Mariya Oktyabrskaya- ট্যাংক নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে স্বামীর হত্যাকারীদের মুখোমুখি যিনি!

কথিত আছে যে, “প্রেমে ব্যর্থ নারীর চেয়ে ত্রুদ্ধ আর কেউ হতে পারেনা” কিন্তু আপনি যদি তার ভালোবাসা তার থেকে ছিনিয়ে নেন, এতে করে কিন্তু অবস্থা আরো সঙ্গিন হয়ে উঠবে – এমন কিছুই যা জার্মানদের জন্য মারত্মক হুমকি ডেকে এনেছিলো।

মারিয়া ভাসিয়েভনা জন্মেছিলেন ১৬ আগস্ট, ১৯০৫ সালে, ক্রিমিয়াতে দশ সন্তানের একজন হয়ে। অপরিচ্ছন্ন কৃষক পরিবারের সদস্য হওয়ার দরুন তিনি ছিলেন একজন সার্ফ (ক্রীতদাসরূপ দায়বদ্ধ কৃষক – অনুবাদক) – যা দাসত্বের আলঙ্কারিক এক শব্দ। এই যেমন, তারা তাদের জমিদারের অনুমতি ব্যতীত না কোথাও যেতে পারতো না কিছু করতে পারতো।

অতএব, এ তেমন আশ্চর্যের কিছু ছিল না যে তিনি সাম্যবাদ গ্রহণ করে নিয়েছিলেন যেমন করে একটি মাছ বেছে নেয় পানিকে। যদিও আমাদের বাকিদের কাছে তা ভয়াবহ শোনাতো, এটা তাকে মুক্ত করেছিলো চুক্তিভিত্তিক দায়বদ্ধ কৃতদাসের জীবনযাপন থেকে এবং তাকে সুযোগ করে দেয় একটি ভালো শিক্ষার, ক্যানারিতে একটি চাকরি এবং আরো পরে একজন টেলিফোন অপারেটর হিসেবে।

১৯২৫ সালের সেসময়ে, তিনি তার জীবনের ভালোবাসা – ইলিয়া অক্টইব্রসকায়ার দেখা পান। রাশিয়ান সাম্রাজ্য এর তিনবছর পূর্বেই বিলুপ্ত হয়ে সোভিয়েত রাশিয়া হয়, এবং ইলিয়া ছিলেন একজন সোভিয়েত আর্মি অফিসার। যিনি  তাকে আকর্ষণীয় ঘুরতে নিয়ে যেতেন যার কারণে মারিয়া মিলিটারির প্রতি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

তিনি “মিলিটারি ওয়াইভস কাউন্সিল” – এ যোগদান করেন, প্রশিক্ষিত হন একজন আর্মি নার্স হিসেবে, শিখেন কিভাবে গাড়ি চালাতে হয় (সেসময় নারীদের জন্য যা ছিলো অস্বাভাবিক), এবং শিখেন কিভাবে বিভিন্ন হাতিয়ার চালাতে হয়। তিনি একবার তার বোনকে পাঠানো চিঠিতে বলেন, “একজন সৈনিককে বিয়ে করো এবং সেনাবাহিনীর সেবা করো”।

সোভিয়েত ইউনিয়নে জার্মান যোদ্ধারা, জুন ১৯৪১ । ছবিটি তুলেছেন- বান্ডারসার্কিভ – CC BY-SA 3.0 de

তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার পরেও, দম্পত্তিটির কোন সন্তান হলো না, কিন্তু অন্তত তারা ছিলো পরস্পরের জন্য অন্তঃপ্রাণ। এবং তারা নিজেদেরকে একটি আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে মানিয়ে নিয়েছিলো যে, তারা দেশের জনগণের জন্য একটি নতুন এবং আরো উন্নতর দেশ গঠনে সাহায্য করছিলো।

২২শে জুন, ১৯৪১ এর আগ পর্যন্ত সবকিছু প্রায় ঠিকঠাকই ছিলো। জার্মান সীমানা বাড়াতে এবং সাম্যবাদ (কমিউনিজম) ধ্বংস করতে হিটলার রাশিয়াকে আক্রমণ করতে আদেশ দেয় – যা পরিচিত অপারেশন বারবারোসা নামে। এতে জড়িত ছিলো ৩.৮ মিলিয়ন জার্মান সেনাসদস্য, ৩৩৫০টি ট্যাঙ্ক, ২৭৭০টি প্লেন, এবং ৭২০০টি কামানের অংশবিশেষ – এতে এটি হয়ে উঠে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ বহিরাক্রমন।

হিটলার মূলত স্ট্যালিনের সাথে একটি চুক্তি করেছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নকে যুদ্ধের বাইরে রাখার জন্য। এটি সোভিয়েতদের নিরাপত্তার মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছিলো, কিন্তু আড়ালে তারা রাশিয়াকে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। অথচ যখন এটা ঘটলো, তাদের কাছে তখনও তা ছিলো অপ্রত্যাশিত।

blank
সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী স্ট্যালিন এবং জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোয়াকিম ভন রিবেন্ট্রফ নাৎসি- সোভিয়েত চুক্তিতে হ্যান্ডশেক করছেন। এটি, মোলোটোভ-রিবেন্ট্রফ চুক্তি নামেও পরিচিত।

রেড আর্মি জেনারেল স্টাফরা নিশ্চিত ছিলেন যে জার্মানরা বেলোরাশিয়ার ভেতর আসবে প্রিপিয়াট মার্শাস এর উত্তরদিক হতে – যা নির্ভুল ছিলো। স্ট্যালিন বিশ্বাস করতেন, যাহোক, আক্রমণ এটার দক্ষিণ দিক থেকে হবে, ইউক্রেনের অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলো সেদিকেই ছিলো।

তারা তখনও সৈন্য মোতায়েন করছিলো যখন জার্মানরা এলো। যদিও জার্মানদের ট্যাঙ্ক হতে সোভিয়েতের ট্যাঙ্কগুলোর মডেল ছিলো উন্নতর, কিন্তু তাদের সেগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিলনা। সোভিয়েতদের বারুদ/গুলি, রেডিও, এবং সরবরাহ করার ট্রাকেরও কমতি ছিলো – যা জার্মানদের ব্যাপক সুবিধা করে দেয়।

মারিয়ার সুরক্ষার জন্য, মারিয়াকে পাঠানো হয় সাইবেরিয়ার টোমস্‌ক-এ, এবং সেখানে তিনি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন নিজের প্রফুল্লতা ধরে রাখার জন্য। তবে সোভিয়েতদের ট্যাংক উন্নতর ছিল, তাদের অবকাঠামো এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো অন্যরকম। তার প্রিয় ইলিয়ার ভাগ্য জানার আগেই তার দুই বছর অতিবাহিত হয়ে যেত।

blank
সাউমুরের ফ্রেঞ্চ টাউনে একটি T-34-85. ছবিটি তুলেছেনঃ আন্টোনিভ ১৪ – CC BY-SA 2.5

কিয়েভের ঠিক বাইরেই জার্মান সেনারা তার স্বামীকে হত্যা করে। এই ঘটনার পরপর মারিয়া বারসার্কে চলে যান। এরপর নিজের যা ছিলো সবকিছু বিক্রি করে দেন এবং স্ট্যালিনকে একটি চিঠি পাঠান। লিখেনঃ

আমার স্বামী মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে গিয়ে মারা যান। আমি ফ্যাসিস্ট কুত্তাদের উপর প্রতিশোধ নিতে চাই তার মৃত্যুর জন্য এবং সোভিয়েতের সেইসব নাগরিকদের মৃত্যুর জন্য যারা ফ্যাসিস্ট বর্বরদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছিলো। এই উদ্দেশ্যে, আমি আমার ব্যক্তিগত সকল সঞ্চয় জমা করেছি – ৫০ হাজার রুবল – কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি ট্যাংক কেনার জন্য। আমি বিনীতভাবে চাই ট্যাংকটার নাম হবে, “ফাইটিং গার্লফ্রেন্ড” এবং আমাকে সেই ট্যাংকের ড্রাইভার হিসেবে ফ্রন্টলাইনে পাঠাতে হবে।

যদি তিনি মারিয়ার প্রস্তাবটি নাকচ করে দিতেন হয়ত আতঙ্কগ্রস্থ মারিয়া তার পেছনেও ছুটত। স্ট্যালিন লিখেছিলেন, “নিশ্চয়ই”!

নিরাপত্তা কমিটি তেমন রাজি ছিল না। কিন্তু তার দেয়া পাব্লিসিটির মান তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো, তাই তারা তাকে একটি মধ্যম মানের টি-থার্টিফোর ট্যাংক দেয়।

blank
মারিয়া তার কেনা ট্যাংকটিতে।

এরপর তাকে পাঁচ মাসের দীর্ঘ প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের মধ্য দিয়ে রাখা হয় – যেখানে নিয়োগকৃত পুরুষ সৈন্যদের আরো কম সময় দেয়া হতো সম্মুখ যুদ্ধে পাঠানোর পূর্বে (প্রায়সময় তখনও প্রস্তুতহীন)। প্রশিক্ষণের পরে, ১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বরে  মারিয়াকে নিয়োগ দেয়া হয় ২৬তম গার্ডস ট্যাংক ব্রিগেডে একজন ড্রাইভার ও মেকানিক হিসেবে – এরপর হয়ে যান একজন হাস্যকর বস্তুতে।

একজন নারী!? একটি ট্যাংকে! নামটা ফাইটিং গার্লফ্রেন্ড?!  সেখানে চলছিলো একটি সত্যিকারের যুদ্ধ আর মারা যাচ্ছিলো সত্যিকারের মানুষ। তখন কোন পাব্লিসিটি স্টান্ট নেয়ার সময় ছিলো না।

এটা পরিষ্কার ছিলো যে, তারা আগে কখনও এমন কিছু শুনেনি যে একজন নারী তার জীবনের ভালোবাসা হারালে কি হয় – বিশেষভাবে যখন সে তা নাৎসিদের নিকট হারায়। কিন্তু তার বোন জানতো, কারণ মারিয়া তাকে লিখেছিলো, এই দাবিতে, “আমি আগুণ দিয়ে আমার *ব্যাপ্টিজম করেছি…কখনও, আমি এত রেগে যাই যে আমি নিঃশ্বাস নিতে পারিনা”

*ব্যাপ্টিজম/baptism - খ্রিস্টান চার্চে একজন ব্যাক্তির পরিশোধন বা পুনরুত্থান বা খৃস্টান চার্চে যোগদানে কৃত ধর্মীয় রীতি, যা সাধারণত পবিত্র জল দিয়ে করা হয়ে থাকে।

অন্যরা তা জানতে পারে ২১শে অক্টোবর, ১৯৪৩ সালে, সমোলেন্সকে।যা অবস্থিত রাজধানী মস্কোর পশ্চিম-দক্ষিণপশ্চিম দিকে ২২০ মাইল দূরে, জার্মানরা ১৯৪১ সালে শহরটিকে দখল করেছিলো কিন্তু এরপর আর এগোতে পারেনি। রাশিয়ানরা এটা ফেরত নেয় সেপ্টেম্বর ২৫, ১৯৪৩ সালে, কিন্তু তখনও জার্মানদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হচ্ছিলো।

মারিয়া ফাইটিং গার্লফ্রেন্ড এর ইঞ্জিন চালু করে এবং আক্রমণ করে – বিভিন্ন অ্যান্টি ট্যাংক বন্দুক এবং মেশিনগান ঘাঁটি প্রতিহত করে, ট্যাংকটি আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত। আদেশ উপেক্ষা করে, বাইরে লাফিয়ে বেরোয়, শত্রুর ভারী গোলাবর্ষন সত্ত্বেও, যুদ্ধে ফিরে আসার আগেই ঠিক করে ফেলে ক্ষয়ক্ষতি। জার্মানদের সর্বশেষ প্রতিরোধ ঘাঁটিগুলো অবশেষে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, এবং মস্কোর পথ তাদের জন্য আর নিরাপদ রইলো না।

তারা তাকে “মা” বলে ডাকত এই ঘটনার পরে, কিন্তু এটা যথেষ্ট ছিলনা। তারা তাকে সার্জেন্ট পদে উন্নীত করে।

blank
“গোল্ডেন স্টার”, সোভিয়েত ইউনিয়নের হিরোর পদক।

কয়েক সপ্তাহ পরে ১৭ নভেম্বরে, সোভিয়েতরা ভিটেবস্‌ক এ দ্য টাউন অব নোভোয়া সেলো পুনরুদ্ধার করে। মারিয়া জার্মান প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানগুলি আক্রমণ করতে থাকেন একটি কামানের খোসা তার ট্যাংক ট্র্যাক উড়িয়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত। কাভার ফায়ারের মধ্যেই তিনি বেরিয়ে আসেন প্রিয় ট্যাংকটিকে ঠিক করা জন্য, পুনরায় তার ইউনিটে যোগদানের পূর্বে।

১৭ই জানুয়ারি, ১৯৪৪, তাকে দেখা যায় শেভেডি শহরের বাইরে, তখনও ভিটেবস্‌কে। মারিয়া বিভিন্ন জার্মান পরিখা আক্রমন করেন, মেশিনগান ঘাঁটি, এবং কামান বন্দুক, যখন, আপনি অনুমান করে নিলেন – তার ট্যাংক একটি জার্মান এন্টি ট্যাংক শেল দ্বারা বিদ্ধ হয়েছিলো।

সবসময়ের মত, তিনি লাফিয়ে বেরিয়ে এলেন ফাইটিং গার্লফ্রেন্ড ঠিক করার জন্য।কাজ শেষ করেই ফেলছিলেন এমন সময় ভাগ্য ফুরিয়ে যায় তার। ঠিক কয়েক মিটার দূরেই আরেকটি অ্যান্টি ট্যাংক শেলের বিস্ফোরণ ঘটে। অজস্র শেল টুকরো তার দিকে ছুটে আসে, কিছু বিদ্ধ হয় তার মাথায়।

মারিয়ার জ্ঞান এরপর আর কখনও ফিরে আসেনি।তাকে কিয়েভের কাছাকাছি একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো এবং দুই মাস কোমায় ছিলেন অবশেষে তার স্বামী ইলিয়ার সাথে পুনরায় সঙ্গ দেয়ার আগ পর্যন্ত। আগস্টের মধ্যেই তারা তাকে সোভিয়েতের হিরো হিসেবে ঘোষণা করে।

এই আর্টিকেলটি অনুবাদ করা হয়েছে, Nazis Killed Her Husband, She Bought and Drove a T-34 & Then Went On a Rampage এই আর্টিকেলটি হতে।