে? মানে আপনি কি করোনায় আক্রান্ত হয়েই গেছেন? মারা গেছেন? খাবার দাবার এর কি ক্ষরা লেগেছে? চাকরিটা কি চলেই গেছে এখনই? সোনালি দিন কি এখনই হারিয়ে গেছে?

যদি আপনার উত্তর না হয় তাহলে একটু ভেবে দেখেন তো আপনার চিন্তা ভাবনাগুলো বর্তমান কেন্দ্রিক আছে কিনা? যদি এটার উত্তরও ‘না’ হয় তাহলে এখনই সময় আপনার চিন্তাগুলোকে বর্তমানে নিয়ে আসার। সাধারণভাবে, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা আসাটা খুব স্বাভাবিক। কারন স্বাভাবিক মাত্রার উদ্বেগ না থাকলে আমরা কাজ করার আগ্রহ পেতাম না এবং সামনে আগাতে পারতাম না। কিন্তু এই উদ্বেগ যদি আপনার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে তবে বুঝতে হবে এখনই সময় সেই উদ্বেগ নিয়ন্ত্রন করার।

তো এটা লক্ষ্য করুন যে এই গৃহবন্দী অবস্থায় উপরের চিন্তাগুলো বা উদ্বেগগুলো আপনার স্বাভাবিক চিন্তাভাবনাগুলোকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে কিনা? ওসব চিন্তা বার বার ঘুরে ফিরে আসছে কিনা? ওসব চিন্তার জন্য অন্য কাজে মনোনিবেশ করতে আপনার বেগ পেতে হচ্ছে কিনা?

blank
Image Source: Internet

যদি আপনার উত্তর হ্যাঁ তবে এখনই সময় আপনার উদ্বেগকে নিয়ন্ত্রন করার।

তাহলে আসুন এখন জেনে নেয়া যাক কিভাবে উদ্বেগকে নিয়ন্ত্রন করবেনঃ

১। পুনরায় পুনরায় ফিরে আসা চিন্তাগুলোর তালিকা তৈরী করুনঃ

একটি রঙিন বা সাদা কালো নোটবুক যেটা আপনার পছন্দ সেরকম একটা নোটবুক বা ডায়রি নিয়ে বসুন। এরপর বার বার যেসব চিন্তা মাথায় আসছে সেগুলোকে লিখে ফেলুন আধিক্যের মাত্রা অনুযায়ী। অর্থাৎ যে চিন্তা খুব বেশী আপনাকে পীড়া দিচ্ছে সেসব তালিকার প্রথমেই রাখুন। এই তালিকার পাশে আরেকটি তালিকা তৈরী করুন “সম্ভাব্য করণীয়” নামে।

এবার উদ্বেগের তালিকা করা সম্পন্ন হলে তালিকাটির দিকে লক্ষ্য করুন। এটা ভেবে দেখুন যেসব চিন্তা আপনার মধ্যে আসছে সেগুলোর নিয়ন্ত্রন আপনার হাতে আছে কিনা। যেমন, আপনার বা আপনার পরিবারের কারো যদি করোনা হয়? এখানে আপনার আর আপনার পরিবারের করোনা হওয়া বা না হওয়া এটা কি আপনার নিয়ন্ত্রনে আছে? বা আপনি চাইলেই করোনা হবে বা না চাইলে করোনা হবে  না বিষয়টা কি এমন? যদি এটার উত্তর না হয় তার মানে করোনার উপরে আপনার কোন নিয়ন্ত্রন নেই।

তাহলে আপনার নিয়ন্ত্রণ আছে কিসের উপর? আপনার নিয়ন্ত্রণ আছে যাতে করোনা না হয় সে বিষয়ে পর্যাপ্ত সতর্কতা এবং পদক্ষেপ গ্রহন করার উপর। আপনি চাইলেই করোনা হবে কি হবে না তা নিয়ন্ত্রন করতে পারেন না কিন্তু করোনা যেন না হয় সে বিষয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে পারেন। ঠিক একইভাবে চাকরি বা খাবার এর বিষয়টি চলে আসে। চাকুরি যদি চলে যায় সেখানে আপনার নিয়ন্ত্রন করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু চাকুরি চলে গেলে যেন আরেকটি চাকুরি পেতে পারেন সেজন্য নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারেন।

অর্থাৎ, যেসব বিষয়ের উপর আমাদের নিয়ন্ত্রন নেই সেসব বিষয়ে বারংবার দুশ্চিন্তা করে সময় অপচয় না করে সেসব দুশ্চিন্তার বিষয়গুলো যেন আপনার জীবনে কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে না পারে সেজন্য নিজের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নিন।

তাই, উদ্বেগের তালিকার পাশে আপনার করনীয়গুলো লিখে সে অনুযায়ী কাজ শুরু করুন। যখন আপনি নিজে পর্যাপ্ত পরিমানে প্রস্তুতি নিবেন তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই উদ্বেগ কমে যাবে।

২। ধ্যানচর্চা বা ধর্মীয় কাজে মনোনিবেশ করুনঃ

ধ্যান বা মেডিটেশন উদ্বেগ কমানোর জন্য খুব কার্যকরী একটি পদ্ধতি। যখন খুব বেশী উদ্বেগবোধ করবেন তখন ধ্যানচর্চায় বসে যেতে পারেন। এজন্য ইউটিউবে বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনামূলক ধ্যানের ভিডিও আছে। সেগুলোর মধ্যে থেকে যেটি আপনার ভাল লাগে সেখান থেকে যেকোনটি বা একাধিক ভিডিও বেছে নিয়ে ৩ বেলা কিছু সময়ের জন্য ধ্যান করতে পারেন।

আর ধ্যানের পাশাপাশি ধর্মীয় কাজগুলো করতে পারেন । আপনি যে ধর্মেরই হোন না কেন সে ধর্মের কাজ যেমন নামাজ, পূজা, প্রার্থনা ইত্যাদি করতে পারেন। কারন কিছু কিছু গবেষনায় দেখা গেছে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান মানুষের ব্যাথা বা কস্টের সাথে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে তার ভেতরের ইতিবাচক চিন্তাকে বাড়িয়ে তুলে তার মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করে।

৩। নেতিবাচকতাকে পরিহার করুনঃ

লক্ষ্য করুন, আপনার মধ্যে উদ্বেগ হচ্ছে কারন আপনি সব নেতিবাচক চিন্তা করছেন। নেতিবাচক চিন্তা থেকে আপনার মধ্যে আশঙ্কা এবং ভয় তৈরী হচ্ছে। সুতরাং, যখনই নেতিবাচক চিন্তা আসবে তখনই ঠিক তখনই জোরে জোরে নিজেকে বলুন, থামো। থামো। থামো। এখন আমি আর এই চিন্তা করব না। ঠিক সেই মুহূর্তে আপনার মধ্যে কি কি চিন্তা এসেছে তা একটা কাগজে লিখে ফেলুন। এরপর কাগজটি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলুন।

এরপর আপনার ভাল লাগে এমন কোন কাজ করুন। হতে পারে সেটা রান্না, ছবি আঁকা, বই পড়া, হাতের সেলাই, সিনেমা দেখা ইত্যাদি। কিছু ইতিবাচক মানুষের তালিকা তৈরি করুন যারা আপনাকে সবসময় অনুপ্রেরনা দেয়, সাহস যোগায়। তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করুন।

৪। পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন এবং ব্যায়াম করুনঃ

শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের উপরেই খাবারের প্রভাব অনেক বেশী। সুতরাং, পুষ্টিকর খাবার গ্রহন করুন। পানি পান করুন বেশী বেশী এবং ব্যায়াম করুন।

মনে রাখুন, আপনি উদ্বিগ্ন হলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। সমস্যার সমাধান তখনই হবে যখন আপনি উদ্যোগী হয়ে সমস্যা থেকে বের হবার জন্য পদক্ষেপ নিবেন। সুতরাং, “কি হবে” এবং “যদি হয়” এই দুই চিন্তা থেকে বের হয়ে এসে “কি করতে পারি” এবং “আসলেই আমি কি করছি” এই দুই চিন্তাতে মনোনিবেশ করুন। দেখবেন ধীরে ধীরে উদ্বেগ থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন।