আপনি হয়তো ইতিহাসের কোনো বই পড়ে কিংবা ছোটবেলায় গল্পের আসরে ভয়ঙ্কর সব কাল্পনিক দানবের কথা শুনেছেন। তাদের অনেকেই ছিল ভয়ঙ্কর চেহারার, আবার অনেকগুলো দৈত্য, দানো ছিল মানুষের উপকারী। বাস্তবে এদের অস্তিত্বের কোন প্রমাণ না পাওয়া গেলেও, রাতের আলো-আঁধারের গল্পের আসরে এসব ভয়ঙ্কর জীবদের গল্প আমাদের শিহরিত করেছে, মনে ভয় ঢুকিয়েছে। তাদের ভয়ঙ্কর চেহারা আর কাজ-কর্মের গল্প সত্যিই ভয় জাগানোর মতো ছিল। আজকে আমরা এমন কিছু ভয়ঙ্কর জীব সম্পর্কে জানব, যেগুলোর বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে কখনো জানা যায়নি। কিন্তু শত-শত বছর ধরে আমাদের কল্পনা আর গল্পে বিশেষ স্থান দখল করে আছে কাল্পনিক এই প্রাণীগুলো।
ওয়েন্ডি
১৬৬১ সালে একদল মিশনারিজ আমেরিকার এলগনকুইন্স জনপদের কাছাকাছি এক জায়গায় তাবু তৈরি করে। তারা সেখানে তাবু তৈরি করার পর তাদের খাদ্য শেষ হয়ে যেতে থাকে। তাই মিশনারিজ দলটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। একসময় তারা স্থানীয় জনপদের মানুষের উপর আক্রমণ করে বসে, এবং তাদের মাংস খেতে শুরু করে!
এখানকার বসবাসকারী জনপদের মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে, ওয়েন্ডিগো নামক মানুষখেকো এক ভয়ঙ্কর প্রাণির আত্না তাদের শরীরে ভর করেছে। ওয়েন্ডিগো নামক প্রাণিটি দেখতে কবর থেকে উঠে আসা মৃত মানুষের মতো! তাদের শরীর এতই পাতলা যে, তাদের বুকের পাঁজরের হাড় দেখা যায়। আর তাদের চোখগুলো কোটরের একেবারে ভেতরে ঢুকে থাকত। ধারণা করা হয়, ওয়েন্ডিগো নামক ভয়ানক প্রাণিগুলো না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছিল। তাই তাদের অতৃপ্ত আত্না কোনো ক্ষুধার্ত প্রাণির শরীরে প্রবেশ করে এবং প্রাণিটি ওয়েন্ডিগোতে পরিণত হয়। এরা সামনে যা পায় তারই মাংস খায় এবং আকারে বড় হতে থাকে। স্থানীয়দের এ বিশ্বাস ইতিহাসে জায়গা করে নিলেও, এই প্রাণিটি সম্পর্কে তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
মিনোটার
এথেন্সের ১৪ জন কিশোরকে বলি দেওয়ার মাধ্যমে মিনোটার নামক ভয়ানক দানবের প্রচলন হয়। গ্রিক মিথলজি অনুযায়ী, ক্রিটের রানী ষাঁড়ের সঙ্গে শারিরীক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার কারণে জন্ম হয় মিনোটারের। সে দেখতে মানুষের মতো হলেও ষাঁড়ের অবয়ব আর শক্তি ছিল তার শরীরে। ক্রিটের রাজা রানীর এমন কাজে রেগে যান এবং মিনোটারকে গভীর এক গুহায় বন্দী করেন। প্রতি বছর রাজা নিজের সন্তানের স্মরণে এক মেলার আয়োজন করতেন। সেখানে শিশুদের বলি দেওয়া হতো, মিনোটার যে গুহায় থাকত সেখানে। শিশুগুলো লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করলেও মিনোটারের নির্যাতনের স্বীকার হতো তার হাতে ধরা পড়ার পর। তবে এরকম অমানবিক রীতির অস্তিত্ব কোনোদিনই ছিল না বলে দাবি করেন অনেক ঐতিহাসিক। আবার অনেকে মনে করেন, একসময় ক্রিটের রাজা শেষপর্যন্ত মিনোটারকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন।
বাসিলিস্ক
১৫৮৭ সালে ওয়ারস নামক জায়গা থেকে একটা ছোট বাচ্চা হারিয়ে যায়। তার মা তাদের কাজের পরিচারিকাকে নিয়ে শহরজুড়ে খুঁজতে থাকেন। তারা ঘুরতে-ঘুরতে একসময় পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে প্রবেশ করেন। পরিচারিকা মেয়েটি হঠাৎ কিছু একটা দেখে নড়াচড়া বন্ধ করে দেয়। তারা এই ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার পর শহরে ফিরে যান এবং সবাইকে বলতে থাকেন তার মেয়েকে বাসিলিস্ক নামক হাসের মতো দেখতে একটি প্রাণি নিয়ে গেছে!
রোমান মিথলজিতে এই প্রাণিটির উল্লেখ পাওয়া যায়। যে প্রাণিটির চোখের দিকে তাকালেও মানুষ জমে যেত। এর শরীরে প্রচুর বিষ থাকার কারণে তীর ছুঁড়লেও কেবল রক্তের বদলে বিষ বের হত। যার কারণে পুরো গ্রামের মানুষ মারা যেতে শুরু করল! ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই ভয়ানক প্রাণিটি বর্তমান লিবিয়ার একটি অঞ্চলে বসবাস করত। তাই ধারণা করা হয়, বাসিলিস্ক বিলুপ্ত হয়ে গেলেও ভয়ানক প্রাণীটির উপস্থিতির কারণে বর্তমানে সে অঞ্চলে বিষাক্ত সাপের আধিক্য দেখা যায়।
নিয়ান
চীনের উপকথায় নিয়ান নামক ভয়ানক এক প্রাণির কথা জানা যায়। এই প্রাণিটি পাহাড়ে বসবাস করত। প্রাণীটির শরীর ছিল ষাঁড়ের মতো এবং মাথা ছিল সিংহর মতো দেখতে। শীতের শেষে যখন খাবার ফুরিয়ে যেত, তখন খাবারের প্রয়োজনে নিচে নেমে লোকালয়ে হামলা করত সে। তাই সেখানকার মানুষ সবসময় ভয়ে থাকত, কখন প্রাণিটি নিচে নেমে আসে। তাদের ঘরগুলোতো সবসময় লুকোনোর জায়গা থাকত, যাতে ‘নিয়ান’ এলে লুকিয়ে যেতে পারে সবাই। লুকিয়ে পড়ার আগে ঘরের সামনে বিভিন্ন খাবার সাজিয়ে রাখতো, যাতে নিয়ান সেগুলো খেয়ে পাহাড়ে ফিরে যায়। একদিন এক স্থানীয় বাসিন্দা দাবি করেন, নিয়ান নামক প্রাণিটি কোলাহল এবং লাল, নীল রঙ দেখলে ঘাবড়ে যায়। তাই চীনারা এক ধরণের উৎসবের আয়োজন শুরু করে। যেখানে তারা বিভিন্ন প্রাণীর বর্ণিল মুখোশ বানিয়ে শহরময় ঘুরে বেড়াত। সেটার ফলাফল কি হয়েছিল তা জানা না গেলেও, তখন থেকে আজ পর্যন্ত চীনে প্রাণিদের নকশা তৈরি করে উৎসবে নিয়ে যাওয়া হয়।
মূলত তখন থেকেই চায়না নববর্ষ গণনা করা শুরু হয়। এই উৎসবকে বসন্ত উৎসবও বলা হয়। চীন ছাড়াও জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনামসহ কয়েকটি দেশে উৎসবটি পালন করা হয়।
হাইড্রা
গ্রিক মিথলজির আরেকটি ভয়ানক প্রাণি হলো হাইড্রা। এই প্রাণিটির অনেকগুলো মাথা থাকত। একটি মাথা কেটে ফেললে সেখান দিয়ে আরও অনেকগুলো মাথা গজিয়ে উঠত। তাই এই ভয়ানক প্রাণিটিকে কখনোই মেরে ফেলা যেত না। হাইড্রার নিঃশ্বাস এতটাই বিষাক্ত ছিল যে, এর আশপাশে ঘেঁষলেও মানুষ মারা যেত। হাইড্রার কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ হয়ে হারকিউলিসকে এই প্রাণিটিকে মারার দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রচণ্ড শক্তিধর হারকিউলিস শেষ পর্যন্ত প্রাণিটিকে মেরে ফেলতে সমর্থ হন। তারপরও হাইড্রা নড়াচড়া করছিল দেখে হারকিউলিস এটিকে পাথরচাপা দিয়ে দেন। কিন্তু মানুষ এখনও বিশ্বাস করে, যেকোনো সময় ভয়ঙ্কর হাইড্রা বেরিয়ে আসতে পারে!
এই আধুনিক যুগে এসেও উপকথাগুলো আমাদের প্রাচীন সাহিত্য উপাদানের পরিচয় বহন করছে। এগুলো সংরক্ষণ করার মাধ্যমে জীবন্ত রাখাই পারে আমাদের শৈশবকে পরের প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করতে।
Featured Image: wallpaperplay.com