সত্যজিৎ রায়ের খুব কাছের একজন বন্ধু- একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা, সমালোচক এবং ইতিহাসবিদ; সত্যজিতের সাথে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা চিদানন্দ দাশগুপ্ত- ১৯৫৭ সালে একবার বলেছিলেনঃ ‘ভারতের সব পরিচালকরা মিলে একত্রে যে ফ্যান্টাসি সিনেমা বানাবেন, সত্যজিতের পক্ষে একাই তার চেয়ে ভালো সিনেমা বানানো সম্ভব… আমি অবাক হব না যদি কোন একদিন সে অসাধারণ একটা কমেডি সিনেমাও বানিয়ে ফেলে।’
এরপর গুপী গাইন বাঘা বাইন বানাতে সত্যজিৎ সময় নিলেন আরও দশ বছর- ফ্যান্টাসি ঘরানায় তার সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাজ। অপু ট্রিলোজি থেকে চারুলতার মতো সিনেমা বানাতে গিয়ে এই প্রজেক্টে একটু দেরিই করে ফেলেছিলেন তিনি।
শিশুদের জন্য সিনেমা নির্মাণের কারণ
এই ঘরানায় সত্যজিতের আগ্রহ নতুন করে জন্মায় ১৯৬১ সালে, যখন পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর শতবার্ষিক উৎসবের সময় ঘনিয়ে আসছিল- ১৯৬৩ সালে। এই ১৯৬১-তেই তিনি পারিবারিক শিশুতোষ ম্যাগাজিন ‘সন্দেশ’ পুনরায় চালু করেন। পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীই ১৯১৫ সালে এই ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠা করেন, তিনিই এর গল্প লিখতেন আর ছবি আঁকতেন। গুপী বাঘাকে রূপালী পর্দায় আনার বুদ্ধিটা অবশ্য সত্যজিতের ছেলে সন্দ্বীপ রায়ের। তার মতে, বাবা কেবল বুড়োদের জন্যই সিনেমা বানায়, যার সবগুলোই দুঃখের।
চার পৃষ্ঠার মূল কাহিনিকে একশ বিশ মিনিটের স্ক্রিনপ্লেতে রূপান্তরিত করার পর, নানান পরিবর্তন আসে এর মাঝে। যেমন মূল কাহিনিতে বাঘা বোকাসোকা, আর গুপী চালাক। কিন্তু সিনেমায় এর ঠিক উল্টোটা দেখা যায়। একই অবস্থা দেখা যায় হাল্লা আর শুন্ডির রাজাদের মধ্যেও- মূল কাহিনিতে হাল্লার রাজা ভালো ছিল, শুন্ডির রাজা বিপথে চলে যায় তার অসাধু মন্ত্রীর কুমন্ত্রণায়।
যখন রাজ কাপুর গুপী গাইন বাঘা বাইন প্রযোজনা করতে চলেছিলেন
বাংলা সিনেমায় মন্দার সেই সময়টাতে; কালপুরুষ ও মহাপুরুষ, নায়ক আর চিড়িয়াখানা বক্স অফিসে তুলনামূলক উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছিল । ১৯৬৩ সালে মহানগর মুক্তি পাওয়ার পর, সত্যজিতের নিয়মিত প্রযোজক, আর.ডি. বনশাল হঠাৎ পিছিয়ে যান। সত্যজিতের নতুন প্রজেক্টে কাজ করার পুঁজি নেই তখন। তাই নিজের কল্পনার সাথে সমঝোতা করার অনিচ্ছাটাও এর উপর প্রভাব ফেলে- কারণ প্রযোজকরা চাইছেলেন গুপী আর বাঘার দুই রাজার মেয়ের সাথে বিয়েটাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে। কারণ গল্পে রোমান্টিকতা এলে টাকা আয় সহজ হবে।
সত্যজিৎ বোম্বেতেও অনেক প্রযোজকের সাথে যোগাযোগ করেন হিন্দিতে সিনেমাটা বানানোর জন্য, কিন্তু সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যায়। অনেকগুলো বড় নামের মধ্যে একজন ছিলেন রাজ কাপুর, যিনি সিনেমাটি প্রযোজনা করতে রাজি হন। তাই একটাই শর্ত ছিল; গুপীর চরিত্রটা করবে পৃথ্বীরাজ কাপুর আর বাঘা হবে শশী কাপুর। বলাই বাহুল্য যে, সত্যজিতের না করার কোন কারণ ছিল না।
১৯৬৭ সালে ক্রিসমাসের সময়টাতে নেপাল আর অসীম দত্ত আসেন ফিল্মটার বাজেট নিয়ে। বাজেট ছিল শুধু সাদকালো সিনেমার জন্য। মজার ব্যাপার হলো, সিনেমার শেষ দৃশ্য রঙ্গিন ছিল। এজন্য ধন্যবাদ দিতে হয় সন্দ্বীপ রায়কে। ‘রঙ্গিন দৃশ্যের ব্যাপারটা আমার মাথা থেকে এসেছে! আমি কেবলই ভাবতাম, রঙ্গিন হলে কী অসাধারণই না হবে দৃশ্যটা। আমার ব্যাখ্যাটা ছিল, রাজকন্যা- যে কিনা দুইজনের দিকে তাকাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, রঙ্গিন হলে তাদের দিকে না তাকিয়ে সে যাবে কোথায়!’
অভিনেতা বাছাইয়ের যুদ্ধ
সময়ের সাথে সাথে অভিনেতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও অনেক পরিবর্তন আসে। ১৯৬২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘অভিযান’ সিনেমায় চমৎকার কাজ দেখানো রবি ঘোষকে সত্যজিৎ বাঘা চরিত্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বাছাই করে নেন। ১৯৬২ সালে সত্যজিতের সিনেমা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘাতে’ কাজ করা অরুণ মুখার্জিকে প্রাথমিকভাবে গুপী চরিত্রের জন্য নির্বাচিত করা হয়। সিনেমার কাজ শুরু হতে দেরী হয়, এর মধ্যে সত্যজিৎ কিশোর কুমারের কাছে গুপী চরিত্র করার প্রস্তাব নিয়ে যান- একই সাথে গুপীর গানগুলোও গাইবেন তিনি। কিন্তু সময় না মেলার কারণে না করে দিতে বাধ্য হন কিশোর কুমার। পরবর্তীতে অনুপ ঘোষাল গুপীর গানগুলো করেন- আর রাতারাতি বাংলার নতুন সেনসেশন বনে যান। পরবর্তীতে জীবনলাল বন্দোপধ্যায়কে এই চরিত্রের জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়। অবশেষে, ঘুরেফিরে তপেন চ্যাটার্জির কাছে আসে গুপীর চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগটা। তিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের অ্য্যাডভার্টাইজিং বিভাগে কর্মরত। হাল্লা আর শুন্ডির রাজা হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের প্রথম পছন্দ ছিলেন ছবি বিশ্বাস। আর কুটিল মন্ত্রী হিসেবে অভিনয় করার কথা ছিল তুলসি চক্রবর্তীর। কিন্তু দুইজনেই মৃত্যুবরণ করায় পরবর্তীতে সন্তোষ দত্ত আর জহর রায় যথাক্রমে চরিত্র দুটিতে অভিনয় করেন।
গুপী বাঘার সাংস্কৃতিক অবদান
গুপী গাইন বাঘা বাইন দেশ বিদেশের সীমানা ছাড়িয়ে অসাধারণ এক সাংস্কৃতিক অবদান রেখেছে। ১৯৯১ সালে ‘ইমাজিনারি হোমল্যান্ড’ বইটিতে সালমান রুশদী সত্যজিতের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার উপন্যাস ‘হারুন অ্যান্ড দ্য সী অফ স্টোরিজ’-এ, দুটো কাল্পনিক প্লেন্টিমো মাছ, যারা ছড়া কেটে কথা বলতো- তাদের নাম ছিল গুপী আর বাঘা।
আরো পড়ুন- ৮ হরর মুভির গল্প- লেখাটি দুর্বল চিত্তের পাঠকদের জন্য নয়
আরও কাছাকাছি খেয়াল করি এবারে। রনবীর কাপুর অভিনীত জাজ্ঞা জাসুস নামের সিনেমায় দেখা যায়, আকাশ থেকে জাজ্ঞা কেক ফেলছে- উদ্দেশ্য হলো যুদ্ধ থামানো। একই দৃশ্য দেখা যায় গুপী গাইন বাঘা বাইনেও। দুই বন্ধু মিলে গান গেয়েই চলেছিল তারা, যতক্ষণ না আকাশ থেকে রাজভোগ আর রসগোল্লা পড়া শুরু হয়েছিল- ক্ষুধার্থ সৈনিকরা এতে যুদ্ধ বন্ধ করে। জাজ্ঞা নিজের পালক পিতার খোঁজে কাল্পনিক শুন্ডি রাজ্যেও গিয়েছিল।
বক্স অফিসে মন্দা আর সত্যজিতের আত্মপক্ষ সমর্থন
প্রথম মুক্তি পেয়ে বক্স অফিসে তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি গুপী গাইন বাঘা বাইন। সমালোচকরা তো সত্যজিতের দোষ বের করার কোন সুযোগই ছাড়েনি। নিজের একটি রচনায় সত্যজিৎ এই কথা উল্লেখও করেছেনঃ রিফ্লেকশান অভ সিনেমা, ‘প্রথমত, তথাকথিত সূক্ষ্ম-নির্ণায়করা, সমালোচকরা আমার সিনেমা গুপী গাইন বাঘা বাইন সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। এক্ষেত্রে পরিচালকের বক্স অফিসের সাথে বিরোধিতা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়। আর এটা এমন একটা সিনেমা যেটা আগে কখনো হয়নি, বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একেবারে আনকোরা নতুন। আর এমন একটা কাহিনি নিয়ে বানানো হয়েছে এটি, যার রচয়িতা শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো জনপ্রিয় কোন লেখকও না। আবার বড় তারকাদের নিয়ে বানানো সিনেমাও ছিল না এটি, পুরোপুরি অপরিচিত শিল্পীদের কাস্ট করা হয়েছে- এমনকি সিনেমার মূল চরিত্র গুপী আর বাঘাও। প্রথমবারের মতো অবাস্তব নাচ দেখানো হয়েছে স্ক্রিনে, গানটা ছিল দক্ষিণ ভারতের অপরিচিত একটি সুরের প্রায় সাত মিনিট লম্বা বিমূর্ত সংস্করণ। আর সবশেষে কোন রোমান্স নেই এই সিনেমাতে, নেই কোন সস্তা ভাবের কথা। মাত্র দুটি নারী চরিত্র ছিল এতে, যারা একেবারে শেষ দৃশ্যে কেবল পাঁচ মিনিটের জন্য পর্দায় দেখা দিয়েছিলেন। আর কতটা সূক্ষ্ম হতে চান?’
আস্তে আস্তে গুপী গাইন বাঘা বাইন জনপ্রিয় হতে শুরু করে। একটা সময় গিয়ে সত্যজিতের সবচেয়ে বড় বক্স অফিস হিট হয় এই সিনেমাই। এই সিনেমার একটা মজার দিক হলো, রাজভোগের বিক্রি বেড়ে যায় এর পরপরই। গুপী গাইন বাঘা বাইন মুক্তি পাওয়ার পর, কলকাতার মিষ্টির দোকানের শোকেসে রাজভোগকে মিষ্টির রাজা হিসেবে সাজিয়ে রাখা হয়- যে মিষ্টি যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছিল, যার মূল্য ছিল এক রুপী।
সত্যজিৎ নিজে সিনেমাটা নিয়ে খুব সন্তুষ্ট ছিলেন। আর এর সাফল্য তার নিজের এবং বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির জন্য খুব ফলপ্রসূ ছিল। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে মেরী সেটোনকে লেখা একটি চিঠিতে সত্যজিৎ লেখেন, ‘ফিল্মটা নিয়ে খুব খুশী আমি, অবশ্য এর দ্বিতীয় অংশের অনেক ধারণাই সাধারণ রীতিবিরুদ্ধ যা বেশিরভাগ দর্শকের পছন্দ না-ও হতে পারে। কিন্তু শেষের বিশ মিনিট এতটাই আনন্দে আর সরলতায় ভরপুর যে, সবাই এতেই সন্তুষ্ট হয়ে যাবে বোধকরি।’ এরপর ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে, আরেকটা চিঠির পুনশ্চে তিনি লেখেন, ‘তোমাকে বলেছি নাকি ডিসেম্বরে নামিয়ে ফেলার আগ পর্যন্ত গুপী সবচেয়ে বেশি চলার (সাড়ে আট মাস) রেকর্ডটা পেয়েছে?’
লেখিকা সম্পর্কে- সেঁজুতি রোশনাই। লেখক ও অনুবাদক।
আরো পড়ুন-