ভালোবাসা শব্দটার কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নেই, নেই কোনো নির্দিষ্ট বলয়। সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ, অসীমের পথে সর্বত্র জুড়ে এর পদচারণা। এ ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া যাবে মানুষে-মানুষে, প্রাণে-প্রাণে, স্রষ্টার সৃষ্টিতে-সৃষ্টিতে।
মানুষ স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হওয়ার সৌভাগ্য নিয়ে এই ধরায় পদার্পণ করায় তৈরি করতে পারে ভালোবাসার অনবদ্য ইতিহাস। সাদাকালো বর্ণীল বর্ণ-অক্ষরে লিখতে পারে প্রণয়োপাখ্যান। পাথর কেটে ইটের ভাঁজে ভালোবাসার কংক্রিট এঁটে সৃষ্টি করতে পারে প্রেমের নিদর্শন।
প্রকৃতির মাঝেও খুঁজে পাওয়া যায় নিখুঁত ভালোবাসার অনন্য সৌন্দর্য। প্রকৃতির পরতে পরতে লেখা থাকে তাদের ইতিহাস, মাতাল করা মোহনিয়া স্নিগ্ধতা সাজায় অনিঃশেষ প্রেমে। আজকে এমনই এক প্রেমিক যুগলের প্রেম প্রত্যক্ষ করেছি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। সবার জন্য যে সম্মোহনী সৌন্দর্যের দ্বার উন্মোচন করে রেখেছে শতাব্দী থেকে শতাব্দীর পথে।
ধামরাই থেকে কালামপুরের উদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। উপভোগ করা যাবে গ্রামের ভেতর দিয়ে মসৃণ রাস্তায় ছুটে চলা বাস ভ্রমণ। দুইপাশে গাঢ় সবুজ লেবু বাগান। সবুজের ফাঁকে ফাঁকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে বার্ধক্যের ছোঁয়ায় হলুদ রং ধারণ করা লেবুপাতারা। কালামপুর বাজার থেমে মিলবে অটো বা ভ্যান। বাংলাদেশের সবখানে এই ভ্যানগুলো দেখা যায়না। ভ্যানের চারপাশে বসে খোলা আকাশের নিচের সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথের সৌন্দর্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিবে ভ্রমণ পিপাসা।
প্রায় পাঁচ শতাব্দী আগে সংসার পেতেছিল এক জোড়া বৃক্ষ-দম্পতি, পাকুড় ও বট। ধামরাইয়ের সাইট্টা নামক গ্রামের স্বনামধন্য বংশ হলো দেবীদাস বংশ৷ সনাতন ধর্মের এই বংশের পূর্বপুরুষ খুব আয়োজন করে বিয়ে দিয়েছিলেন একজোড়া বৃক্ষকে। সনাতন ধর্মে পাকুড় গাছকে পুরুষ ও বট গাছকে নারী হিসেবে অভিহিত করা হয়। পাশাপাশি রোপণ করে ধর্মীয় বিবাহ আচারের মধ্য দিয়ে তাদের সম্পর্কের একটি নাম দিয়েছিলেন, স্বামী-স্ত্রী। তাদের সেই বিয়েতে এসেছিলেন অনেক অতিথি। ভোজনের দ্বারা করা হয়েছিল অতিথি আপ্যায়ন। অনুষ্ঠান শেষে দেবতার আসনে বসা নববিবাহিত দম্পতিযুগলের আশীর্বাদ নিয়ে ফিরেছেন সকলে। আর সেই থেকে আজ অব্দি জায়া-পতি বেঁচে আছে একে অপরের সাথী হয়ে। কালের স্রোতধারায় মিশে গেছে একে অন্যের সাথে। সমগ্র দুর্যোগে পরস্পরের ঢাল হয়ে বেঁধে রেখেছে আষ্টেপৃষ্টে।
৫০০ বছরের সংসার বেড়ে দখল করেছে পুরো পাঁচ বিঘে জমি। কুশুরা ও ধানতারার পাকা রাস্তার মাঝমাঝি যায়গা থেকে কাঁচা রাস্তার শাখা বের হয়েছে বট-পাকুড়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে। কাদামাটির ওপর ফেলা হয়েছে চকচকে বালি। রাস্তার দুইপাশে নিচু ক্ষেত। বর্ষার দিনে যতদূর চোখ যায় শুধু কচুরিপানার রাজত্ব নজরে আসে। সবুজের মাঝে হালকা বেগুনির সে এক মায়াবী মনোহর দৃশ্য।মাঝেমধ্যে দেখা যায় ছোট ছোট কয়েকটা নৌকা।
রাস্তা ধরে যেতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে হবে উন্মুক্ত গুহার প্রবেশপথ দেখে। হ্যাঁ, গুহাই বটে৷ বট গাছের অবারিত শাখা-প্রশাখা ও ঝুরিগুলো এমনভাবে চারপাশে গোল হয়ে মাটি ছুঁয়ে গেছে যে দেখে মনে হবে সবুজে ঘেরা একটি প্রকৃতির গুহা। প্রবেশপথটাও ঠিক গুহার প্রবেশপথের মতো হওয়াও গুহা না ভাবার কোনো কারণই অবশিষ্ট থাকে না।
প্রবেশপথ দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখের তারায় খেলা করে যায় অবাক চাহুনিরা। মাথার ওপরে সবুজের ছাউনি। অপলকভাবে তাকিয়ে থাকতে হবে কিছুক্ষণ। এরপর সামনে তাকাতেই চোখে ধরা পড়বে জন্মান্তরের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বট-পাকুড় যুগল। তাদের জন্মের শুরুটা বুঝতে একটু কষ্ট হবে। কেননা সন্তান যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয় তখন বাবার সমানই লম্বা হয়৷ বটের ঝুরিগুলোর মাতৃগাছের ন্যায় বেশ শৌর্যবীর্য ছড়িয়ে তার অস্তিত্বের প্রমাণ দিচ্ছে। তবে একটু বামের দিকে গেলেই পাওয়া যাবে উভয়ের জন্মসূত্র। প্রথমে দেখে বোঝা-ই যাবেনা কোনটা বট আর কোনটা পাকুড়! তবে খেয়াল করলে আশ্চর্যজনকভাবে আবিষ্কার করা যাবে দুটি খুব সহজেই আলাদাভাবে বোঝা যাচ্ছে৷ বট, পাকুড় উভয়েরই ঝুরি থাকে। কিন্তু এখানের অবাক করা বিষয় হচ্ছে শুধুমাত্র বটের ঝুরি বের হয়ে ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। কিন্তু পাকুড়ের কোনো ঝুরি বের হয়নি। সে তার বিশাল কান্ড প্রসারিত করে ছেঁয়ে গেছে বটের সাথে সঙ্গী হয়ে৷ দেখে মনে হবে উভয়ে মিলিত হয়েছে ভালোবাসার গভীর আলিঙ্গনে।
এর পাশেই দেখা যাবে মরিচা ধরা টিনের দোচালা একটি ঘর। দম্পতিযুগলের বেড়ে ওঠার সাথে সাথে এদের ঘিরে শুরু হয় বিভিন্ন পূজা অর্চনা। বসে মেলা ও উৎসব। তাদের চিরযৌবনা সংসারে অবিরাম লেগে থাকে আনন্দ পার্বণের খেলা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা গড়ে তোলে একটি কালী মন্দির। এটিই সেই মন্দির। যেখানে রোজ হয় উপাসনা। পূজা দেয়া হয় কালী, সরস্বতী ও বুড়ি দেবীর। পাশেই রয়েছে ছোট্ট আরেকটি টিনের কুটির। একেবারে ছোট, দৈর্ঘ্য প্রস্থ উভয়পাশে ফুট চারেক হবে। সেখানে কৌতুহল বসত উঁকি দিলে দেখা যাবে দেবী শীতলার মূর্তি।
জনশ্রুতি আছে এই বট-পাকুড়ের সংসারে কেউ আঘাত হানলে তার ওপর নেমে আসে অভিশাপ। বটের বা পাকুড়ের ডাল কেটে এভাবেই অভিশাপের বরপুত্র হয়েছে গ্রামের কয়েকজন। যাদের জমি ছিল এই বৃক্ষযুগলের আশেপাশে। তাদের জমিতে বটের ডাল গেলে কেটে দিতেই কয়েকদিনের মাথায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তারা। এক ট্রাক ড্রাইভারও এই একই ঘটনার শিকার হয়েছেন বলে জানা যায়। বটের নিচ দিয়ে ট্রাক নিয়ে যাওয়ার সময় একটি ডাল কাটতে হয় তাকে। এরপর সে অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে বাতাসা, মোমবাতিসহ পূজা অর্চনা করে এর থেকে মুক্তি লাভ করে৷
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে ধামরাই হয়ে বাসে কামালপুর বাজার আসতে হবে। ওখান থেকে অটো, ভ্যান কিংবা রিকশায় কুশুরা বা ধানতারা হয়ে সাইট্টা গ্রাম।
Feature image source : তাসমিয়া তাবাসসুম