দোস্ত, তোর মনে আছে আমরা যে ক্লাস শেষে সবকটা মিলে কত খাওয়া দাওয়া করতাম আমাদের ভার্সিটির এই রেস্টুরেন্ট টায়। মনে আছে তোর?
– হুম(মোবাইলের দিকে তাকিয়ে)
আজ সবগুলা থাকলে মজা হত, নারে??
– হু হু, (আবারও নিবদ্ধিত দৃষ্টি মোবাইল এর দিকে)
কিরে!! তুই তোর মোবাইল নিয়ে পড়ে আছি। আমি যে তোকে কিছু বলছি, শুনছিস?
– হ্যাঁরে বাবা! দাঁড়া। চেক ইন দিচ্ছি।
এটা তো পরে করলেও পারিস। আজকে কত কথা বলব তোর সাথে ভেবেছিলাম। দোস্ত শুন না…
– আরেহ এই দেখ , কতগুলা লাইক পড়ছে। যেগুলা আসে না দেখ কান্নার ইমো দিচ্ছে। হা হা…
ঠিক আছে তুই থাক তোর লাইক নিয়ে আর ইমো নিয়ে। আমি চললাম। (ভীষণ মন খারাপ হয়ে)
– আরে, দোস্ত শুন। আজ তো তোর খাওয়ানোর কথা ছিল। আরে শুন…
আপনি আপনার খুবই কাছের একজন বন্ধুর সাথে খেতে গিয়েছেন, আড্ডা দেয়া ও তার কথা শোনা ও নিজের কথা বলতে। কিন্তু আপনি অবাক হলেন ও দেখলেন যে আপনার বন্ধুটি তার তার আইফোন এর দিকে তার চোখ দুটি আঠার মতো লাগিয়ে রেখেছে এবং যতক্ষণই আপনি তার সাথে কথা বলছেন ততক্ষণই আপনার প্রতি তার প্রতিক্রিয়া খুবই স্বল্প। এটা আপনি যদি আপনার আশেপাশেও তাকান একই ঘটনাই দেখতে পাবেন। আপনার খুবই বিরক্ত লাগবে এবং দ্রুতই আপনার খাওয়া শেষ করবেন এবং এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে চাইবেন। আপনি ভাববেন ‘আমি এতটা খারাপ নই’, এবং বাড়ি ফিরে আপনি নিজেও শুধু ১৫ মিনিট পর পর আপনার ফেসবুক একাউন্ট চেক করবেন।
আমাদের বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোর থেকে কি ভার্চুয়াল জীবনের সম্পর্কগুলো অধিক গুরুত্বপূর্ণ? আমরা সামাজিক মাধ্যমে আটকে আছি এবং এই প্রবণতা যেকোনো সময়ই শীঘ্রই বন্ধ হবে না। সামাজিক মাধ্যম কিছু কিছু ক্ষেত্রে খুবই উপকারী, মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখা, বিভিন্ন ধরনের আইডিয়া শেয়ার করা, এমনকি বিভিন্ন তথ্য পেতে সাহায্য করে যা সহজে পাওয়া অনেক সময় কষ্টসাধ্য হয়। কিন্তু এর সীমারেখা কোথায়? এটা চিন্তার বিষয় ও বিবেচনার বিষয়, কিন্তু আমরা কি ভাবি এ বিষয়ে যে এসব টুইটিং এবং ফেসবুকিং এর কারণে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা কি হচ্ছে?
মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে অন্যান্য মানুষের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখতে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে ফেসবুক আসলে মানুষকে আরও একা করে দেয়। এমনকি মানুষের দুশ্চিন্তা ও হতাশা বাড়ে। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করাতে বিষণ্ণতা দেখা দেয়। সামাজিক মাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করাতে দেখা যায় যে অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের প্রতি মনোযোগ কমে যায়, মানসিক চাপ বাড়ে। আর যারা পূর্বেই বিষণ্ণতায় ভুগছে , সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক বা টুইটারে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার ফলে বিষণ্ণতার মাত্রা আরও বেশী বেড়ে যায়। এছাড়া হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিরা ও যারা নিজের কাজ বা নিজের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত, তারা অন্যের পোস্ট দেখে আরও বেশী বিষণ্ণতায় ভুগতে পারে বা মানসিক চাপের সৃষ্টি হতে পারে।
একবার যদি আপনি ফেসবুক ব্যবহার করেন, তো এটা বন্ধ করা খুবই কঠিন। লাইক এবং কমেন্ট ইতিবাচক মনোভাব বা ইতিবাচক অনুভূতির সৃষ্টি করে কিন্তু দিনে সারাক্ষণই এটার ব্যবহার বন্ধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। যদি এটা বার বার বা দিন ১৫ মিনিট পর পর চেক করার প্রবণতা দেখা দেয়। অর্থাৎ যদি এর ব্যবহার আসক্তির পর্যায়ে চলে যায়।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বেশী ফেসবুক ব্যবহার করা তারা বেশী অসুখী যারা কম ফেসবুক ব্যবহার করে তাদের তুলনায়। এটার কারণ হতে পারে যে মানুষ প্রায়ই তাদের বাস্তব জীবনকে তুলনা করে তাদের ভার্চুয়াল জগতের বন্ধুদের জীবনের সাথে। যেহেতু মানুষ সবসময়ই হাসিখুসির ছবি অনেক বেশী পোস্ট করে। আর বাইরের অবস্থা দেখে তো মনের ভিতরের অবস্থা বোঝা সম্ভব নয়।
যারা ফেসবুক বা টুইটার ব্যবহারে অভ্যস্ত তারা যদি একবার নিজের একাউন্টে প্রবেশ করতে না পারেন তবে তাদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। এটা বিশেষ ঝামেলাপূর্ণ কারণ এর মানে যে ফেসবুক আর টুইটার মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলছে এমনকি যখন তারা অফলাইনে থাকছেন।
কোন সন্দেহ নেই যে, সমাজিক মাধ্যম অনেক উপকারী। আপনি আপনার আনন্দময় মুহূর্ত ও ছবি এবং জীবনের গল্প শেয়ার করতে পারেন। আপনি সব ধরনের তথ্য পেতে পারেন। এটা সত্যিই চমৎকার ব্যপার। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো না। একটা সময় আমরা নিজেরাই হয়ত এড়িয়ে চলতে চাইব।
সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার মানুষের কল্পনাশক্তি কমিয়ে দেয়। যখন মানুষের কিছু করার থাকে না, তখন কল্পনার মাধ্যমে নিজেদের বিনোদিত করা সম্ভব যা অতীতে হত ও এটা খুবই সচরাচর ব্যাপার ছিল। কিন্তু বর্তমানে মানুষ যখনই বিরক্ত অনুভব করে সোজা সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক বা টুইটারে সময় ব্যয় করে। এটা আরও বিরক্তিকর অনুভূতির সৃষ্টি করে কিন্তু তবুও এটাতে সময় ব্যয় করা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়। এতে করে বেশীরভাগ সময় নিজস্ব চিন্তা কাজ করে না, অন্যের চিন্তা দ্বারা বেশী প্রভাবিত হয়। এবং এর ফলে নিজস্বতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
গবেষণায় দেখা গেছে যার সামাজিক মাধ্যমে অনেক বেশী ছবি পোস্ট করে, তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা অনেক কম থাকে। যাদের ব্যক্তিগত সম্পর অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারীরা তাদের ছবি পোস্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকে, যারা তাদের ঈর্ষা করে তাদের দেখানোর জন্য।
মানুষ প্রায়ই ফেসবুক একটি উপায় হিসেবে ব্যবহার করে তাদের সত্যিকারের অসুবিধা বা সমস্যাগুলো এড়িয়ে চলার জন্য। এই সামাজিক মাধ্যমগুলো এমন এক ধরনের বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে এর উপর থেকে নির্ভরতা কমানো কঠিন হয়ে যায়। এর চেয়ে বেশী আর কি হতে পারে, মানুষ এই মাধ্যম ব্যবহার করে সত্যিকারের সামাজিক সম্পর্কগুলো এড়িয়ে চলার একটি পদ্ধতি হিসেবে এবং অনেক বেশী একা হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত।
সব মিলিয়ে , যদি খারাপ উদ্দেশ্যে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করা হয় তবে এটা ব্যক্তির উপর খারাপ প্রভাব ফেলবে। এই খারাপ প্রভাব পড়বে ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির যোগাযোগের, সম্পর্কের উপর।