গল্প- জন্মদাগ

রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দশ বছরের  শিশু বাচ্চা রুপক তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে বাবা আমার কপালে এত বড় কাটা দাগ কিসের! কিভাবে কাটা গেল আমার কপাল? বাবা কখনো উত্তর দেয় না । বলে-“তুমি বড় হও একদিন গল্প করতে করতে তোমায় সব বলে দিব”। কিন্তু না আজ আর ছেলে মানতে চায় না। কারন প্রতিদিন একটা না একটা অযুহাতে বাবা তার কাছ থেকে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকে! এদিকে ছেলেকে যে সত্য ঘটনাটা বলবে সে সাহস বা শক্তি কোনটাই তার হয়না! কারন এই একটা প্রশ্নের সাথে মিশে আছে তার আবেগ, ভালোবাসা,অনুভূতি, চিরতরে হারানোর বেদনা। কিন্তু এই ছোট্ট শিশুকে আর কত ভুলিয়ে রাখবে?সত্যটা একদিন সে নিশ্চয় জানতে পারবে? সে দিনই বা বাবা কি উত্তর দিবে? অনেকগুলো প্রশ্ন যখন তীরের মত তার মস্তিষ্ক রক্তাক্ত করতে লাগলো তখন সে নিকশ কালো রাতের  নিশ্চুপতাকে বরণ করে নিল। কারন এই সব প্রশ্নগুলোর  উত্তর দেওয়ার জন্য মানসিক সুস্থতা  দরকার। আজ তা হয়ত তার নেই, কিন্তু মনবল ঠিকিই আছে। কারন হারানোর বেদনা তাকে আজ কঠিন পাহাড়রের মত স্থিরতা দান করেছে। যদিও একটা সময় পাহাড়ের ও কান্না পায়! আর তা ঝর্ণা বলে আমরা সাধারণে উপভোগ করি!

– আর তাই চোখের কোনের জল উপচিয়ে পড়ার আগে ছেলেকে ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল-“এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর কি তোমার চাই ই চাই বাবা?

-হ্যাঁ, আমার উত্তর চাই ই চাই। তুমি রোজ বলবে বলে আর বল না! জন্মের পর দাদুই নাকি আমাকে দেখ-ভাল করেছে! আমি যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকে মা’য়ের শূন্যতা অনুভব করি! মা’কে দেখতে পাইনি বলে যখন কোন বন্ধুর মা’কে দেখি তার মুখের অবয়বয়ের সাথে মনের অজানতেই মা’য়ের ছবি আঁকি মনের রঙ্গিন ছবিঘরে! যে ঘরে শুধুমাত্র মায়ের ছবিই রোজ আঁকি।  মা’কে দেখনি? মা’য়ের কথা শুনতে পাই নি? মায়ের আদর,ভালোবাসা কোনটাই পাইনি! মায়ের স্পর্শ পেতে খুব ইচ্ছে করে! কিন্তু তোমাকে কখনো বলিনি কারন দাদু আমায় রুটিন করে প্রায় বলতো রুপক বাবার সামনে কখনো মায়ের কথা জিজ্ঞেস করোনা যেন। তাহলে বাবা কষ্ট পাবে। তুমি কি চাও বাবা কষ্ট পাক? আমি বলতাম না দাদু আমি চাই না। দাদুকে যদি বলতাম দাদু আমার মা নেই কেন ? দাদু বলতো মা নেই তো কি হয়েছে আমি তো আছি! আমি তোমার সওয়ারের ঘোড়া হব, কাক ডাকা ভোরেতে কাক হয়ে কা কা শব্দে ঘুম ভাঙ্গাবো, দোয়েল হয়ে শিস দিব, মিষ্টি সুরের কুকিল হব,তোমার ঘুমের ঘরের কাঁথা হব,আর কি তুমি হতে বল? দাদুর কথায় আমি সাঁয় দিইনা দাদু ও বুঝতে পারে। তবু আমায় ভালো রাখার নিছক চেষ্টা সে করেই চলেছে।

এই সব কথা শুনে বাকরুদ্ধ বাবার  অশ্রু আর থাকতে চাইলো না অন্তরালে ঝর্ণার ধারায় প্রবাহিত হতে থাকলো চিবুক বেয়ে! ছেলের অনুভূতির তীব্রতা আঘাত করলো তার অনুভূতিতে। নিরবতা ভেঙ্গে নিজেকে সামলিয়ে ছেলের হাত ধরে নিয়ে গেল একটা কবরস্থানে। এই কবরস্থানে ছেলেকে নিয়ে বাবা আরো অনেক বার এসেছে কিন্তু ছেলের বুঝার বয়স হয়নি তখনো! আজ ছেলে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে কিন্তু নির্বাক দৃষ্টিতে অফলক তাকিয়ে বাবার দিকে!

কবর জিয়ারত শেষ করে বাবা বললেন-“তোমার জন্মের ঠিক একদিন আগে আমরা হাসপাতালে একটা সিট ভাড়া করে তোমার মা’কে নিয়ে আসি। ঐ রাত্রেই তোমার মায়ের প্রসব বেথ্যা দেখা দেয়,আমরা খুব দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করি। ডাক্তার আসলেন আর তোমার মা’কে দেখেই বললেন আপনারা দেরি করে পেলেছেন,আরো আগে  খবর দেওয়া উচিত ছিল। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না উনি কি বললেন! কারন আমি কোন বিলম্ব করিনি। কিন্তু উনি আমাদেরকে দুষতে লাগলেন। আর বললেন বাচ্চা ও মা’কে বাঁচাতে হলে এখুনি সিজার করাতে হবে! তখন আমি আমার শরীরের সব বোধ শক্তি মনে হয় হারিয়ে পেললাম। ডাক্তারকে এই কথা বলবো যে- ‘আমি এর আগে যতবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়েছি, গাইনি ডাক্তার সবকিছু স্বাভাবিক আছে বলেছিল। আপনারা হঠাৎ  এটা কেন বলছেন?’ কিন্তু আমি পারলাম না।  কথা বলার ভাষা হারিয়ে পেললাম। এইটুকু মনে আছে ওরা আমার কাছ থেকে একটা দস্তখত নিল। তার এক ঘণ্টা পরে এসে বলল- ‘অপারেশন সাকসেসফুল।’ “

“আমি বললাম আমার বাচ্চা ও তার মা সুস্থ আছে তো ? ডাক্তার বললেন হ্যাঁ আছে। আমরা কি দেখা করতে পারি? বললেন -হ্যাঁ পারেন। তবে বাচ্চা নিবিড় পরিচর্যাতে আছে, এখন বাচ্চা দেখতে পারবেন না। সময় হলে আমরাই বলবো। ভারাকান্ত মনে তোমার মাকে দেখতে গেলাম কিন্তু তোমার মায়ের জ্ঞান ছিল না। তখন আমার  মনে পড়ল হাসপাতালে আসার ঠিক আগ মূহূর্তে তোমার মা আমাকে বলেছিল- ‘আমাকে ক্ষমা করে দিও জীবনে তোমার মত মানুষ পেয়ে আমার জীবন ধন্য হল।‘ নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম জ্ঞান ফিরবে কখন?নার্স বলল-  স্বাভাবিক ভাবে দুই –এক ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান আসে। কিন্তু রাত শেষ হয়ে গেল তোমার মায়ের আর ঘুম ভাংলো না। তোমার মা’কে এখানে সমাধিস্থ করে যখন তোমাকে দেখতে গেলাম ওরা দেখা করতে দেবেনা, ওরা বলছে নিয়ম নাই! মূলত ওরা তোমাকে লুকিয়ে রেখেছিল কারন ওরা শুধু তোমার মায়ের পেটে ছোরা বসায়নি ওরা পেটের সাথে সাথে তোমার কপালেও ছোরা বসিয়ে দিয়েছিল! যে দাগ তোমার মায়ের মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়। ডাক্তারদের প্রহসনের কথা মনে করিয়ে দেয়! আর এই দাগ তোমাকে আর কোন দিন আয়নার সামনে দাঁড়াতে সাহস দিবে না! কারন এই গভীর কাটা দাগ একটা পরিবার ধ্বংসের ইতিহাস টেনে নিয়ে যাবে কয়েক যুগ! ”