আজ আপনাদের শোনাবো খুনের ইনভেস্টিগেশনে ঘটে যাওয়া এক গোয়েন্দাকাহিনী। যা থ্রিলার গল্পকেও হার মানায়। যা হয়তো ছাড়িয়ে যায় মুভি কিংবা বইকে।
১৯৮৪ সালে লন্ডনের একটি পুরনো দ্বিতল বাড়িতে বাস করতেন এক বৃদ্ধা। বৃদ্ধার স্বামী মারা গিয়েছিলেন। সন্তানাদি বলতে তেমন কেউই ছিল না। ফলে নির্জন বাড়িতে বৃদ্ধা একাই বাস করতেন। বৃদ্ধার কোমরের নিচের অংশ প্যারালাইজড ছিল বলে তিনি তেমন নড়াচড়া করতে পারতেন না। চলাফেরার জন্য তার সম্বল বলতে ছিল একটি হুইলচেয়ার। স্বামী মারা যাবার পরে বৃদ্ধা নিজের দেখাশোনার জন্য একজন নার্স রেখেছিলেন।
নার্সটি সকালে এসে রাতে চলে যেত। সারাদিন তাকে সঙ্গ দেওয়ার পাশাপাশি ঘরের খুটিনাটি কাজও করত। তবে সবথেকে কঠিন কাজ ছিল বৃদ্ধাকে উপরতলা থেকে নিচে ও নীচতলা থেকে উপরতলায় তোলা। কারন দ্বিতল বাড়িতে উপরতলা ও নিচতলার সংযোগ বলতে ছিল পুরনো একটা কাঠের সিড়ি। ফলে চলাচলে অক্ষম ওই বৃদ্ধাকে নার্সটি দুহাতে কোলে তুলে উপরে কিংবা নিচে নেওয়া লাগত।
একদিন পুলিশ স্টেশনে একটি ফোনকল এল। একজন বৃদ্ধা খুব উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানালেন, তার বাড়িতে একটা খুনের ঘটনা ঘটেছে। ফোন পাওয়ার পরে তৎক্ষণাৎ পুলিশের একটি টিম সেই বাড়িতে পৌছে গেল। কিন্তু খুনি ততক্ষণে পালিয়েছে বলে তাকে হাতেনাতে ধরা সম্ভব হল না। এই খুনের ইনভেস্টিগেশনের দায়িত্ব পড়ে ডেভিড নামের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার উপর।
প্রাথমিক ক্রাইম সিন রিপোর্টের জন্য ডেভিড খুব দ্রুত সেই বাড়িতে পৌছে যায়। প্রধান ফটক খুলে ঘরে ঢুকতেই মেঝেতে নার্স মেয়েটির লাশ দেখতে পায় সে। মেয়েটিকে খুব নৃশংসভাবে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। তার হাত পা খুব অদ্ভুতভাবে মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে। লাশটির চারপাশে প্রচুর রক্ত। কাটা গলা থেকে খাদ্যনালী উচু হয়ে বেরিয়ে আছে। বৃদ্ধা মহিলাটি দোতলায় সিড়ির কোনায় কোরিডোরে হুইলচেয়ারে তখনও বসে রয়েছে। শান্ত ও নীরব, চোখেমুখে ভয়ের ছাপ এখনও কাটেনি।
গোয়েন্দাগিরির ব্যাসিক ধারনা থেকে খুনের সাসস্পেক্ট হিসেবে এই বিধবা মহিলাকে বাদ দেয়া খুব কঠিন কোন কাজ ছিলো না তার জন্য। একে তো মহিলা প্যারালাইজড, নড়তে চড়তে পারেন না। তারপরে আবার খুন হয়েছে নীচতলায়। দোতলা থেকে সিড়ি ভেঙে নিচে আসা তার একার পক্ষে অসম্ভব। সুতরাং যখন খুনের ঘটনা ঘটেছে, বৃদ্ধা সে সময় উপরেই ছিলেন। কয়েক বছর আগে তার স্বামীও নীচতলায় মারা গিয়েছিলেন। বৃদ্ধা ছিলেন উপরতলায়, আর তার স্বামী নীচতলায় সোফায় শুয়ে ছিলেন। আর ঘুমের মধ্যেই সাফোকেশন হয়ে মারা যান তিনি।
ডেভিড নিজের কাজ শুরু করলেন। প্রথমেই লাশের কিছু ছবি তুললেন। তারপর আশেপাশে এভিডেন্স খুজতে লাগলেন। সবশেষে লাশটিকে একটি সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। রুটিন বিজনেস। ততক্ষণে লাশের গাড়ি চলে এসেছে। ডেভিড নিচতলার ঘরগুলো সাবধানে চেক করতে শুরু করলেন। নিচতলার ইনভেস্টিগেশন শেষ করতে করতে লাশের গাড়ি চলে গেল। নাহ, সন্দেহজনক তেমন কিছু পাওয়া গেল না।
নিচতলা শেষে ডেভিড উপরতলায় যাওয়ার অনুমতি চাইলে বৃদ্ধা খানিকটা বাধা দিয়ে জানালেন, আজ সারাদিনই তিনি উপরে ছিলেন ও কেউ উপরতলায় আসে নি। কিন্তু নাছোড়বান্দা গোয়েন্দা ডেভিড সিড়ি দিয়ে উপরতলায় উঠে যেতেই একটু ইতস্ততভাবে সরে পথ করে দিলেন। ডেভিড বিষয়টা খুব স্বাভাবিকভাবেই নিলো। বয়স বেড়ে গেলে সবারই একটু আকটু নিজস্ব একটা জগৎ তৈরী হয়, যেখানে বাইরের কাউকে প্রবেশ করতে দিতে চায় না। হয়ত একদিন তারও এমনই হবে। কিন্তু গোয়েন্দাদের ওসব শুনলে চলবে কেন?
সিড়ি শেষে দোতলার কোরিডোর শুরু। কোরিডোরে প্রস্থ বরাবর পরপর লাগোয়া তিনটে রুমের বন্ধ দরজা। সন্তর্পনে প্রথম দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল সে, রুম ক্লিয়ার, বাথরুম ক্লিয়ার। পরের দরজায় – নাহ কিছু নেই। সবশেষে বৃদ্ধার বেডরুম। ডেভিডের মনে তখন একরাশ অশুভ চিন্তাভাবনা ভর করেছে। কোন আলামত নেই, তবুও মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে। এই অবস্থায় সে খুব সাবধানে ৩য় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। নাহ, অস্বাভাবিক কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দরজার পাশে ওয়ারড্রপ – ক্লিয়ার। সামনে পরিষ্কার গুছানো বিছানা, পাশে ছোট্ট একটা ল্যাম্প। সব ক্লিয়ার, কিছুই নেই সন্দেহ করার মত।
ব্যার্থ মনোরথে ফিরতে যাবে, এমন সময় সে হঠাৎ পাথরের মত নিশ্চল হয়ে গেল। বিষয়টা এমন নয় যে কিছু দেখেছে, আসলে সেটা এমন কিছু যা সে দেখতে পায় নি। নিজের অজান্তেই তার হাত কোমরে বাধা হোলস্টারে চলে গেল। এরপর পিস্তল হাতে নিয়ে দৌড়ে কোরিডোরে বেরিয়ে এল।
উপরতলায় কোন টেলিফোন নেই।
কোরিডোরে তখন শুধু পড়ে রয়েছে একটি হুইলচেয়ার।