বই- এপারে কেউ নেই (মনস্তাত্ত্বিক সামাজিক উপন্যাস)
লেখক- শিহানুল ইসলাম
প্রচ্ছদ- সজল চৌধুরী
প্রকাশনা- ভূমি প্রকাশ
মলাট মূল্য- ২১০ টাকা
প্রকাশকাল – বইমেলা ২০১৮ ইং
কাহিনী সংক্ষেপ
গল্পটা অরুণের। দেশ ছেড়ে যাওয়ার এক যুগ পেরিয়ে যাওয়ার পর যে ফিরে এসেছে নাড়ির টানে। পার্টিশনের পর যাকে প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল ওপারে।
গল্পটা জহিরের। উত্তাল সেই সময়ে যে প্রিয় বন্ধুকে নিজের বাড়িতে জায়গা দিতে পারেনি। যার অনুশোচনা পনেরো বছর ধরে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে। পারমিতার অষ্পষ্ট স্মৃতি বুকে নিয়ে জহির অপেক্ষা করছিল। সে জানতো- অরুণ একদিন ঠিকই ফিরবে৷ সেই এক অমোঘ সত্যটা যে তাকে বড্ড পোড়ায়৷ তার বিশ্বাস, অরুণ এসে সেই আগুন নেভাবে। সত্যিই কি অরুণ জহিরের বুকের মধ্যকার আগুন নেভাতে পেরেছে?
গল্পটা প্রভাতীর। প্রচন্ড আত্মকেন্দ্রিক, একগুঁয়ে, উড়নচন্ডী মেয়েটা মাত্র কিছুকাল আগে আবিষ্কার করেছে- জহির তার বুকের মধ্যেকার সেই অপেক্ষা, যা তার বেঁচে থাকার প্রকৃত অর্থ। মেয়েটা জীবনের সাথে একলা যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত। তাই সে জহিরকেই আঁকড়ে ধরতে চায়।
গল্পটা নূরজাহানের, সেও বুকের গভীরে এক চিরন্তন অপেক্ষা পুষে রেখেছে। অপরিচিত শহরের প্রতি যার অদ্ভুত ভালোবাসা…
গল্পটা রাজেন সরকারের। যিনি রাজনৈতিক আদর্শের সাথে নিজেকে একাকার করে দিয়েছেন।
এবং গল্পটা অবশ্যই পারমিতার। যে বইয়ে নেই, কিন্তু পুরো বই জুড়ে যার আবেশ ছড়িয়ে আছে।
গল্পটা সাতচল্লিশের উত্তাল সময়ের মুখোমুখি হওয়া মানুষগুলো মনস্তত্ত্ব নিয়ে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
সাধারণত থ্রিলার হাইভোল্টেজ বইগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, একবার বই হাতে নিলে শেষ না করে রাখা যায় না। এসবক্ষেত্রে জীবনধর্মী বইয়ে অত স্পিডে না পড়লেও চলে। আমি চেয়েছিলাম এই বইটি তারিয়ে তারিয়ে পড়ব। একটু একটু করে পড়বো যাতে শেষ না হয়ে যায়। কিন্তু আমি আমার ইচ্ছেটাকে বহাল রাখতে পারিনি। বইটা পড়তে শুরু করার পর অদ্ভুত এক আচ্ছন্নতায় ডুবে গিয়েছি। মনে হচ্ছিল একটা অস্ফুট হাহাকার বুকের মধ্যে আটকে আছে। তাই টানা পড়ে যাচ্ছিলাম, যদি এই হাহাকারের আবেশ থেকে বেরুতে পারি!
শেষ পর্যন্ত বেরুতে পেরেছিলাম কি না, বলবো না। সেটা আপনারা নিজেরা যাচাই করবেন।
প্রভাতীর চরিত্রটার মধ্যে যেন নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম। আমার কেন যেন মনে হয়, এই বইয়ের কোনো না কোনো চরিত্রে মেয়েরা নিজেকে খুঁজে পাবেই। চরিত্রগুলো যেন তৈরিই করা হয়েছে সেভাবে।
পুরো বইটা যেন একটা চিঠির পশরা। মোট পাঁচটি চিঠি বইয়ে। চিঠিগুলো যেন একেকটা গল্প। নিজের ভিতরের স্বত্ত্বার প্রকাশ, পারিপার্শ্বিকতা, আবেগ, জীবনবোধে টইটম্বুর। বইয়ে চিঠির ফ্রন্টটাও দারুণ। হাতে লেখা চিঠির ফ্লেভার পাচ্ছিলাম।
বইয়ের কিছু কিছু জায়গা পড়ে কেমন ধাক্কার মতো লাগে।
“শুধু কাছে থাকলেই ছোঁয়া যায়? তুই পারছিস অরুণ আমায় ছুঁতে?” – এই লাইন পড়ে তীব্রভাবে কেঁপে উঠেছিলাম। সত্যিই তো। পাশাপাশি বসে থেকেও যেন অরুণ আর তার বন্ধুকে ছুঁতে পারছিল না।
বর্ণনাভঙ্গির কথা একদম না বললেই নয়। প্রকৃতির এরকম উপমারহিত সৌন্দর্য আর পড়িনি। বই থেকে কয়েকটা লাইন তুলে দিই।
“চন্দনপুরের ভোর মানে এক পাল ঠান্ডা বাতাসের পরশ৷ মনে হয়- কাছেই কোথাও খুব জোরে ঢল নেমেছে৷ অথচ তা নয়, হাজার মাইল পেরিয়ে এইখানে এসে বাতাসেরা একটু জিরিয়ে নেয়৷ যমুনার ঘোলা জলের ওপর আলতো করে শুয়ে থাকে, গা ধোয়৷ তারপর ভেজা শরীর নিয়ে বয়ে চলে যায় পশ্চিমের কোন মরুভূমিতে…”
কিংবা,
“…যমুনার বিশালতার মধ্যে বুঁদ হয়ে রইল খানিক্ষণ৷ এরপর আমায় পেছনে ফেলে পাড় ধরে উত্তর দিকে হাঁটতে লাগল৷ স্রোতের উল্টোদিকে৷
আমি বেশ জোর গলায় বললাম, ‘তোর একটা চিঠি আছে আমার কাছে৷ পারমিতা’দির লেখা৷ এতদিন ঠিকানা ছিল না বলে পোস্ট করা হয়নি৷’
অরুণের কোন সাড়া শব্দ নেই৷ তাকিয়ে দেখি- অনেকটা দূরে চলে গেছে৷ আমার নাগালের বাইরে৷
এই দূরত্ব ঘোচায়, কার সাধ্য?”
কথোপকথনগুলো মোটেও সাধারণ নয়। ডায়লগগুলোর মধ্যে যে কী গভীর মনস্তত্ত্ব! আমি শিওর এই লোক তার বৌকে এরকম বাক্যবাণ দিয়েই কাবু করবে!
কেবল প্রশংসাই করে গেলাম। একটা বইয়ে কোনো খুঁত থাকবে না, তা তো হয় না। খুঁত আছে। তা হলো, লেখনীতে ওপার বাংলার একটা টান আসে। ঠিক নির্দিষ্ট কোনো লেখকের মতো নয়। ওপারের লেখকেরা কিছু বিশেষ শব্দ ব্যবহার করেন নিজেদের লেখায়। সেসব শব্দের কিছু এই বইয়েও আছে। তবে লেখনীতে ডুবে গেলে এটা খুব একটা সমস্যা করে না।
বইয়ের প্রচ্ছদ একদম পারফেক্ট হয়েছে টপিকের সাথে। বাঁধাইও বেশ ভালো। নতুন প্রকাশনী হিসেবে ভূমি ভালো কাজ দেখাচ্ছে।
খুব করে আবেশিত হতে চাইলে, বইয়ের পাতায় পাতায় বুঁধ হয়ে থাকতে চাইলে “এপারে কেউ নেই” বইটি আমার পক্ষ থেকে হাইলি রেকমেন্ডেন্ট।