পর্ব-১:
রুবিনা (ছদ্মনাম) একজন কর্মজীবী মহিলা । ঢাকায় থাকেন । চাকুরী করলেও সে এখনও বিয়ে করেনি । ভাবছে নিজের জীবনটা আগে একটু গুছিয়ে নিয়ে তারপর বিয়ে করবে । তার অফিস সকাল ৯টায় ।
সকাল ৬টা । চারিদিকে পাখির কলতান আর সূর্য মামার উঁকিঝুঁকিতে রুবিনার ঘুম ভেঙে গেল । রুবিনা আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় উঠে বসল । সারাদিনের একটা চিত্র মনের মধ্যে এঁকে ফেলল । এখন তাড়াতাড়ি উঠে নাশতা বানাতে হবে । অফিসের জন্য তৈরী হতে হবে । অফিসের কথা মনে হতেই এক অজানা আতংক ফুটে উঠল তার চোখে মুখে । ঝটপট বিছানা থেকে নেমে পড়ল সে । একটু দেরী হলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে ।
কাজ শেষ করার জন্য তাড়াতাড়ি হাত চালাল সাথে মুখও । রান্না সেরে নাকে মুখে খেয়ে বের হতে হতে তখন বাজে ৭.৪৫ মিনিট । রুবিনার চোখে মুখে আতঙ্ক আর বিরক্তির ভাব এখন স্পষ্ট । মনে মনে ভাবছে এই হল ! আজ বাসে উঠতে খবর হয়ে যাবে । সকাল ৭.২০ মিনিটের পর বেরোলেই তো আর বাসে ওঠা যায় না ভিড়ের জন্য ।
সে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল ৮.০০ টা বেজে গেল । বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে তার মনটাই খারাপ হয়ে গেল । সেখানে মানুষ গিজগিজ করছে । রুবিনা ভাবছে আজকেও বাসে উঠতে বেশ একটা যুদ্ধ করতে হবে । ভাবতে ভাবতেই তার মন খারাপ হয়ে গেল । কতদিন আর এভাবে বাসে উঠতে হবে??
এটা ভাবতে ভাবতেই একটা অর্ধভর্তি বাস এসে থামল তার সামনে । সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক গাদা লোক দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠল । সবাই যে উঠতে পারল তা নয় । কিন্তু বাসের এক ইঞ্চি জায়গাও যেন খালি না থাকে সেভাবে ছেলেগুলো ভেতরে ঢুকে গেল । আর যারা ভেতরে ঢুকতে পারল না তারা বাসের দরজার রেলিং ধরে ঝুলতে থাকল । বাসটা বিপদজনকভাবে একদিকে কাত হয়ে শাঁই করে চলে গেল ।
ঐ এক গাদা ছেলের সাথে পাল্লা দিয়ে কিছু মেয়েও দৌড়ে গেল বাসে ওঠার জন্য । কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়ে আবার রুবিনার পাশে এসে দাঁড়াল । রুবিনা একবার ঘড়ির দিকে তাকাল । ঘড়ির কাঁটা ছুটেই চলেছে অবিরত । ধীরে ধীরে রুবিনার মধ্যে অস্থিরতা কাজ করতে থাকল । কারণ দেরী করে গেলে বসের ঝারি তো খেতেই হবে সাথে সাথে তা রেড রেকর্ডে রেকর্ড করে রাখা হবে এবং মাসের শেষে দেরী করে আসার অপরাধে বেতন থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমান টাকা কেটে রেখে দেয়া হবে ।
এসব চিন্তা করতে করতেই রুবিনার সামনে দিয়ে অনেকগুলো বাস চলে গেল । সেগুলো ছেলেদেরও নিল না । রুবিনা সময় দেখল ৮.৩০ মিনিট । এবার রুবিনা অসহায় দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকাল । কিছু সিটিং সার্ভিস আসছে দেখতে পেল । কিন্তু দূর থেকে সে বুঝতে পারছিল না সিটিং সার্ভিসের দরজা খোলা কিনা । তাই আশা নিয়ে একটু সামনে আগাল সে । যদি বাসে ওঠার সুযোগ পায় । একটি বাস এসে থামল । কিন্তু রুবিনার আগেই ছেলেগুলো দ্রুত পায়ে বাসের দিকে দৌড়ে উঠে গেল ।
রুবিনা আর অপেক্ষা করতে পারল না । সেও মনে মনে ঠিক করল এবার যেভাবেই হোক বাসে উঠতেই হবে । কিন্তু এক ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যেই সে বাসে উঠতে যাবে তখনই বাধ সাধল হেল্পার ।
হেল্পার দাঁত গুলো বের করে বলল, “ আপা,মহিলা সিট নাই, উইঠেন না” । রুবিনা প্রতিবাদ করে যেই বলতে যাবে যে ঐ তো মহিলা সিট,তখন দেখল সেই সিটগুলোতেও ছেলে বসে আছে । হয়ত ৩/৪ জন মেয়ে আছে । আর বাকীগুলো ছেলে । রুবিনা দেখল বাসে অনেক ছেলে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে । রুবিনা তাদের দেখিয়ে বলল, ওরা তো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে,আমিও দাঁড়িয়ে যাব । হেল্পার কিছু বলার আগেই রুবিনা বাসের ভেতর থেকে গগনবিদারী চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেল, “ঐ হালার পুত !মহিলা সিট নাই দেখস না ? মহিলা উঠাইস না” । আরেকজন বলে উঠল, “ সিটিং সার্ভিসে লোক দাঁড়াই নিতাছস, ভাড়াও কিন্তু লোকাল দিমু”। আরেকজন চিৎকার করে উঠল, “ ঐ ব্যাটা ড্রাইভার গাড়ি ছাড়, ব্যাটা শয়তান, মাইনসের বাসা থেইকা টাইনা লোক উঠাবি নাকি গাড়িতে ? শালা হারামজাদা শালা ! থাপড়াইয়া দাঁত ফালাই দেয়ার দরকার ।শালা ফাজিলের ঘরের ফাজিল”।
যাত্রীদের তোপের মুখে গাড়ি দিল ছুট । রুবিনা দাঁড়িয়ে রইল পরের বাসের জন্য । এরপর তার নাকের সামনে দিয়ে আরও কয়েকটা সিটিং সার্ভিস দরজা লাগিয়ে শাঁ শাঁ করে চলে গেল । এরপর দূর থেকে একটি লোকাল বাস দেখতে পেল রুবিনা । এবার সে মনে মনে ঠিক করে ফেলল যে, যেভাবেই হোক এই বাসে সে উঠবেই । বাস ধীরে ধীরে এগিয়ে এল আর চারপাশের মানুষের মধ্যে চাঞ্চল্য বাড়তে থাকল । বাস এসে থামা মাত্রই রুবিনা আর দেরী করল না । যেভাবেই হোক তাকে এবার ভিড় ঠেলে উঠতেই হবে । এক গাঁদা লোকের ভিড় ঠেলে তারা কয়জন মেয়ে বাসে উঠল । বাসে লোক গিজগিজ করছে ।
রুবিনাদের সামনের মহিলা সিটে কয়জন লোক বসা । পেছনের সিট থেকে কয়েকজন বলে উঠল আপা, “ঐগুলা মহিলাদের সিট তাদের উঠাই দিয়ে বসেন”। আবার আরেকজন হেল্পারকে ডেকে বলল, “ ঐ শালা হেল্পার, মহিলা উঠাইছস এখন বসতে দে, ব্যাটা ফাজিল । মহিলা উঠাইলি কেন” ? হেল্পার অসহায় হয়ে মহিলা সিটে বসা লোকগুলোকে বলল, “ভাই এইগুলা মহিলা সিট,মহিলাগুলারে বইতে দেন”। লোকগুলোর মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা গেল না । একজন উঠে সিট ছেড়ে দিল আর রাগে গজগজ করতে লাগল । হেল্পারকে চিৎকার করে বলতে লাগল, শালা হারামজাদা,দেখস নাই মহিলা সিট নাই তাও মহিলা উঠাইছস কেন? শালা হারামি কোথাকার”।
দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর মধ্যে কিছু লোকও তার সাথে গলা মিলিয়ে হেল্পারের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করল মহিলা উঠানোর জন্য । এদিকে যে সিটটা খালি করে দেয়া হয়েছে সেখানে রুবিনা একজন মধ্য বয়স্ক মহিলাকে বসতে দিল । কারন বাস ব্রেক করলেই সে ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল । কিছুদুর যাবার পর রুবিনা খেয়াল করল, তার পাশেই দাঁড়ান মধ্য বয়সী এক লোক তার গায়ের ওপর এসে এসে পড়ছে কিছুক্ষন পর পর । প্রথমে রুবিনা কিছুই বলল না কিন্তু যখন বুঝতে পারল লোকটি ইচ্ছা করে তার গায়ে এসে পড়ছে তখন রুবিনা বলল, “ আপনি আমার গায়ের উপর এসে পড়ছেন কেন? একটু সরে দাঁড়ান । ওদিকে তো জায়গা আছে”। কথা শেষ হতে না হতেই লোকটি বলল, “ম্যাডাম, এইডা পাবলিক বাস । এইখানে গায়ে একটু লাগবেই । এতই যদি সমস্যা হয় তো প্রাইভেট কারে বা সি এন জি তে চড়েন” ।
সাথে সাথে পাশে থেকে কয়েকজন তার সাথে সুর মিলাল । ঠিকই তো, এতই যদি সমস্যা হয় তো এত ভিড়ের মধ্যে বাসে উঠছেন কেন”?
কেউ সুর মিলাচ্ছে আর বাকী সবাই নিশ্চুপ হয়ে এই কথোপকথন শুনছে । রুবিনা বলল, “আমি সি এন জি তে যাব না প্রাইভেট কারে যাব সেইটা কি আপনাদের কাছে শুনে চলতে হবে”? সাথে সাথে লোকটি বলল, “ তাইলে চুপ থাকেন । পাবলিক বাসে উঠলে এইরকম একটু গায়ে ঘেঁষা লাগবেই” ।
রুবিনা কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না । থেমে গেল অপমানে দুঃখে । মনের মধ্যে রাগ ক্ষোভ নিয়ে চুপ করে থাকল । অপেক্ষা করতে থাকল যে, কখন বাস থামবে আর কখন এই নরক থেকে মুক্তি পাবে ।
চলবে …………