“Hope is a good thing,
Maybe the best things,
And no good thing ever dies”
রাশিয়া বিশ্বকাপের এখন পর্যন্ত সবচেয় রুদ্ধশ্বাস ম্যাচটি বুঝি গতকাল রাতেই আমরা উপভোগ করলাম। অদম্য ইচ্ছাশক্তি নাকি স্রেফ ভাগ্যের জোর! ঠিক কিসের উপর ভর করে আর্জেন্টিনা এবারের আসরের গ্রুপ পর্ব উতরাতে পেরেছে তা বলা মুশকিল। তবে সব কথার শেষ কথা, আর্জেন্টিনা পেরেছে। ভুল বললাম, মেসি পেরেছে!
আর্জেন্টিনা দলের এবারের বিশ্বকাপের পারফর্মেন্স নিয়ে আর কিছু বলা প্রয়োজন মনে করছি না। দলের মূল একাদশ যেখানে এখনো স্টেবল না, সেই দলকে আর যাইহোক লম্বা রেসের ঘোড়া বলা চলে না। নবাগত আইসল্যান্ডের সাথে ড্র এর পর ক্রোয়েশিয়া তো স্রেফ উড়িয়ে দিল “হোয়াইট এন্ড স্কাই ব্লু”দের। এর ফলে জটিল হয়ে পড়ে আর্জেন্টিনার পরবর্তী রাউন্ডে উঠার সমীকরণ। ৬পয়েন্ট নিয়ে ক্রোয়েশিয়া মোটামোটি রাউন্ড অফ সিক্সটিন নিশ্চিত করলেও, বাকী ৩টি দলের ভাগ্য ঝুলে ছিল গত দিনের উপর। আর্জেন্টিনার জন্যে হিসাব ছিল এমন, নাইজেরিয়ার সাথে জয় তাদের ছিনিয়ে আনতেই হবে। আর এর সাথে সাথে নজর রাখতে হবে আইসল্যান্ড -ক্রোয়েশিয়ার মধ্যকার ম্যাচের উপর। সেখানে যদি কোনভাবে যদি আইসল্যান্ড জিতে যায় তাহলে, সামনে আসবে গোল ডিফারেন্স। যেখানে আর্জেন্টিনার জন্যে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে মাইনাস থ্রি (-৩) কে প্লাস এ পরিণত করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। কিন্তু এই সকল হিসাব-কিতাব নিজেদের করেই আর্জেন্টিনা পরবর্তী রাউন্ডে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে।
এবার দেখা যাক এই ম্যাচের লাইন আর কেমন ছিল। আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়ার ম্যাচে খেলানো মূল একাদশ থেকে মোট চারটি পরিবর্তন আনেন কোচ স্যাম্পাউলি। ক্যারিয়ারের সবথেকে বাজে পারফর্মেন্স গত ম্যাচে দেখানো গোলকিপার উইলিয়াম কাবায়ো যথারীতি বাদ পরেন। তার স্থলে গোলবার সামলানোর দায়িত্ব পান আরমানি। আর্জেন্টাইন লিগে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা এই কিপারের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে অনেকেই চিন্তিত ছিল। আর থাকবেই বা না কেন, জাতীয় দলের হয়ে অভিষেকটাও যে গতকালই হলো তার। ডিফেন্সে যোগ হয়েছিল রোহো। একুনা আর স্যাল্ভিও কে বসিয়ে এদিন ডি-মারিয়া আর বানেগা কে মধ্যমাঠ সামলানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রথম ম্যাচে গোল করা আগুয়েরো কে বসিয়ে এদিন মেসির সাথে আক্রমণ ভাগ সামলান হিগুয়েন।
গতকাল প্রথাগত ফর্মেশন ৩-৪-৩ এ না খেলিয়ে দলকে ৪-৪-২ তে সাজান কোচ। কারণ গোল করার পাশাপাশি এদিন গোল না খাওয়াও ছিল দলে লক্ষ্য। এর বিপরীতে নাইজেরিয়া একই একাদশ নামায় যে দলটি কয়েকদিন আগে দারুণভাবে আইসল্যান্ডকে ২-0 তে পরাজিত করে। দলে ছিল দারুণ সম্ভাবনাময় প্লেয়ার মুসা,মোসেস,মিকেলের মতন খেলোয়াড়। দুর্ভাগ্যবশত তাদের জন্য ম্যাচের পরিবেশ অনুকূলে ছিলনা, এই ম্যাচটি রাশিয়ার নিরপেক্ষ অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হলেও মনে হবে এর পরিবর্তে বুয়েনস এয়ারসে খেলা চলছে। ভিড়ের অধিকাংশই আর্জেন্টিনার সমর্থক ছিল, আর সাথে ছিলেন লিজেন্ড ম্যারাডোনা। ফ্যানদের এরূপ সমর্থন যেকোনো দলকে বিজয়ী করে তুলার জন্যে যথেষ্ট।

নাইজেরিয়া প্রথমার্ধ থেকে চেষ্টা করে উইং এট্যাকের বদলে মাঝ মাঠ থেকে আক্রমণের সূচনা করতে। কিন্তু মাসচেরানো আর বানেগাদের সাথে ডুয়েলে পেরে উঠছিলনা তাঁরা। সাবেক চেলসির মিডফিল্ডার মিকেল খুব তাড়াতাড়ি চ্যালেঞ্জ দিয়ে, ব্লক করে আর্জেন্টিনার মাঝমাঠ কে নিরস্ত্র করতে। কিন্তু তার কোনও প্রভাব গেইমের উপর পরছিল না। খেলার ১৮মিনিটের মাথায় বানেগার মাঝমাঠ থেকে বাড়ানো বল অসাধারনভাবে কন্ট্রোল করে জালে জড়ান লিওলেন মেসি। সমস্ত আর্জেন্টাইন ফ্যানরা তখন স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিয়েছে নেক্সট রাউন্ডে উঠার। কারণ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ক্রোয়েশিয়া-আইসল্যান্ড খেলা তখনো গোল শূন্য। মেসির গোলের পর আরও কিছু সুযোগ সৃষ্টি হয়। ৩২মিনিটে থ্রু বল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া ডি-মারিয়াকে ফাউল করা হলে ফ্রি-কিক পায় আর্জেন্টিনা। গত বিশ্বকাপে ফ্রি-কিক থেকে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে গোল করেছিলেন লিওলেন মেসি। তাই এবারো ফ্রি-কিকটাও নেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একটুর জন্যে বল বারে লেগে ফিরে আসলে, আরেকটি গোল থেকে বঞ্চিত হন মেসি। এভাবেই শেষ হয় প্রথমার্ধ।
স্কোর লাইন
আর্জেন্টিনা ১-০ নাইজেরিয়া
ক্রোয়েশিয়া 0-0 আইসল্যান্ড
দ্বিতীয়ার্ধে আর্জেন্টিনা মাঠে নামে আরেকটু গোছানো ফুটবল খেলার আশায়। অপরদিকে নাইজেরিয়া নামে কোনভাবে একটি গোল আদায় করে ম্যাচটা ড্র করতে। তাই তাঁরা প্রেসিং ফুটবল খেলতে থাকে। প্রায়ই আর্জেন্টাইন ডিফেন্স থেকে ফাঁকফোকর বের করে আক্রমণ চালাচ্ছিল নাইজেরিয়া। ৪৯মিনিটে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে কর্নার পায় নাইজেরিয়া। ডিবক্সে নাইজেরিয়ান ডিফেন্ডার বালোগান কে মাসচেরানো ফাউল করায় ক্লিয়ার পেনাল্টি পায় নাইজেরিয়া। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে ভুল করেননি ভিক্টর মোসেস। নিখুঁত শর্টের মাধ্যমে বল জালে জড়াল এই নাইজেরিয়ান।
স্কোর লাইন
আর্জেন্টিনা ১-১ নাইজেরিয়া
ক্রোয়েশিয়া ১-0 আইসল্যান্ড
গোল হজম করার পর এক ছন্নছাড়া আর্জেন্টিনাকে দেখতে পাই আমরা। দলের আক্রমণে কোন পরিকল্পনা চোখে পারছিলনা। পাভোন আর এগুয়েরোকে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে নামালেও ইনস্ট্যান্ট কোন ইমপ্যাক্ট চোখে পড়ছিল না ম্যাচে। বরং ৭৭মিনিটে আরেকটি পেনাল্টি প্রায় পেয়েই বসেছিল নাইজেরিয়া। মুসার ক্রস হেড দিয়ে ক্লিয়ার করার সময় আন-ইন্টেনশনালি হাতে বল লাগে ডিফেন্ডার রোহোর। যদিও ভিএআর প্রযুক্তির বদৌলতে এ যাত্রায় বেচে যায় আর্জেন্টিনা।
স্কোর লাইন
আর্জেন্টিনা ১-১ নাইজেরিয়া
ক্রোয়েশিয়া ১-১ আইসল্যান্ড
এরপর মেসি-এগুয়েরো-হিগুয়েন জুটি মিলে অনেক সম্ভাবনা তৈরি করলেও কাঙ্ক্ষিত গোল করতে ব্যার্থ হয়। খেলার প্রায় শেষ সময়, হাতে আছে বড়জোর ১০মিনিট। এমন সময় একটা সুযোগ পায় আর্জেন্টিনা। এটাকিং সাইড যেখানে বার্থ সেখানে ডিফেন্ডাররাই বের করে নিয়ে আসলেন ম্যাচটি। ডিফেন্ডার মার্কাডোর ক্রস বাতাসে থাকা অবস্থায় শুট করেন আরেক ডিফেন্ডার রোহো। আর সেটা বুলেটের মতন নাইজেরিয়ার জালে জড়ায়। সমগ্র স্টেডিয়াম উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়। এক্সট্রা টাইমেও আর সমতায় ফেরা হয়নি নাইজেরিয়ার।
এই গোল নিয়ে পরবর্তীতে রোহো বলে-
“মধ্য বিরতির পর টানেল দিয়ে আসার সময় হঠাৎ করেই অধিনায়ক মেসি বললো, আমদের মধ্যে যে যখনই সুযোগ পাই তখন আমরা স্কোর করতে চেষ্টা করব, আমরা শুট করব সুবিধাজনক জায়গা পেলে। এটা কোন ম্যাটার না আমরা কে কোন পজিশনে খেলি। তাই আমি যখন দেখলাম যে বলটি আমার দিকে আসছে, তখন আমি সেটায় শুট করলাম। আমি জানতাম আমি এটা পারব![হাসি]”

স্কোর লাইন
আর্জেন্টিনা ২-১ নাইজেরিয়া
ক্রোয়েশিয়া ১-১ আইসল্যান্ড
আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়ার মধ্যকার ম্যাচের হাইলাইটস দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
এভাবেই নাটকীয় জয়ের মাধ্যমে সামনের রাউন্ডে উঠে আসে আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনা জিতলেও দলের অবস্থা এখনো বেশ নড়বড়ে, মাঠের খেলা দেখলে শুধু মেসি আর মাসচেরানোর প্রচেষ্টাই চোখে পড়ে। প্রথম থেকেই দলকে এটাকিং মাইন্ড সেটাপ নিয়ে খেলতে সাহায্য করেন মেসি। আর্জেন্টাইন জাদুকর মেসি গতকাল সফল হলেও, দলকে চ্যাম্পিয়নশিপে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তার একলার পারফর্মেন্স যথেষ্ট না। গতকালের ম্যাচে যার অবদান স্বীকার না করলেই নয়, তিনি হলে সাবেক বার্সা স্টার মাসচেরানো। হ্যাঁ নিজে দলকে পেনাল্টির মাধ্যমে খাঁদের কিনারায় হয়তো ফেলেছেন। কিন্তু দমে যাননি তিনি। নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সর্বোচ্চ দিয়ে লড়ে গেছেন । ৬০ মিনিটের দিকে চোখের কোণে আঘাত পেয়ে রক্ত ঝড়তে থাকে তার। একটুও ডাক্তারের কাছে দৌড়াননি কারণ সময় নষ্ট হবে। আর সময় যে তখন অমূল্য রতন। রক্তাক্ত অবস্থায় পুরো সময়টা খেলে ম্যাচ শেষ করেন। অদম্য এক গ্ল্যাডিয়েটর হয়ে দলকে গাইড করেছেন তিনি।
গ্রুপ রানার্সাপ হবার কারণে “রাউন্ড অফ সিক্সটিন”এ আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ গ্রুপ সি চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স।
ফ্রান্সের ইতিহাস বরাবরই আর্জেন্টিনার সাথে খারাপ,এই পর্যন্ত ১১ বারের মুখোমুখিতে ৬বার আর্জেন্টিনা জিতেছে,২ বার ফ্রান্স জিতেছে আর বাকি ৩ ম্যাচ হয়েছে ড্র। বিশ্বকাপে এই পর্যন্ত মাত্র দুইবার আর্জেন্টিনার সাথে সাক্ষাত হয়েছে, দুই ম্যাচেই ১-০ ও ২-১ ব্যবধানে পরাজিত হয় দ্যা ব্লুজ রা। কিন্তু সেসব ১৯৩০ সাল ও ১৯৭৮ সালের কথা। আর এখন ২০১৮! এই বিশ্বকাপের টপ ফেভারিট ফ্রান্সের এই দলটিকে অনেকে ৯৮’র বিশ্বকাপ জয়ী দলের সাথে তুলনা করছে। হুগো লরিস, গ্রিজম্যান, দেম্বেলে, এমবাপ্পে, ফেকির, পগবা, ভারানে,উমতিতি,কান্তেদের মত তারকাদের নিয়ে গড়া ফ্রান্স আর্জেন্টিনার উপর চড়াও হতে পারে যেকোনো সময়।
দেখা যাক খোঁড়াতে থাকা আর্জেন্টিনা দল আর কতদূর যেতে পারে।
বিশ্বকাপ নিয়ে আমার বাকি লেখাগুলো চাইলে পড়তে পারেন এখান থেকে-
রাশিয়া বিশ্বকাপ : ফুটবল এখন তুযারশুভ্র দেশ “রাশিয়ার” পথে (পর্ব :১)
টিম রিভিউ : আর্জেন্টিনা (পর্ব : ২)
টিম রিভিউ (পর্ব : ৩) : ব্রাজিল- হৃদয়ে যাদের ফুটবল, পারবে কি এবার হেক্সা জয় করতে?
বিশ্বকাপের মঞ্চে জাপানীদের পরিচ্ছন্নতা অভিযান এবং আমাদের অবস্থা