“ব্রাজিল ফুটবলের সাথে খায়, ফুটবলের সাথে ঘুমায় এবং পান করে, ফুটবলই তাঁদের জীবন!”-পেলে।
ফুটবলের প্রতি আসক্ত এক জাতির নাম ব্রাজিল। অনেকের মতে ফুটবলের আবির্ভাবই হয়েছে ব্রাজিলিয়ানদের পায়ে এর জাদুর ছোঁয়া পাওয়ার জন্যে। সেই ব্রাজিল এর সামনে আজ গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ “বিশ্বকাপ ২০১৮”, আর তাঁদের একটাই লক্ষ্য-“মিশন হেক্সা”। দেখা যাক এই দৌড়ে কতদূর এগিয়ে আছে সেলেকাওরা।
গতবারের বিশ্বকাপ ছিল নিজেদের মাটিতে। যে দেশের অলিতে-গলিতে বল নিয়ে কাড়ি কুড়ি করে বড় হয়েছে নেইমার, অস্কার, মার্সেলো, আলভেজরা সেই দেশের মাটিতে বিশ্বকাপের ট্রফি উঁচিয়ে ধরার সুযোগও ছিল। অসাধারণ পারফর্মেন্স নিয়ে সেমি-ফাইনালে উঠেছিল তাঁরা। কিন্তু মনোবল ছিল কিছুটা দুর্বল, কারণ দলের মূল প্রাণ ভোমরা নেইমার যে ইনজুরির কারণে ছিটকে পড়েছে দল থেকে, অধিনায়ক সিলভাও খেলতে পারছেন না হলুদ কার্ডের মার-প্যাচের জন্য। আর সেই সুযোগটাই নিল দুর্ধর্ষ জার্মানি দল, বলা যায় একপ্রকার গুড়িয়ে দিল ব্রাজিল দলকে। স্কোর লাইন খেলা শেষে (ব্রাজিল) ১ -৭ (জার্মানি)। ব্রাজিলের মতন এমন টিমের এরূপ ধসে যাওয়া মেনে নিতে পারেনি সমর্থকরা, এমনকি খোদ রাইভালরাও। এরপর নেদারল্যান্ড এর সাথে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচের ৩-০ তে হার যেন ব্রাজিলকে কোমায় নিয়ে গিয়েছিল।
এরপরও ঘুরে দাঁড়িয়েছে ব্রাজিল ফুটবল দল, কোচ টিটে তাঁর জিয়ন কাঠির ছোঁয়ায় আবার জীবন্ত করেছেন,সেই ব্রাজিলকে যে ব্রাজিলকে দেখে পুরো পৃথিবী মেতেছিল ফুটবলের নেশায়। ২০১৮ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের নড়বড়ে অবস্থার কারণে বরখাস্ত হলেন কোচ ডুঙ্গা, তাঁর বদলি হিসেবে দলের দায়িত্ব পেলেন টিটে। কোচিং স্টাইল অনেকটা পূর্ববর্তী কোচ ডুঙ্গা ও স্কলারির মতন হলেও, অনেকের মতে তিনি পেরেছেন ব্রাজিলিয়ান স্কোয়াডের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিতে। তাঁর নিয়োগের পর থেকে একের পর এক সাফল্যের মাধ্যমে চূড়ান্ত করেছেন,ল্যাটিন আমেরিকার প্রথম দল হিসেবে রাশিয়ার ২০১৮ বিশ্বকাপের টিকিট। অনেকের মতে ২০১৪’র বিশ্বকাপের ব্রাজিলের সুপারস্টার নেইমারের অনুপস্থিতিতে ৭-১ ব্যবধানে হারতে হয়েছিল ব্রাজিলকে, কারণ তখন দলের মূল শক্তি হিসেবে বিবেচিত হত নেইমার। প্যারিস সেন্ট জার্মেইনের এই ফরোয়ার্ড বর্তমানেও পায়ের আঘাতের কারণে মাঠের বাইরে আছেন, তবে বর্তমান ব্রাজিল হয়তো তাদের অধিনায়ক ছাড়াও এই সময়টা ভালভাবে মোকাবেলা করতে পারবে। এর মূল কারণ কোচ টিটে নেইমারের উপর দলের নির্ভরতা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছেন। তৈরি করেছেন স্ট্রং ফরোয়ার্ড লাইন, দলে রয়েছে অনেক প্রতিভাবান তরুণ খেলোয়াড়। এসব পরিবর্তনের কারণেই বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের ১৮টি ম্যাচের ১২টি তেই জয় লাভ করেছে ব্রাজিল। ড্র ৫টিতে আর হার মাত্র ১টিতে। বুঝাই যাচ্ছে এবারের ব্রাজিল দল কিরূপ শক্তিমত্তা নিয়ে বিশ্বকাপের আসরে যাচ্ছে।
বাছাই পর্বে ব্রাজিলের করা সবগুলো গোল দেখতে এখানে ক্লিক করুন
এক নজরে দেখে নেয়া যাক বিশ্বকাপে অংশ নেয়া ব্রাজিল দলটিকে-
দল: ব্রাজিল
ডাক নাম: সেলেকাও( দ্যা গ্রীন এন্ড ইয়লো)
অধিনায়ক: নেইমার জুনিয়র
ম্যানেজার: টিটে
ফিফা র্যাংকিং: ২য়
গোলকিপার: এলিসন বেকার(রোমা), এডার্সন মোরস(ম্যান সিটি), ক্যাসিও রামোস(করিন্থিয়াস)
ডিফেন্ডার: মার্সেলো ভিয়েরা(রিয়াল), দানিলো লুইজ(ম্যান সিটি), ফ্যাগনার লেমোস(করিন্থিয়াস), জোয়াও মিরান্ডা(ইন্টার মিলান), থিয়াগো সিলভা(পিএসজি), মারকুইনহোস(পিএসজি), পেড্রো জেরোমেল(গ্রেমিও), ফিলিপে লুইস(এথলেটিকও)
মিডফিল্ডার: পাউলিনহো বেজেরা(বার্সা), রেনাতো অগাস্তো(বেইজিং), ফিলিপে কৌটিনহো(বার্সা), ফ্রেড(ম্যান ইউনাইটেড), ফার্নান্দিনহো লুইজ(ম্যান সিটি),কার্লোস ক্যাসেমিরো(রিয়াল)
ফরওয়ার্ড: নেইমার জুনিয়র(পিএসজি), উইলিয়ান দা সিলভা(চেলসি), গ্যাব্রিয়েল জেসাস(ম্যান সিটি), ডগলাস কস্তা(জুভেন্টাস), রবার্তো ফিরমিনো(লিভারপুল), টাইসন ফ্রেডা(শাখতার)
এবার দেখা যাক মূল একাদশে কারা জায়গা করে নিতে পারে।
কোচ টিটের এবারের দলকে সাজিয়েছেন প্রথাগতভাবে ৪-৩-৩ ফোর্মেশনে। এবারের ব্রাজিলের গোলবার সামলানোর দায়িত্ব পেয়েছেন রোমার গোলকিপার এলিসন বেকার। চ্যাম্পিয়ন্স লীগ এবং সিরিআ তে অসাধারণ পারফর্মেন্স দেখানো রোমার এই গোলকিপার বিশ্বকাপে তাঁর ঝলক দেখানোর জন্যে প্রস্তুত। রাইট ব্যাকে থাকতে পারেন ম্যানসিটির হয়ে ইপিএল জেতা দানিলো। সেন্টার ব্যাকে থাকবেন পিএসজির খেলোয়াড় থিয়াগো সিলভার এবং ইন্টার মিলানের অভিজ্ঞ জোয়াও মিরান্ডা। লেফট ব্যাকে খেলবেন বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার। রিয়ালের হয়ে হ্যাট্রিক শিরোপা জেতা মার্সেলো। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডে যার উপর ভরসা কোচ টিটের তিনিও বর্তমানে তার জায়গায় অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচিত, রিয়ালের ক্যাসেমিরো। সেন্ট্রাল মিডফিল্ড দাপিয়ে বেড়ানোর জন্যে প্রস্তুত দুই বার্সা সতীর্থ পাউলিনহো ও ফিলিপে কৌটিনহো। ক্লাব পর্যায়ে দুজনের মধ্যকার রসায়ন ব্রাজিল দলের উপর ভালো প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা যায়। রাইট উইং এ খেলতে পারেন চেলসির উইলিয়ান। অথবা তাঁর জায়গায় দেখা যেতে পারে লিভারপুলের হয়ে অসাধরন মৌসুম কাটানো ফিরমিনোকে। স্ট্রাইকার হিসেবে মোটামুটিভাবে খেলবেন নিশ্চিত বলা যায় ম্যানসিটির উদীয়মান তারকা গ্যাব্রিয়েল জেসাস। আর লেফট উইংয়ে দায়িত্ব সামলাবেন অধিনায়ক নেইমার জুনিয়র। দলের রিজার্ভ সাইটের দিকে যদি দেখি আমরা, তাহলে ভালো একটা ব্যাক-আপ আমাদের চোখে পড়বে।
মোটামোটি একটা গোছানো দল দাঁড়া করাতে পেরেছেন কোচ টিটে। তরুণ খেলোয়াড়রা তো আছেই সাথে অভিজ্ঞদের মিশেল করেছেন তিনি। কিন্তু এই দলেও জায়গা হয়নি অনেক প্লেয়াদের, যাদের অনেকেই দাবি রাখেন বিশ্বকাপ খেলার। দলে জায়গা করে নিতে পারেনি ডিয়েগো আলভেসের মতন গোলকিপার। ইনজুরির কারণে শেষ হয়ে গেছে পিএসজির দানি আলভেসের বিশ্বকাপ স্বপ্ন। বাজে ফর্মের কারণে দলে জায়গা হয় নি চেলসি ডিফেন্ডার ডেভিড লুইজেরও। জায়গা হয় নি জুভেন্টাস লেফট ব্যাক এলেক্স সান্দ্রোর। এছাড়া দল থেকে বাদ পড়েছেন মার্শেই মিডফিল্ডার লুইজ গুস্তাভো, মিডফিল্ডার ফ্যাবিনহো ও বেসিকতাস ফরওয়ার্ড এন্ডারসন টালিস্কা।
এবারের ব্রাজিলের গ্রুপ “ই”, এই গ্রুপে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ হিসেবে থাকছে, সার্বিয়া,সুইজারল্যান্ড,কোস্টারিকা। বলা যায় বেশ সহজ প্রতিপক্ষ। কোনরূপ অঘটন না ঘটলে খুব সহজভাবেই ব্রাজিলকে দেখা যাবে রাউন্ড অফ সিক্সটিন এ।
ব্রাজিল বনাম সুইজারল্যান্ড, রবিবার ১৭জুন
ব্রাজিল বনাম কোস্টারিকা, শুক্রবার ২২শে জুন
সার্বিয়া বনাম ব্রাজিল, বুধবার ২৭শে জুন
ব্রাজিল দলের স্ট্রং পয়েন্ট
এবারের ব্রাজিল দলের বেশিরভাগ সদস্যই বয়সে তরুণ, আর এই তারুণ্য নির্ভর দল নিয়েই এবারের মিশন হেক্সা সফল করতে চাচ্ছেন কোচ টিটে। দলের সবচেয় মূল আকর্ষণ হিসেবে থাকবে, পিএসজির নেইমার জুনিয়র। সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, নেইমার লেফট উইং থেকে তার আক্রমণ রচনা করবে । বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই ফুটবলার নিশ্চয়ই তার ভক্তদের প্রত্যাশা পূরণ করবে এই বিশ্বকাপে। নেইমার চাইবে এবারের বিশ্বকাপে যাতে আরও ভাল সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, যাতে করে লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে টপকে এবারে ব্যালোন ডি’অর জয় করতে পারেন, যা ছিল সবসময়ই নেইমারের চূড়ান্ত লক্ষ্য।দলের মূল স্ট্রাইকারের জায়গাটির যোগ্যতম দাবিদার হলেন গ্যাব্রিয়েল জেসাস। ব্রাজিলের হয়ে কোয়ালিফাইং এ ৮গোল করা এই তরুণ স্ট্রাইকার তাঁর তীক্ষ্ণ নজর আর ক্ষিপ্রতা দিয়ে সহজেই গোল আদায় করতে পারে।ইনজুরির কারণে এবারে লীগে তার ফর্ম কিছুটা আপ-ডাউন করলেও, ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে ২৮ম্যাচে ১৫ গোল ,তাঁর প্রতিভারই ঝলক দেখায়। রবার্টও ফিরমিনো জেসাস এর মতনই ভাল ফর্মে আছেন, তবে তিনি মূল একাদশে নিয়মিত জায়গা করে নিতে নাও পারেন। মধ্যমাঠে তিন রত্ন হিসেবেই বলা যায় ক্যাসিমিরো, পোউলিনহো আর কৌটিনহো এদেরকে। বার্সাতে একসাথে খেলা পোউলিনহো এবং কৌটিনহো সামলাবেন মধ্যমাঠ আর ডিফেন্সিভ মিডের কাজটা করবেন হ্যাট্রিক ইউসিএল জয়ী ক্যাসিমিরো। নজর থাকবে দুর্দান্ত ক্লাব এবং ন্যাশনাল মৌসুম কাটানো কিপার এলিসন বেকারের। দলের ডিফেন্সের মূল ভরসা বলা যায় মার্সেলোকে। এই ডিফেন্ডার কি করতে পারেন মাঠে, তা পুরো সিজন জুড়েই আমরা দেখেছি।
গত ছয়মাসে যে দ্রুতগতির ব্রাজিলকে আমরা দেখতে পেরেছি তাঁর পিছনে অন্যতম কারিগর কোচ টিটে। তাঁর অধীনে বেশ কয়েক মাস ধরে সেরা ফুটবলটা খেলেছে ব্রাজিল। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর নাটকীয়ভাবে দল প্রথম ন’টা ম্যাচে জিতল। দলের প্লেয়ারদের এবিলিটি অনুসারে তাদেরকে যোগ্য পজিশনে খেলানোতে পারদর্শী তিনি। এছাড়া তিনি যেভাবে দল ঘোষণা করেছেন, তাতে যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো ফোর্মেশনে তিনি তাঁর দলকে খেলাতে পারবেন। তাঁর সাফল্যের অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করছে, তিনি ব্রাজিলিয়ানদেরকে সেভাবেই খেলতে দেন, যেভাবে তাঁরা খেলে বড় হয়েছে। সুতরাং বলাই যায়, এবারের বিশ্বকাপে আমরা সেই পুরনো সাম্বার তালের ব্রাজিল দলকে দেখতে পাবো।
ব্রাজিল দলের উইক পয়েন্ট
যদি সত্যি করে বলি, এই ব্রাজিল দলের দুর্বলতা খুঁজে বের করা সত্যিই অনেক কঠিন। দলের ফার্স্ট লাইন ডিফেন্স থেকে নাম্বার ৯ (প্রথাগত স্টাইকার) সবখানেই পৃথিবীর অন্যতম সেরা প্লেয়াররাই খেলছে। রিজার্ভ বেঞ্চও যথেষ্ট সমৃধ। দলে কোন ইনজুরি প্রব্লেম,নেই কোন অন্ত-কোন্দল। সবারই মোটামোটি একই লক্ষ্য, আরেকটি বিশ্বকাপ দেশকে উপহার দেওয়া। তবে এজন্যে দলকে থাকবে হবে স্ট্রিক্ট, গতবারের মতন আবেগকে প্রাধান্য দিলে হয়তো তাঁদের দুর্বলতা বের হয়ে আসবে প্রতিপক্ষের সামনে। দলের যার যার যেটুকুন দায়িত্ব তা যদি ঠিকভাবে পালন করতে পারে তাহলে, ফাইনালে খেলা অসম্ভব কিছুনা।
ব্রাজিলের সর্বকালের সেরা দল মানা হয় ১৯৭০ এর যে দলটাকে, সেই দলের সাথে অনেকেই এবারের ব্রাজিল দলকে মিলাতে পারছেন। নিঃসন্দেহে বলা যায়, বর্তমান ব্রাজিল দল যেকোনো দলের জন্য হুমকিস্বরুপ। একসাথে অনেকদিন থাকার কারণে দলের ভারসাম্য অক্ষুণ্ণ আছে এখনো। সুতরাং বলাই যায় এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম হট ফেভারিট বারজিল। দেখা যাক, ৬ষ্ঠ বারের মতন বিশ্বকাপের স্বাদ নিতে পারে নাকি নেইমাররা!
সমগ্র বিশ্ব অধীর আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছে “রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮”র জন্যে। আর কিছুদিন পরই পর্দা উঠতে যাচ্ছে বিশ্বের সবথেকে জনপ্রিয় এই আসরের। ধারাবাহিকভাবে বিশ্বকাপের আরো বিভিন্ন দলকে নিয়ে ফিচার আসবে সামনে। পর্ব আকারে সবগুলো লেখা পাবেন, “Bangla Hub”-সাইটে।
আগের পর্ব পড়ুন এখানেঃ
রাশিয়া বিশ্বকাপ : ফুটবল এখন তুযারশুভ্র দেশ “রাশিয়ার” পথে (পর্ব :১)